আসলেই জীবন খুব অনিশ্চিত। কখন কার সাথে কী হয়ে যায় বোঝা বড় দায়। যে লোকটির শুক্রবার সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠান শেষে, শনিবার ফ্লাইটে করে আসামে ফিরে আসার কথা ছিল সশরীরে, তিনি কি না রবিবার শেষরাতে আসামে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে! যে মঞ্চে গান শোনানোর জন্য লোকটা গিয়েছিলেন, নর্থ ইস্ট ফেস্টিভ্যালÑসেই উৎসবেই আর পৌঁছানো হলো না তাঁর। বিমানবন্দরের এক্সিট গেট দিয়ে এবারও বেরোলেন ঠিকই কিন্তু শববাহী গাড়িতে করে। রবিবার যার গুয়াহাটিতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে দীর্ঘ দূরত্বের ভ্রমণ ও অনুষ্ঠানের ধকল শেষে আরাম করার কথা, ঘুম লাগানোর কথা, তিনি কিনা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। প্রাণের শহরে ফিরলেন, যদিও ফিরে এসে মিশে গেলেন অগণিত ভক্তের অবিরাম স্রোতের মাঝে। জীবন নামক সবচেয়ে বড় কনসার্ট শেষে। যেখানে কোনো আঞ্চলিকতা নেই, কোনো জাতীয়তাবাদ নেই। নেই কোনো পূর্ব-পশ্চিমের ভাগাভাগি। নেই কোনো ভাষা-মাটির বিবাদ। আছে কেবল ভালোবাসা।
স্বভাবতই লাঞ্চ আওয়ারে বসে একটু মোবাইল দেখছিলাম। রোজ যেমনটা দেখি আর কী! ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করতে করতে আচমকাই একটা পোস্ট চোখে পড়ল, লেখা ‘জুবিন আর নাই।’ বিশ্বাস করি নি। যদিও কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধু ফোন করে জানিয়েছিল সিঙ্গাপুরে স্কুভি ড্রাইভ করতে গিয়ে তাঁর আহত হওয়ার কথা। কিন্তু ভাবি নি সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থেকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না তাঁকে। তাই পোস্টটা দেখার পর আধ ঘণ্টা নিয়েছি খবরটা কনফার্ম করতে। বারবার কনফার্ম, রিকনফার্ম করেছি। খবরটা কোলে নিয়ে বসেছিলাম বোবার মতো। স্থবির হয়ে। ভুল হোক, ভুল হোক, ভুল হোক। আরও অন্ধকার জাপ্টে যেন না ধরে আমাদের। সামান্য কিছু আলো বেঁচে থাক। কারণ তাঁর চলে যাওয়া মানে একটা প্রজন্ম-স্মৃতির যবনিকা পতন। জীবনের জানান দিয়ে যাওয়া – বয়স বাড়ছে। আশেপাশের সব বদলে যাবে আরও। কিন্তু না ‘Zubeen Garg is no more!’ ছোট্ট মেসেজ। কনফার্ম। মুহূর্তের মধ্যে উলটপালট হয়ে গেল হৃদয়ের সাজানো সবকিছু। আমার কৈশোরের, প্রাক-যৌবনের অসংখ্য সুন্দর অংশ চোখের পলকে বিসর্জন গেল তাঁর নামের সাথে। অকালেই ফুরিয়ে গেল উত্তর-পূর্ব ভারত তথা আসমের অমূল্য সম্পদ। সেই থেকে আর কোনো কাজ করতে পারি নি ঠিকমতো। ঘুম আসে নি সারা রাত। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছিল একদম ছোটবেলা থেকেই আমার দেহ, মন, মস্তিষ্ককে অসমীয়া কথা ও সুরে মোহাচ্ছন্ন করে রাখা তাঁর ‘মরমজান’এর কথা। যতবার চোখ বন্ধ করেছি স্পষ্ট ভেসে উঠতে দেখছিলাম বাজার থেকে বাবার 'অনামিকা' ক্যাসেট কিনে এনে অবুঝ আমাকে জুবিনের গান শোনানোর দিনগুলো। টেপরেকর্ডারে তাঁর ‘মায়া’, ‘অনামিকা’ ইত্যাদি অ্যালবামের সাথে আমার এলোমেলো কাটানো ভ্যাকেশনগুলো। ভেতর থেকে দলাপাকানো কিছু একটা উঠে এসে গলার কাছে আটকে যাচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে পরিবারের কোনো এক আপনজন সকলকে কাঁদিয়ে হঠাৎ করেই বিদায় নিয়ে নিল।
ছোটবেলা থেকে অনেকবারই তাঁর লাইভ প্রোগ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তবে মনে গেঁথে আছে এবছরেরই জানুয়ারি মাসে অসম থেকে অনেক দূরে, দক্ষিণ ভারতের এক মঞ্চে তাঁকে দেখার মুহূর্তটা। যে মুহূর্তকে কোনো না কোনোভাবে মনের দেয়ালে সাজিয়ে রাখতে চাইব আজীবন। ভোগালি বিহুর আগের দিন ‘আসাম সোশ্যাইটি অফ ব্যাঙ্গালোর’ জুবিনকে নিয়ে এসেছিল প্রবাসী অসমীয়াদের মাটির গানে, মাটির সুরে সারা রাত মাতিয়ে রাখতে। আমার অফিসের দুই কলিগ সেই কমিটিতে থাকার সুবাদে উরুকার রাতে খুব কাছ থেকে জুবিনকে দেখেছি আমি। এই সৌভাগ্য বোধহয় সকলের হয় না। এত কাছ থেকে দেখার সুবাদেই বলছি, এরকম down-to-earth singer বোধহয় দ্বিতীয় আর জন্মাবে না আমার জন্মভূমিতে। তাঁর শিল্পীসত্তার মধ্যে যে অসাধারণ গুণ ছিল, তা হাতে গোনা কয়েকজনেরই আছে। নিজে যা ভাবতেন, যা বুঝতেন, অকপটে বলে ফেলতেন। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা লোকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মহলে থেকেও স্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা করতে, নানা সময়ে সরকার-বিরোধী বক্তব্য রাখতে কখনোই পিছুপা হন নি। আসামে যখন আলফা ফতোয়া জারি করেছে হিন্দী গান গাওয়া যাবে না, তিনি মঞ্চে হিন্দি গান গেয়েছেন। বিহুমঞ্চে উঠেও নির্দ্বিধায় গেয়েছেন 'মন যে হারালো, দু’হাত বাড়ালো, আজ তোর ছোঁয়া পেতে।’ এমনকি ধর্মে বিশ্বাস করেন না, সেটাও প্রকাশ্যে বলেছেন। যার জন্য বিতর্কেও থাকতে হয়েছে অনেক। জুবিন ভালোভাবেই জানতেন তাঁর প্রথম অপরাধ সে নর্থ-ইস্টের। আর নর্থ-ইস্ট মানেই বক্র চাহনি বলিউডের। তবুও কোনোদিন আপোষ করেন নি কারও সাথে। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য হলেও মাথা নিচু করেন নি কারও সামনে। কখনোই একজন বোহেমিয়ান শিল্পীর মতো নিজের জীবনকে নিয়মানুবর্তিতায় বেঁধে রাখতে চান নি তিনি। সবসময়ই মিশে থাকতে চেয়েছেন অসমের মানুষের সাথে। অসমের জল-বায়ু-মাটির সাথে। সুযোগ পেলেই ভেসে গিয়েছেন বাংলা-অসমীয়া দুই ভাষারই উদ্দামতায়। তাঁর গানের কথা ছেড়েই দিলাম; খ্যাতির এত তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েও এত অমায়িক একটা মানুষ কী করে হতে পারে সেটা দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম সেদিন। বলতে গেলে সেদিনের অনুষ্ঠানের পর মানুষটার ওপর শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গেছিল আমার।
সেইজন্যই জুবিন গার্গ আজ অসমের জাতীয় নায়কে পরিণত। সারা অসমবাসীর কাছে সে চোখের মণি। ভূপেন হাজরিকার ওমন পর্বততুল্য অস্তিত্বের পর তিনিই তো পেরেছিলেন নিজেকে ওই উচ্চতায় নিয়ে যেতে। সুধাকন্ঠের শ্রেষ্ঠ সব গানের ভান্ডার যখন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে, ঠিক সেই সময়ই নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে প্রায় তিনটি দশক ধরে কয়েক হাজার বিচিত্র ভাব ও রসের গান গেয়ে, প্রায় একা হাতে নেতৃত্ব দিয়ে গেলেন অসমীয়া আধুনিক সংগীতকে। এক জটিল সময়ে এসে হাল ধরলেন অসমীয়ার। সবচেয়ে খারাপ সময়েও সুদিন ফিরিয়ে আনলেন অসমীয়া সিনেমার।সারা ভারতবর্ষের সাথে নতুন ভাবে পরিচয় করালেন অসমীয়া ভাষা, অসমীয়া কথাকে। সারা পৃথিবী নতুন করে চিনল 'বিহু'কে। উজানের বিহু-বনের সুরেলা মধুর কণ্ঠে শুরু হলো এক নতুন যুগ যার নাম ‘জুবিন’। মুম্বাইয়ে এ আর রহমান যেমন বাইরের বিভিন্ন যন্ত্র-প্রযুক্তিকে হৃদয়ের সংগীতের সাথে একাকার করে গানে নতুনত্ব এনে দিয়েছিলেন, একই সময়ে আবির্ভাব হওয়া জুবিন গার্গও সেই কাজটাই করেছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য। ফিল্মফেয়ার এবং আইফা-এর মতো পুরস্কার জিতেও নিজের ভাই-বন্ধুদের ছেড়ে যান নি কখনো। আমরা যারা একটু আধটু গানবাজনার চর্চা করি, আমরা জানি তাঁর মতো গলার ভার্সেটাইলিটি খুব কম শিল্পীর আছে৷ একসময় বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে প্রচুর সিনেমার আবহে অবধারিতভাবে থাকত জুবিনের দরদী গলা। তারপর ধীরে ধীরে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে জনপ্রিয়তার একেবারে শীর্ষে। জিৎ গাঙুলির সুরে এবং প্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের কলমে তাঁর গাওয়া ‘প্রিয়া রে প্রিয়া রে’ কীরকম আলোড়ন ফেলেছিল সারা বাংলায় তা ভাবতে বসলে আজও কাঁটা দেয় গায়ে। তাঁর সেই আওয়াজ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর বিরহ, বিচ্ছেদ সমস্ত ক্ষতের উপর নীরবেই প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল সেইসময়। কলকাতা থেকে শুরু করে ডিব্রুগড়, তিনসুকিয়া... প্রতিটা শহরের প্রতিজন বাঙালি উদ্বেল হয়ে গিয়েছিল তাঁর পাঁচ মিনিট দশ সেকেন্ডে। এমনকি বাংলাদেশের লোকজনও সেই গানের জন্যই আপন করে নিয়েছিল রাহুল-প্রিয়াঙ্কাকে। তখন বাংলা অভিনেতা দেবের প্লেব্যাকে, জিৎ-এর সুরে গাইতে পারা বেস্ট সিঙ্গার মানেই ছিলেন জুবিন গার্গ। দেবের ভয়েজের সাথে কারও গলা যদি নিঁখুত মানাত সেটাও তো একমাত্র তাঁরই ছিল। তাই তো ‘ইয়া আলি’ থেকে শুরু করে অন্যান্য হিন্দি গান ছাপিয়েও-তাঁর গাওয়া ‘মন মানে না’, ‘আয়না মন ভাঙা আয়না’, ‘চোখের জলে ভাসিয়ে দিলাম’, ‘যে দেশে চেনা জানা’, ‘বঁধুয়া’, ‘প্রেম কী বুঝি নি’ বা ‘মন তোকে দিলাম’-এর মতো গান আজও অমলিন আমার স্মৃতিতে। তাঁর কত গান আমার অনুভবকে নাড়া দিয়ে গেছে, আজও দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোটবেলায় জুবিনকে চিনতে, তাঁর বাংলা গান শুনতে, তাঁর বিহুর সুরে নিজের কিশোর মনকে মাতিয়ে রাখতে কতবার যে লাইন দিয়েছি ক্যাসেটের দোকানে তার হিসেব নেই। আজও যখন ‘জানে কিয়া জানেমন’ কিংবা ‘দিলরুবা দিলনাশী’ শুনি মনে হয় আমার হিরো হোন্ডা, টেপরেকর্ডার, ক্যাসেট, শাকা লাকা বুম বুম, চ্যানেল ভি-র মতো একটা জীবন ফের একবার ফিরে আসছে। ভেসে উঠছে শৈশবের সব রঙিন ছবি। যারা জুবিনকে চেনেন না তাঁদের কিছুতেই বলে বোঝাতে পারব না এগুলোর কথা। বোঝাতে পারব না goosebumps কেমন ছিল যখন ‘প্রিয়া রে’ গানের, ভালোবাসা কেন এত অসহায়, এই পার্টটা প্রথমবার শুনেছিলাম।
জুবিন এভাবেই গেয়ে এবং গাইয়ে অনেক সাধারণ গানকে একেবারে ‘অসাধারণ’ করে দিয়ে গেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে জুবিন কখনোই ভূপেন হাজরিকা ছিলেন না, এ আর রহমান, আর ডি বর্মনও ছিলেন না। ডিলান, ফ্লইড, ক্লিপ্টন, মাইকেল জ্যাকশন কেউই ছিলেন না। তবুও সে তাঁদের চাইতেও অনেক কিছু, অনেক বড় কিছু ছিলেন আমাদের কাছে। যার কোনো পরিমাপ নেই। যাকে কোনো বিশেষণেও বাঁধা যায় না। খুব কম মানুষ থাকে যাদের চলে যাওয়া আমাদের ভেতরকে তছনছ করে ফেলে। চোখের জলের বাঁধ ভেঙে দেয়। জুবিনও ঠিক সেই দলের। তাই সেদিন দুপুর থেকেই আসামের গোটা আকাশ ফাঁকা ফাঁকা। দোকানপাট, হাট-বাজার সব বন্ধ। রাস্তায় গাড়ি নেই, ভিড়ভাট্টা নেই, নেই মানুষের কোলাহল। এক অদ্ভুত শূন্যতা চারদিকে। আসামের প্রাণচঞ্চল গুয়াহাটি টানা দু’দিন ধরে নিথর। যা আমি দূরে থেকেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্রকৃতার্থে বুঝতে পারছি জাতীয় শোক কী! সন্তান হারানোর শোক ঠিক কেমন! শোকার্ত পরিবেশে যারা এক গ্লাসের শরিক, যারা অন্যদিন ছুঁয়েও দেখেন না, সেই তাঁরাও সেদিন দু'গ্লাস খেলেন। এক জুনিয়র হোয়াটস্অ্যাপে ভিডিও পাঠাল, আমাদের ইউনিভার্সিটি জুড়ে শোক। তাঁর চলে যাওয়ার খবর শোনামাত্র দলে দলে প্রতিটা বিভাগের অধ্যাপক, সহ-অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, কর্মী সকলে জড়ো হয়ে গেল শোকজ্ঞাপন করতে। কীরকম শোকজ্ঞাপন ? তাঁরা জুবিনের গান গাইতে লাগল। তাঁরা জুবিনের মৃত্যুসংবাদ অস্বীকার করতে চাইল। জুবিনের গাওয়া গান নিজেরা গাইতে গাইতে হাউহাউ করে কাঁদল। আমরা যারা রোজগারের জন্য বাইরে... আমাদের প্রত্যেকেরও মুখ ভার। সর্বত্র মেঘের পরত। ভেতরে ভেতরে এক ঝড় বয়ে চলছে সব্বার। ধনী-গরিব প্রত্যেকের ফিডে শুধু শোকাহত পোস্ট। তাঁর ‘যদি জীবনব বঙ বোবে’, ‘দেহব ভবসা নাই’ ইত্যাদি গানের ক্লিপ্স। প্রদীপ ও মোমবাতির আলোয় শ্রদ্ধা। রাস্তায় বেরোলেই মনে হচ্ছে কোভিড পর্বের লকডাউনের কথা। তবে এবার কেউ নীরব নেই। সারা অসম মুখরিত প্রিয় সন্তানের গানে। এক গায়কের মৃত্যুজনিত শোক বলে শুধু একে দাগানো যাবে না কখনোই। এখনো মোবাইলের স্ক্রিণে একের পর এক ভিডিও আসছে গুয়াহাটি, যোরহাট, নঁগাও, ডিব্রুগড়, তেজপুর, প্রতিটা শহরে, রাস্তার মোড়ে লোক নেমে আসছে তাঁর গান গাইতে গাইতে। কফিন কাঁধে নিয়ে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও সেই গানগুলো গাইছেন। ডিজিপি নিজে রাস্তায় নেমে ভিড় সামলাচ্ছেন। শেষকৃত্য না হওয়া পর্যন্ত অসমের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত। ডেলিভারি সার্ভিস থেকে শুরু জমেটো, সুইগি সব বন্ধ। কোনো এক অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়ে জুবিন একবার বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর সারা অসম যেন ‘মায়াবিনী ৰাতিৰ বুকুত’ গায়, মনে রাখে! তাই রাস্তায় সঙ্গোবদ্ধ হয়ে আলো জ্বেলে সকলে তা গাইছে। টটোচালক, দোকানদার থেকে শুরু করে অফিসফেরত উচ্চবর্গীয় সকলেই সেখানে শামিল। সমাজের সর্বস্তরের লোক একসাথে দাঁড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে আবেগের বাঁধভাঙা প্লাবনে। এমন দৃশ্য অবর্ণনীয়। সচরাচর দেখা মেলে না এসবের। পৃথিবীর আর কোনো শিল্পী তাঁর নিজের শহরে এতটা ভালোবাসা পেয়েছেন কি না জানি না। আসলে জুবিন শুধুমাত্র কোনো গায়ক ছিলেন না আমাদের কাছে। ছিলেন আমাদের হৃদয়ের, আমাদের প্রতিদিনের যাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অসমের কেউ কখনো ভাবেন নি ভূপেন হাজরিকার পর আর কেউ অসমে জন্মগ্রহণ করে প্রত্যেকের হৃদয়ে এক কালোত্তীর্ণ জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে! আর সেখানেই একটা জাতির জনক হয়ে উঠেছেন জুবিন গার্গ। তাঁদের রাগ-অনুরাগ, প্রেম-ভালোবাসা, হাসি-ঠাট্টা,সবকিছুর মাঝে নিজের নামকে বিলিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। ঈশ্বরতুল্য এক অগ্রজ-এর কালজয়ী সব সৃষ্টির মধ্য থেকে নিজের জন্য একটু জায়গা বের করে এমন কিংবদন্তি হয়ে ওঠা, এমন আইকন হওয়া কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। অনেক মিথ, অনেক বিশ্বাস, অনেক আকাঙ্খা, অনেক ভরসা আর অনেকটা এলোমেলো জীবন-যাপন ওতপ্রোত জড়িয়ে রাখতে হয় এর সঙ্গে। জুবিন তা পেরেছিল। তাই তো Gen X থেকে শুরু করে Gen Z, ১৯৯২ সন থেকে শুরু করে ২০২৫ সন পর্যন্ত ৩৩টা বছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী কত কোজাগরী রাত পার করে দিল কেবল তাঁর গান শুনতে শুনতে। শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠজন প্রত্যেককেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকলেন তাঁর সুর দেওয়া, তাঁর লেখা প্রতিটা গানে। যার প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা বাক্যে মিশে থাকে অসমের মাটির গন্ধ, ফুটে ওঠে অসমীয়ার আবেগ-অনুভূতির সবকিছু। যেগুলো শুনলে আদতেই বোঝা যায় জুবিনের সৃষ্টিশীল মনের কথা। যা হৃদয়ের একেবারে নিভৃত কোণে গিয়ে স্পর্শ করে। শুধু স্পর্শই নয়, হৃদয়ে বৈদ্যুতিক অনুরণন আরম্ভ করে দেয়। সেই জন্যই হয়তো প্রতিটা প্রজন্মের তরুণ একদিনের জন্য হলেও জুবিনের সুরের মূর্চ্ছনায় সারা রাত পার করে দিতে চায়। কেকে যেমন ওপারে চলে গেলেও তাঁর ছায়া আজও রয়েছেন ভারতবর্ষের প্রতিটা কলেজ ক্যাম্পাসে, প্রতিটা গানের আসরে, প্রতিটা সান্ধ্য আড্ডায়, প্রতিটা প্রেমে, প্রতিটা বিচ্ছেদে ঠিক সেভাবেই বহমান থাকবেন জুবিন গার্গও। আমরা আমৃত্যু বাঁচিয়ে রাখব আমাদের জুবিন দা’কে। বাঁচিয়ে রাখতে শেখাব পরবর্তী প্রজন্মকেও...
লেখক : জয়রাজ পাল, চাবুয়া, আসাম, ভারতের অধিবাসী।
Leave a Reply
Your identity will not be published.