নক্ষত্র-নূপুর (দ্বিতীয় খণ্ড)

নক্ষত্র-নূপুর  (দ্বিতীয় খণ্ড)

[১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন নতুন রূপ পেতে থেকে। বাংলা এবং ভারতবর্ষের এই বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ল জার্মানি এবং রাশিয়া। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব-প্রয়াসের প্রায় সমান্তরালে চলতে থাকল বাংলা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবের প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে রুশ বিপ্লবী এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেম এবং বিপ্লবের কাহিনি ও এই দুই ভূখণ্ডের বিপ্লবীদের আন্তঃসম্পর্ক। লেখাটির প্রথম খণ্ডের কাহিনি শেষ হয়েছে ১৯১৪-১৫ সালে এবং এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘অন্যদিন’-এ। এই খণ্ডের গল্প আরম্ভ হয়েছে ১৯১৪ সালের রাশিয়ায় আর শেষ হয়েছে ১৯২১-২২ সালে গিয়ে।]

 

গদর পার্টির নেতা হরদয়াল আজ বিখ্যাত লেখক জ্যাক লন্ডনের  খামারবাড়িতে এসেছে। এই  খামারবাড়ি সান ফ্রান্সিসকো থেকে পঞ্চাশ মাইল উত্তরে, গ্লেন এলেনে। জ্যাক লন্ডন এখানে কৃষিকাজ করে। কয়েক বছর ধরে ওর দর্শন হলো অ্যাগ্রেরিয়ান মাসকুলিনিটি। এই দর্শন বলে ভূমি কর্ষণ করলে প্রকৃতির সাথে আত্মার মিলন ঘটে, স্বনির্ভরতা আসে, আর নগরের নানারকম রগড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। এ কারণে অনেকে মনে করে কৃষিকাজের মাঝেই সত্যিকার পৌরুষ নিহিত। এটাই অ্যাগ্রেরিয়ান মাসকুলিনিটি।

আজ সন্ধ্যায় জ্যাক লন্ডন ওর বাড়িতে আরও কিছু বন্ধুবান্ধবকেও আমন্ত্রণ করেছে। ওর ড্রইংরুমের ফায়ারপ্লেসের পাশেই একটা সোফায় বসে চুরুট টানছে এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক উইন্সটন চার্চিল। এখন তার দশটা উপন্যাস বেরিয়েছে। সবগুলো আমেরিকায় বেস্ট সেলার। উইন্সটনের উল্টোদিকে বসে আছে প্রিন্সেস উলা। কোনো এক সুলতানের হারেমে উপপত্নী ছিল। অনেক টাকা কামিয়ে আমেরিকায় ফিরে এসেছে। একটু দূরে পেনাং থেকে সদ্য ফেরত নাবিক লুথার শেল্ফ থেকে একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। আর একদম কোনার সোফায় বসে আছে হরদয়াল।

হরদয়াল আজ জ্যাক লন্ডনের আমন্ত্রণ রক্ষা করেছে ঠিকই, কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে সে সকাল থেকে মহাচিন্তিত। ওর কানে এসেছে আমেরিকান গোয়েন্দারা ব্রিটিশদের অনুরোধে খুব শিগগিরই ওকে গ্রেপ্তার করবে। তারপর জেলে ভরে রাখবে অথবা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেবে। এর একটাও ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের অনুকূলে যাবে না। ব্রিটিশদের হাতে পড়লে ওর মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।  হরদয়াল যে মনমরা হয়ে আছে সেটা জ্যাক লন্ডনের নজর এড়ায় নি। ও ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হরদয়ালের কাছে এসে  বিস্রস্ত কন্ঠে বলল, হরদয়াল, তোমার বন্ধু উইন্সটন যতই নাম্বার ওয়ান বেস্ট সেলার হোক, হোয়াইট ফ্যাং আর কল অফ দা ওয়াইল্ড লেখার পর সাহিত্যিক হিসেবে আমিই অমর হব। এ ব্যাপারে তোমার কী অভিমত ? মানে তুমি কি এটা স্বীকার করো ?

 জ্যাকের দ্বিতীয় স্ত্রী কারা সন্ধে ফুরোবার আগেই কয়েক পেগ হুইস্কি গিলে ফেলেছে। সে টালমাটাল কণ্ঠে বলল, হরদয়াল স্বীকার করবে না মানে ? সবাইকে স্বীকার করতে হবে তুমি এই সময়ের অন্যতম সেরা লেখক। উইন্সটন, আপনি কী বলেন ?

উইন্সটন চার্চিল বেশ কয়েক বছর ধরে আকাশস্পর্শী জনপ্রিয়তা উপভোগ করছে। তাই এসব নিয়ে ওর মনে কোনো জটিলতা নেই। উইন্সটন প্রশ্রয়সূচক হাসি দিয়ে বলল, জ্যাক যা মনে করে তা-ই হবে। কিন্তু মনে রেখো আমিই এই সময়ের সবচেয়ে পাঠকনন্দিত লেখক।

জ্যাক লন্ডন বলল, উফ, তোমরা থামো, হরদয়ালকে বলতে দাও।

হরদয়াল মদ্যপান করে না। ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো মাদকতায় তার আসক্তি নেই। হরদয়াল গম্ভীর কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ জ্যাক, আমার ধারণা তুমি লেখক হিসেবে টিকে থাকবে। উইন্সটন আমেরিকায় সবচেয়ে পপুলার, কিন্তু আমি শুনেছি ইউরোপ আর এশিয়ায় তুমি অনেক বেশি পরিচিত।

জ্যাক লন্ডন খুশি হয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, হরদয়াল। আমি অমর হলে তুমিও অমর হবে।

হরদয়াল এবার অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি ? আমি কীভাবে অমর হব ?

আমি একটা নতুন উপন্যাস লিখছি, নাম, দা লিটল লেডি অফ দা বিগ হাউজ।

তো ?

সেখানে তুমি একটা চরিত্র।

তাই! কী চরিত্র ?

ওখানে তুমি একজন মহান ভারতীয় বিপ্লবী যে আমেরিকায় এসে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে।

হরদয়াল অবাক হয়ে বলল, তুমি ঠাট্টা করছ, ঠিক না ?

জ্যাক লন্ডন ওর স্ত্রী কারার দিকে তাকিয়ে বলল, কারা, দেখো, হরদয়াল আমার কথা বিশ্বাস করছে না। টেবিলের ওপর থেকে আমার লেখার খাতাটা নিয়ে এসো তো।

কারা টেবিল থেকে খাতা এনে জ্যাক লন্ডনের হাতে দিল। জ্যাক লন্ডন রিডিং গ্লাস পরে খাতার কয়েক পাতা উল্টে পড়া শুরু করল,

That's Dar Hyal", He's a revolutionist, of sorts. He's dabbled in our universities, studied in France, Italy, Switzerland, is a political refugee from India, and he's hitched his wagon to two stars : one, a new synthetic system of philosophy; the other, rebellion against the tyranny of British rule in India. He advocates individual terrorism and direct mass action. That's why his paper, Kadar, or Badar, or something like that, was suppressed here in California, and why he narrowly escaped being deported; and that's why he's up here just now, devoting himself to formulating his philosophy. কারা বলল, জ্যাক চালাকি করে তোমার নাম হরদয়াল থেকে বদলে দর হয়াল করে দিয়েছে। যেন তোমার নামের রেফ্রেন্স থাকে ঠিকই, কিন্তু আবার মাঝখান দিয়ে এই লেখার কারণে তুমি ফেঁসে না যাও।

হরদয়াল বলল, এসব বলে এখন লাভ নেই। আমি যা ফাঁসার তা ফেঁসে গেছি। শুনেছি তোমাদের সরকার ক’দিনের ভেতরেই আমাকে জেলে দেবে নয়তো ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেবে। তবে বিপ্লবের প্রয়াস থেমে থাকবে না। যেখানেই থাকি আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।

জ্যাক লন্ডন বলল, দ্যাট ইজ দা স্পিরিট, হরদয়াল!

 

জার্মানি থেকে ছয় মাস ধরে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে কখনো গাড়িতে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো ঘোড়ায় চড়ে, পাহাড়পর্বত নদনদী অরণ্য-মরু পেরিয়ে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ আফগানিস্তান পৌঁছেছে। খুবই কষ্টকর ভ্রমণ, তবু দেশের জন্য এই  কষ্ট সে আনন্দের সঙ্গে সহ্য করেছে।

আসলে এই অভিযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল হরদয়ালের। আমেরিকা থেকে পালিয়ে হরদয়াল প্রথমে সুইজারল্যান্ড এসেছিল। তারপর বার্লিন। ও এখন বার্লিন কমিটির সাথে কাজ করছে।  হরদয়াল জানিয়েছে, সে আফগান এক্সপেডিশনে আসতে পারবে না। এ কারণেই নেতৃত্বের ভার পড়েছে মহেন্দ্র প্রতাপের ওপর। ওর সঙ্গে এসেছে হরদয়ালের গদর পার্টির সহযোগী মৌলভি বরকতুল্লাহ, বার্লিন কমিটির চেম্পাকরমণ পিল্লাই, জার্মান ডিপ্লোমেট ডক্টর ওয়ার্নার হেন্টিগ, জেনারেল অস্কার রিটার, আনোয়ার পাশার বন্ধু কাজিম বে আর কয়েকজন আফ্রিদি সৈন্য।

তবে ওদের এই লম্বা যাত্রা খুব সহজ ছিল না। ব্রিটিশ আর রাশিয়ানরা খবর পেয়ে ওদের পারস্যে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সুবিধা করতে পারে নি। তখন রাজা জর্জ আর ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ আফগান সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেছে, তোমরা যদি নিরপেক্ষতা না রাখো তাহলে খবর আছে।

আফগানিস্তান মুসলমান দেশ। তবে  সামান্য হলেও গৌতম বুদ্ধের প্রভাব এখানে এখনো অক্ষুণ্ন। এ কারণে যতক্ষণ কেউ এ দেশে  অতিথি ততক্ষণ  তারা দেবতার সম্মান পায়। কিন্তু তার আগে বা পরে কী হবে সে কথা কেউ বলতে পারে না।  জার্মানি, তুরস্ক আর ভারতীয়দের এই দলটিকে ওরা সাদর সম্ভাষণা জানিয়ে আতিথ্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।  ওরা রাজার প্রাসাদে অতিথি হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু একদিনের ভেতরেই ওরা টের পেয়েছে ওদের থাকার জায়গাটা সশস্ত্র প্রহরী পরিবৃত। তবে কি ওরা গৃহবন্দি হয়ে গেল ? সরকার থেকে একজন ওদের জানিয়েছে, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আফগান আমির হাবিবুল্লাহ খান এই মুহূর্তে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ পাগমানে আছে। ওর দেখা পেতে তিন সপ্তাহ লেগে গেল। জার্মানির কায়জার আর তুরস্কের সুলতান মেহমেদ দুটো চিঠি পাঠিয়েছে আমিরকে।  দুজনেই ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমিরের সমর্থন চেয়েছে। আফগানিস্তানকে যেন বিপ্লবীদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয় সেই অনুরোধ করেছে ওরা। কারণ, আফগানিস্তান থেকে  উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারত আক্রমণ করা সহজ। কিন্তু আফগান আমির স্পষ্ট করে জানাচ্ছে না সে সাহায্য করবে নাকি করবে না।

 ক’দিন আগে তুরস্কের সুলতানও অনেকটা এরকম ব্যবহার করেছে।  ভাসা ভাসা দু কূল রক্ষা করা কথা বলেছে। কিন্তু সুলতানের শ্যালক, অটোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধমন্ত্র্ আনোয়ার পাশা, ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে ভীষণ উদগ্রীব। আনোয়ার পাশা ওদের পারস্য পর্যন্ত সেফ প্যাসেজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মহেন্দ্র প্রতাপ আমিরকে বলল, অনুগ্রহ করে আপনি ভেবে দেখুন কী করবেন। ব্রিটিশদের পক্ষে থাকবেন নাকি আমাদের সাহায্য করবেন।

আমির বলল, আমরা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু বুঝতেই পারছেন আমরা একটু শান্তিতে থাকতে চাই। ব্রিটিশদের সাথে আমরা আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না।

মহেন্দ্র প্রতাপ ভাবল এতদূর এসে আসলে তেমন কোনো সুবিধা হলো না। এখন কৌশলে যা পাওয়া যায়, তাই লাভ। মহেন্দ্র প্রতাপ আমিরের দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আপনাদের এখানে আমাদের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী গৃহবন্দি অবস্থায় আছে।

কে ?

মৌলভি ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী।

নামটা মনে পড়ছে। ওনার সাথে আমার মনে হয় একবার কথা হয়েছে। উনি কি রেশমি রুমাল আন্দোলনের নেতা ?

জি। ওনাকে কি অন্তত ছেড়ে দেওয়া যায় ?

আমি একটু ভেবে আপনাকে জানাচ্ছি।

আমির সাহেব মহেন্দ্র প্রতাপের এই অনুরোধটি রাখল। তবে মহেন্দ্র প্রতাপ ক’দিনেই বুঝে গেছে, এই নির্লিপ্ত চেহারার আফগান আমির হয় খুব ভীরু প্রকৃতির অথবা মহা ধুরন্ধর। সম্ভবত সে ব্রিটিশদের টাকা অথবা হুমকি খেয়ে থিতিয়ে গেছে। এই আমির ভারতের স্বাধীনতায় কোনো সাহায্য করবে না, বরং উল্টো মিথ্যে কথা বলে বিপদে ফেলতে পারে। তার মানে আফগানিস্তানকে ভারত আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

এতদূর এসে পুরো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়া যায় না। এমন একটা কিছু করতে হবে যার অন্তত প্রতীকী মূল্য থাকে। বেশ ক’দিন সহযোগীদের সাথে আলাপ করে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ আফগানিস্তানে বসেই ভারতের প্রথম অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করল। আমির এই নখদন্তহীন সরকার গঠনে কোনো বাধা দিল না। মহেন্দ্র প্রতাপ নিজে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট। চেম্পাকরমণ পিল্লাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জেনারেল অস্কার রিটার বলল, অভিনন্দন! ১৯১৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে গেল। এটাই প্রথম অস্থায়ী ভারত সরকার।

অস্থায়ী ভারত সরকারের পাঁচজন সদস্যের তিনজনই মুসলমান। মৌলভি বকতুল্লাহ খান প্রধানমন্ত্রী, মৌলভি ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মৌলভি বশির যুদ্ধমন্ত্রী। এতজন মুসলমান সরকারে থাকার কারণ হলো, প্যান-ইসলামিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। মুসলমানদের খুশি করে জার্মানরা প্যান-ইসলামিক আন্দোলনকেও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছে।

অস্থায়ী সরকারের সবাই আফগানিস্তানে থেকে গেল। কিন্তু জার্মানরা কিছুদিন পরেই আফগানিস্তান ত্যাগ করল।

(চলবে)

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.