এখন শরৎকাল। এই সময় নানারকম ফুলের সৌরভে চারদিক থাকে ভরপুর। যেমন, ছাতিম, বরই, দোলনচাঁপা, শিউলি, জারুল, রঙ্গন, টগর, রাধাচূড়া, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, কামিনীসহ নাম না-জানা ফুল। এখানে শরতের কয়েকটি ফুলের কথা বলা হলো।
শিউলি
স্থানীয় নাম শেফালি, বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbor-tristis.পরিবার- ঙষবধপবধব. জন্মস্থান ভারত। বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। শিউলি ফুল প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর আগমনী উপহার হিসেবে আমরা পেয়ে থাকি। শিউলির সৌন্দর্য ও মিষ্টি ঘ্রাণের কোনো তুলনা হয় না। শেষ রাতে শিউলির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর পর্যন্ত। এ জন্য এর ইংরেজি নাম নাইট জেসমিন এবং হিন্দি ও উর্দুতে একে ডাকা হয় ‘রাতকা রানি’ বলে। শিউলি ফুলের আরেক নাম শেফালি। শিউলি ছাড়া শরৎ একেবারে নিষ্প্রাণ। আবার শরৎকালীন উৎসবও অনেকাংশে অপূর্ণ। ছোট্ট লাল সাদার শিউলি। ভোরের কুয়াশা ঢাকা আর শিশির ভেজা মাটিতে ফুল ফুটে ঝরে পড়ে। গ্রামবাংলায় শিউলি ফুল এখনো দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে নি। তবে শরতের ফুল শিউলির আয়ু খুবই অল্প সময়ের। অনেক কবি-সাহিত্যিক শিউলি ফুল নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।
শিউলি মাঝারি আকারের গাছ। গাছের উচ্চতা ১৫ ফুট। মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত পত্রশূন্য থাকে। এপ্রিলে নতুন পাতা জন্মায়। পুরো গাছই অমসৃণ ও লোমযুক্ত। কাণ্ড প্রায় চতুষ্কোণ, পাতা ডিম্বাকৃতির ও খসখসে ঘন সবুজ রঙের। ফুল সাদা ও ফুলের ডাঁটা কমলা রঙের। ফুল সুগন্ধিযুক্ত। ফল চ্যাপ্টা ও পাতলা। প্রতি ফুলে দুটি বীজ থাকে। ফুলের ডাঁটা থেকে কমলা বা সোনালি হলুদ রং পাওয়া যায়, যা সিল্কের কাপড় ও খাদ্যদ্রব্য রঙিন করতে ব্যবহৃত হয়। আর বাকল ট্যানিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাতা অনেক সময় শিরিষ কাগজের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দূষিত বায়ু থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড শোষণের ক্ষমতা থাকায় বিজ্ঞানীরা দূষিত বায়ু শোধনের জন্য শহরাঞ্চলে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে এ গাছ লাগানোর অনুরোধ করে থাকে। তা ছাড়া শিউলি ফুলের মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও সাহায্য করে। শিউলি ফুল একদিকে সৌন্দর্য বাড়ায়, আরেক দিকে পাতা ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে থাকে।
কামিনী
ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়াস্ওয়ার্থের বিখ্যাত ডেফোডিল ফুলই বাংলার কামিনী ফুল। যার মূল বৈশিষ্ট্য একই। সন্ধ্যায় ফুল ফোটে, ভোরবেলায় ঝরে। ফুল ছোট আকৃতির, সাদা, সুগন্ধী। এ ফুল মঞ্জরিতে উৎপন্ন হয়। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় বের হয়। কামিনী ফুল চারদিকে সুগন্ধ ছড়ায়। এই ফুলের একটি কাকতালীয় বিষয় হলো যে, এ ফুল যখন ফোটে তখন সারা দেশের সব গাছে একই দিন ফোটে। কী অদৃশ্য যোগাযোগ! ফুলবিক্রেতারা ফুলের ঝুরি সাজাতে কামিনীর ডালপালা ব্যবহার করে। এই ফুলগাছটি রোগ নিরাময় ব্যবহৃত হলেও আগের মতো ব্যাপক দেখা মিলে না।
কামিনী ফুল গাছ মূলত ক্রান্তীয়। চিরসবুজ ছোটখাটো ধরনের গাছ, ৩ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কখনো কখনো গুল্ম আকৃতিরও হয়ে থাকে। ঝোপ জাতীয় এ ফুলগাছ কেটেছেঁটে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। বাগান সজ্জায় অনন্য। শরতের এ সময়ে সারা গাছ সাদা ও সুগন্ধি ফুলের থোকায় ভরে ওঠে। ফুল ২ সেন্টিমিটার চওড়া, ৫টি খোলা পাপড়ি, বাসি হলে ঝরে পড়ে। কামিনীর বৈজ্ঞানিক নাম Murraya paniculata. এ ফুলটির আদিনিবাস চীন।
জবা
জবা আমাদের দেশের ফুল পরিবারের আরেকজন প্রাণবন্ত সদস্য। জবা পুজোর ফুল। কিছু জবা সারা বছরই ফুটতে দেখা গেলেও জবা ফোটার সময় মূলত শরৎকাল। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Hibiseus rosa-sinensiss। পরিবার Malvaceae। ফুলটি বড়, পাপড়ি পাঁচটি। বিভিন্ন রঙের হয় এই ফুল। পাতার আকৃতি অনেকটা ডিমের মতো। পাতার চারদিকে করাতের মতো দাঁত। সম্মুখভাগ সরু। এসময়ে জবা শুধু ফুলবাগানেই নয়, পথের দুধার কিংবা শহরের লনে সবুজ ঘাসের সঙ্গে দেখা যায়। এটা মোহনীয় করেছে প্রকৃতিকে। জবা নিয়ে রয়েছে বহু শ্যামা সংগীত।
টগর
ঝাঁকড়া মাথার জন্য টগরগাছ সুন্দর। ডালগুলো সোজা ওঠে না। বহু শাখা-প্রশাখা নিয়ে ঝোপের মতো। বাগানের শোভা বাড়ায়। সুন্দর করে ছেঁটে দিলে দারুণ ঘন ঝোপ হয়। কলম করে চারা করা যায়। আবার বর্ষাকালে ডাল পুঁতলেও হয়। সমতল ভূমির গাছ টগর পর্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা যায়। বাংলাদেশের বনে বাদাড়ে টগর এমনিতেই জন্মে। টগরের কাণ্ডের ছাল ধূসর। গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে সাদা দুধের মতো কষ ঝরে বলে একে সিলেটে দুধফুল বলে ডাকে। সারাবছর ফুল ফোটে। টগরের সুন্দর মৃদু গন্ধ হয়। ফুল থেকে ফলও হয়। তার মধ্যে ৩ থেকে ৬টি বীজ হয়। বড় টগরের বোঁটা এক ফুট হয়। পাতাও এক ফুট। পৃথিবীতে টগরের ৪০ প্রজাতি আছে। বাংলাদেশ ও ভারতে মাত্র ৪টি প্রজাতি পাওয়া যায়। ওষুধি কাজেও ব্যবহৃত হয়।
ছাতিম
ছাতিমের স্থানীয় নাম ছাতিয়ান, বৈজ্ঞানিক নাম এলস্টোনিয়া এসকোলারিস (Alstonia scholaris), পরিবার এপোসাইনেসি (Apocynaceae), আদি আবাস ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া। ছাতিমগাছ বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার বনাঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায় এবং সোনারগাঁয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখা যায়। ছাতিমের সরল উন্নত কাণ্ড কিছুদূর উপরে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি ঢাকনা সৃষ্টি করে। ছাতিম ফুলের অসাধারণ তীব্র গন্ধ মত্ত করে যে-কোনো মানুষের চিত্তকে। আবার অল্প সময়ে ছাতিম গাছটি একে একে ছাড়িয়ে অনেক দূর উঠে যায় এবং পত্রঘন কয়েকটি চন্দ্রাতপের স্তর সৃষ্টি করে। এসব কারণে অনেক দূর থেকেই ছাতিমগাছ শনাক্ত করা যায়। বিবরণে দেখা যায় বৃহৎ চিরহরিৎ বৃক্ষ। গাছটির উচ্চতা ৫০ থেকে ৬০ ফুট। গাছে দুধের মতো আঠা থাকে। বাকল অমসৃণ ও ধূসর বর্ণের। ডাল-পালা চক্রাকারে সাজানো। গাছের গোড়ায় বড় অধিক মূল থাকে। আর গাছের পাতা চামড়ার মতো খসখসে। ফুল ছোট সবুজাভ, ফল সাদা, সরু, গোলাকৃতি, গুচ্ছভাবে ঝুলানো। কাঠ সাদা ও নরম। সাধারণত প্যাকিং বাক্স, চায়ের বাক্স, পেন্সিল, ম্যাচ বক্স তৈরি এবং সস্তা আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ছাতিম গাছের বাকল পুরোনো ডায়রিয়া, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, হৃদরোগ, হাঁপানি, ক্ষত, জ্বর, কোষ্ঠ সারানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
শাপলা
এ সময়ে পুকুর, ডোবা, হাওর, বিল সব জায়গায় ফোটেছে শাপলা ফুল। শাপলা কন্দজাতীয় জলজ। বাঁচে বহুদিন। শাপলার কন্দ বা মূল পানির নিচে মাটিতে থাকে। পদ্মের সঙ্গে শাপলার মিল আছে। শাপলার পাতা পানিতে ভাসমান থাকে আর পদ্মপাতা থাকে পানির উপরে। পাতা বড় গোলাকার, বোঁটা লম্বা। ফুল বড়, রং সাদা। গাঢ় লাল ও গোলাপি রঙের শাপলা দেখতেও সুন্দর। ফুল ফোটে সারা বছর। ফল ছোট ছোট বীজে ভরা। খৈ ভেজে খাওয়া যায়। শাপলার পরিণত ফলকে ঢ্যাপ বা ভেট বলে। ছোট ছেলেমেয়েরা কাঁচা ঢ্যাপ খেতে ভালোবাসে। এশীয় শাপলার লম্বা ডাঁটা ও ফুল সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়।
পদ্ম
পদ্ম আমাদের মিষ্টি মেয়ে। বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera Gaertn. পরিবার Nymphacaceae। পদ্ম জলকন্যার সংসার পানিতে। ফুলটি ৮-২০ সেন্টিমিটার হয়। গোলাপি এবং সাদার মিশ্রণ থাকে পদ্মের পাপড়িতে।
পদ্ম কন্দ জাতীয় ভূ-আশ্রয়ী বহু বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এর বংশ বিস্তার ঘটে কন্দের মাধ্যমে। পাতা জলের ওপরে ভাসলেও এর কন্দ বা মূল জলের নিচে মাটিতে থাকে। জলের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে গাছ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাতা বেশ বড়, পুরু, গোলাকার ও রং সবুজ। পাতার বোঁটা বেশ লম্বা, ভেতরে অংশ অনেকটাই ফাঁপা থাকে। ফুলের ডাটার ভেতর অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ছিদ্র থাকে। ফুল আকারে বড় এবং অসংখ্য নরম কোমল পাপড়ির সমন্বয়ে সৃষ্টি পদ্ম ফুলের। ফুল ঊধ্বর্মুখী, মাঝে পরাগ অবস্থিত। ফুটন্ত তাজা ফুলে মিষ্টি সুগন্ধ থাকে। ফুল ফোটে রাতে এবং ভোর সকাল থেকে রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির পূর্ব পর্যন্ত প্রস্ফুটিত থাকে। রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফুল সংকুচিত হয়ে যায় ও পরবর্তী সময়ে রৌদ্রের প্রখরতা কমে গেলে আবার প্রস্ফুটিত হয়। ফুটন্ত ফুল এভাবে বেশ অনেক দিন ধরে সৌন্দর্য বিলিয়ে যায়। পদ্ম ফুলের রং মূলত লাল সাদা ও গোলাপির মিশ্রণ যুক্ত। তা ছাড়া নানা প্রজাতির পদ্ম ফুল দেখা যায়। এর মাঝে রয়েছে লাল, সাদা ও নীল রঙের ফুল। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রাকৃতিক জলাধার হাওর-বাঁওড়, খালে-বিলে ও ঝিলের জলে পদ্ম ফুল ফুটতে দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে ফুল ফোটা শুরু হয়। তবে শরতে অধিক পরিমাণে ফুল ফোটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে হেমন্তকাল অবধি। নাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজনের কাছে অতি প্রিয় ও পবিত্র ফুল পদ্ম। বিশেষ করে দুর্গা পূজাতে পদ্ম ফুলের রয়েছে বেশ চাহিদা ও কদর। ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে পদ্ম ফুল সংগ্রহ ও বিক্রয় করে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। তা ছাড়া ভেষজগুণ সমৃদ্ধ পদ্ম ফুলের গাছ। এর ডাটা সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। মানব দেহে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে অতুলনীয়। চুলকানি ও রক্ত আমাশয় নিরাময়ে বেশ উপকারী।
Leave a Reply
Your identity will not be published.