বাংলা গানে বন্ধুত্ব

বাংলা গানে বন্ধুত্ব

প্রেম-বিরহের সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে বন্ধুত্বের গুরুত্বও কম নয়। বাংলা গানের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে বন্ধুত্বের জয়গান। সেটা আধুনিক বাংলা গানে তো বটেই, বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও কোনো অংশে কম নয়।

বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক কালজয়ী বাংলা গান সৃষ্টি হয়েছে। ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে  নিও’ গানটি আজকের সৃষ্টি নয়। কালজয়ী এই গানটি আধুনিক সময়েও মানুষ তার পছন্দের তালিকায় রেখেছে। এমনকি বিশ্ব বন্ধু দিবসে গানটির শিরোনাম ব্যবহার করে এসএমএস আদান-প্রদান করে থাকে অনেকে। 

‘বন্ধু তোর বারাত দিয়ে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িতে গেলাম’, ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে’, ‘রসিয়া বন্ধুরে’ প্রভৃতি শিরোনামের গানগুলো বন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে  গাওয়া গানের জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক কালের বাংলা গানের ইতিহাসে বন্ধুকে নিয়ে গানের সংখ্যা নগণ্য। বাংলা গানের যে অংশ নিয়ে গর্ব করা যায়, তার বেশির ভাগই চলচ্চিত্রের গান। সাম্প্রতিককালে চলচ্চিত্রের গানের মান পড়ে যাওয়াই বন্ধুকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য গান সৃষ্টি না হওয়ার প্রধান কারণ।

অবশ্য রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গানেও বন্ধুর কথা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানে বন্ধুত্ব নানাভাবে প্রকাশিত। কিছু গানে বন্ধুর সান্নিধ্য ও আকুতি রয়েছে। আবার কিছু গানে বন্ধুত্বের সংকট ও বিচ্ছেদও ঠাঁই পেয়েছে।

‘বন্ধু রহো রহো গানে’Ñএই গানে বন্ধুকে সব সময়, পাশে থাকার জন্য আকুতি জানানো হয়েছে। ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে ? গানে বন্ধু-বিদায়ের বেদনা এবং স্মৃতি রামন্থন করা হয়েছে। আবার ‘পূজো’ পর্যায়ের গানে ঈশ্বরকেই বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন, বন্ধু তোমার বাণ নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়! মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো’; ‘মালা হতে খাগ-পরা ফুলের একটি দল’ গানে দেখতে পাই বলা হচ্ছে, ‘দাও গো মুছে আমার ভালে অপমানের লিখা’/নিভৃতে আজ, বন্ধু, তোমার আপন হাতের যেডা’; ‘বারে বন্ধু, ধীরে ধীরে/চলো তোমার বিজনমন্দিরে’; ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি/নিয়ে যাবি/কে আমারে/ ও বন্ধু আমার’; ‘লুকিয়ে আসো আঁধার রাতে, তুমি আমার বন্ধু।’ ইত্যাদি।

নজরুল সংগীতেও ‘বন্ধু’ শব্দটি নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বন্ধুত্বের গভীরতা, আবেগ এবং সম্পর্কের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করে। এটি শুধু সাধারণ বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রেমিক, দেশ কিংবা সৃষ্টিকর্তাকেও বোঝানো হয়েছে। যেমন একটি গানে দেখতে পাইÑ‘বন্ধু তোমার দুয়ার বন্ধ/বন্ধু তোমার অলক উড়া মনে পড়ে মনে পড়ে,/বন্ধু তোমার পুলকঝরা আজও আছে বক্ষে ঝরে।’

অন্যদিকে অতুল প্রসাদের বন্ধু-বিষয়ক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গান হলো, ‘ওগো দুঃখ সুখের সাথী’/ সঙ্গ দিন-রাত্রি’। এখানে বন্ধুকে দুঃ-সুখের সাথি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যে বন্ধুরূপে ‘ভব-মরু-প্রান্তর মাঝে’ শান্তির লোর বয়ে আনে। এছাড়া অন্যান্য গানেও অতুল প্রসাদ বন্ধুত্বের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করেছেন। যেমন, ‘বন্ধু, তুমি বন্ধুতার অজস্র অমৃতে,/পূর্ণপাত্র এসেছিল মর্ত্য ধরণীতে,’ ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্ত সেনের গানেও ‘বন্ধু’ শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। তবে রজনীকান্তের গানে ‘বন্ধু’ হিসেবে মূলত ঈশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে।

যা হোক, এখানে বন্ধুত্বের কয়েকটি জনপ্রিয় গানের কথা উল্লেখ করা হলো।

একটাই কথা আছে বাংলাতে...

বন্ধুত্বের গান খুঁজতে গেলে বাঙালির অন্তরে বেজে ওঠে ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে/ মুখ আর বুক বলে একসাথে/ সে হলো বন্ধু/ বন্ধু আমার’-কথায় সাজানো গানটি। ‘বন্ধু আমার’ চলচ্চিত্রের গান এটি। গানটির সুর-সংগীত করেছেন ভারতের জনপ্রিয় গায়ক বাপ্পি লাহিড়ি। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মুন্না আজিজ ও বাপ্পি লাহিড়ি। আর এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছেন জনপ্রিয় দুই চিত্রনায়ক ফারুক ও জাফর ইকবাল। আওকাত হোসেন পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। চলচ্চিত্রটির জনপ্রিয়তা জাফর ইকবাল দেখে যেতে পারেননি। মুক্তির দু’মাস মাস আগে তিনি মারা যান।

কফি হাউজের সেই আড্ডাটা...

যতিদন বন্ধুত্ব থাকবে, বন্ধুর কাছে বন্ধুর আবেদন থাকবে ততদিন বন্ধুত্বের দাবি তুলে হৃদয়ে হাহাকার জন্ম দিবে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ শিরোনামের গানটি। এটি গেয়েছেন মান্না দে। কথিা লিখেছেস গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুর করেছেন সুপর্ণ কান্তি ঘোষ।

শত্রু তুমি বন্ধু তুমি, তুমি আমার সাধনা...

বন্ধুত্বের চমৎকার এই গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী আবদুল জব্বার। গানের প্রথম লাইন হলো ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি, তুমি আমার সাধনা/ তোমার দেয়া আঘাত, আমায় দেয় যে মধুর বেদনা/ তুমি আমার সাধনা’। গানটি যৌথভাবে লিখেছেন ড. মো. মনিরুজ্জামান ও মাসুদ করিম। সুরকার ছিলেন সুবল দাস। ১৯৭৯ সালে গানটি ‘অনুরাগ’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক ও শাবানা।

বন্ধু তিন দিন...

আশির দশকে রুনা লায়লার গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গান ছিল ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম, দেখা পাইলাম না’। গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এর সুর ও সংগীতায়োজন করেন আলাউদ্দিন আলী।

চাইছি তোমার বন্ধুতা

ভারতের জনপ্রিয় গায়ক কবির সুমন। তার গাওয়া ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ গানটি বন্ধুত্বের দারুণ একটি গান। গানগুলোর কথা হলো ‘তোমায় আমি গড়তে চাই না, পড়তে চাই না/ কাড়তে চাই না, নাড়তে চাই না/ ফুলের মত পাড়তে চাইনা/ চাইছি তোমার বন্ধুতা....’

নিথুয়া পাথারে...

এই গানটি ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের হাত ধরে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর কথা ও সুর সগৃহিত। ছবির গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু। পর্দায় গানটির সঙ্গে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। ছবিতে নতুন করে গানটির সংগীতায়োজন করেছেন অর্ণব ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ইকবাল এ. কবির।

তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও...

গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী জেমস। গানের প্রথম কথা হলো ‘তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে বন্ধু আমার/ তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে পথ ভোলা/ তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও মুছিয়ে দেব দুঃখ সবার/ তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও মুছিয়ে দেব দুঃখজ্বালা।’

বন্ধু সে জন...

চমৎকার কথার এই গানটি গেয়েছেন প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। লিখেছেন সেলিম কামাল ও সুর করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। এটিও বন্ধু নিয়ে শ্রোতাপ্রিয় একটি গান।

দেখা হবে বন্ধু...

বাংলা গানে বন্ধুত্বের আবেগে দারুণ এক সংযোজন ‘দেখা হবে বন্ধু’ শিরোনামের গানটি। এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন পার্থ বড়ুয়া। এর কথা লিখেছেন বেল নুর, সুর করেছেন পার্থ বড়ুয়া। এটি ‘দেখা হবে বন্ধু’ অ্যালবামের গান। এর কথাগুলো ছিলো ‘দেখা হবে বন্ধু কারণে আর অকারণে/ দেখা হবে বন্ধু চাপা কোনো অভিমানে/ দেখা হবে বন্ধু সাময?িক বৈরিতায় অস্থির অপাগরতায়...’

বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষণ...

গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া। গানটির কথা ও সুর করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। গানটি পার্থ বড়ুয়ার দেবী অ্যালবামে প্রকাশ হয়েছিল। গানের প্রথম লাইন হলো ‘একলা ঘর, ধুলো জমা গিটার পড়ে আছে লেলিন, পড়ে আছে শেকসপিয়র, টি-শার্ট জিন্সগুলো দেরাজে আছে, শুধু মানুষটা তুই নেই তো, নেইরে কাছে, ও বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষণ, তোকে ছাড়া কিছুই আর জমে না এখন’।

তুমি আমার পাশে বন্ধু হে...

গানটি গেয়েছেন কনক ও কার্তিক। গানের প্রথম কথা হলো ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো! আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি, তুমিও থাকো বন্ধু হে, বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো!’ গানটি ‘নিয়ন আলোয় স্বাগতম’ অ্যালবামে প্রকাশ পেয়েছিল।

এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে সকাল-বিকেল বেলা...

বন্ধুকে নিয়ে গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী সায়ান। গানের প্রথম কথা হলো ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে সকাল-বিকেল বেলা, কত পুরোনো নতুন পরিচিত গান গাইতাম গলা খুলে। কত এলোমেলা পথ হেঁটেছি দুজন, হাত ছিল না তো হাতে’।

যে পথে চলেছ বন্ধু...

গানটি গেয়েছে ওয়ারফেজ। গানের প্রথম কথা হলো ‘যে পথে চলেছ বন্ধু/ সে পথে হারাবে যে সত্তা,/ মায়াবী আলোর প্রতারণায় মোহিত, আঁধারে তুমি, কত প্রেমের বসন্ত, কত বৃহৎ দিগন্ত, এত সুখের তাড়নায়, যে যাও হারিয়ে, কীভাবে ভুলেছ বন্ধু পুরোনো দিনের সেই কথা’।

বন্ধু...

গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী তপু। গানের প্রথম কথা হলো, ‘পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিক, সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক, তোরা ছিলি তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি, বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কী লাগে?’ গানটি তপুর ‘সে কে’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছিল।

বন্ধু তোমার চোখের মাঝে চিন্তা খেলা করে

গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম। গানের প্রথম কথা হলো, ‘বন্ধু তোমার চোখের মাঝে চিন্তা খেলা করে, বন্ধু তোমার কপালজুড়ে চিন্তালোকের ছায়া, বন্ধু তোমার নাকের ভাঁজে চিন্তা নামের কায়া/ বন্ধু আমার মন ভালো নেই, তোমার কি মন ভালো ?

‘বন্ধু তুই আমার ভোরে আয়’ শিরোনামে গানটি গেয়েছেন চিরকুট ব্যান্ড। ২০১০ সালে চিরকুট ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘চিরকুটনামা’তে এই গান প্রকাশ হয়েছিল। গানটি প্রকাশ হওয়ার পর বেশি জনপ্রিয়তা না পেলেও এখন এই গান শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.