[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধÑসব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এমনকি সংস্কৃতিতেও। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]
৩১) জ্ঞানদানন্দিনী (১৮৫২-১৯৪১) : রবীন্দ্রঅগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার এবং বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার পথিকৃৎ। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়। ঠাকুরবাড়িতেই তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শেখেন। জ্ঞানদানন্দিনী প্রথম ভারতীয় বাঙালি নারী, যিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন স্বামীর কর্মস্থলে।
সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফেরার পর তাঁর কর্মস্থল মহারাষ্ট্রে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পিতার অনুমতি প্রার্থনা করলে বাড়িতে ধিক্কার পড়ে যায়। এব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অটল। শেষ পর্যন্ত পিতার অনুমতি নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ শুরু করেন যাত্রার আয়োজন। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল, জ্ঞানদানন্দিনী বাইরে যাবেন কী পোশাকে ? কেননা, সেকালের মেয়েরা বাড়িতে একখানা শাড়ি পরে থাকত। এমন বেশে জ্ঞানদানন্দিনী বাইরে যাবেন কী করে ? অবশেষে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্য তখনকার মতো ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে বানানো হয় ‘ওরিয়েন্টাল ড্রেস’। পরাও কষ্ট। জ্ঞানদানন্দিনী নিজে তা পরতেই পারলেন না। ওই পোশাক পরেই তৈরি হলেন। প্রথমবারের এই পোশাক সমস্যা জ্ঞানদানন্দিনীকে বিব্রত করেছিল বলেই পরবর্তী সময়ে তিনি মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। স্বামীর কর্মস্থল বোম্বাই থাকাকালে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শাড়ি ও জামার নমুনার নানারকম পরিবর্তন করেন।
গুজরাটি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ডান কাঁধের বদলে বাম কাঁধে আঁচল নিয়ে শাড়ি পরার প্রচলিত যে রূপটি আমরা আজকের দিনে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান মেয়েদের দেখি তা জ্ঞানদানন্দিনীরই আবিষ্কার। শাড়ির নিচে সায়া, শেমিজ, জামা ব্লাউজ পরার চলটি জ্ঞানদানন্দিনীই অবিভক্ত বাংলাদেশে প্রবর্তন করেছেন।
জ্ঞানদানন্দিনী একাই গিয়েছিলেন তাঁর শিশুসন্তানদের নিয়ে বিলেতে। সে যুগে এই কাজটি খুব সহজ ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত থেকে ফিরে বিকেলে বেড়াতে বেরোনো এবং নিজের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় প্রথাটি নিজের পরিবারে প্রথম প্রচলন করেন। সেখান থেকে অখণ্ড বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে জন্মদিন পালন করার আনুষ্ঠানিক প্রথাটি। জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহেই প্রথম রবীন্দ্র-জন্মোৎসাব পালিত হয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪৯নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। পত্রিকা প্রকাশ, প্রবন্ধ রচনা, রূপকথাকে নাট্যরূপ দেওয়া, অভিনয় এসব কাজে জ্ঞানদানন্দিনী পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।
৩২) চন্দ্রমুখী বসু (১৮৬০-১৯৪৪) : নারীশিক্ষা ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। চন্দ্রমুখী তার পড়াশোনার বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেকর্ড করেন। তিনি যখন বিএ, এমএ পাস করেছিলেন, তখনো অধিকাংশ মেয়ে পড়ালেখা করে না। বড়জোর ঘরে মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। কেবল মুষ্টিমেয় মেয়ে স্কুলে যায় তখন। চন্দ্রমুখী বসু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী এম.এ (১৮৮৪ সাল)। তিনি ও কাদম্বরী বসু নারীদের মধ্যে সবচেয়ে আগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। চন্দ্রমুখীর পিতার নাম ভুবনমোহন বসু। পরিবারটি দেরাদুনের এক খ্রিষ্টান পরিবার। চন্দ্রমুখী বসুর দুই অনুজা বিধুমুখী ও বিন্দুবাসিনী। এঁরা উভয়েই পরে মেডিকেল কলেজে পড়েছেন এবং তারাও পড়াশোনায়, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজে নারীদের মধ্যে অন্যতম প্রথম ছাত্রী। ডাক্তারি পাস করলেও রোগীদের প্রভূত উপকার করতে, মানে অব্যাহতভাবে প্রাকটিস করার সুযোগ পান নি ভগ্নীযুগল। আর সেটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন এবং রীতিনীতির জন্যে। চন্দ্রমুখী দেরাদুন নর্মাল স্কুল থেকে ১৮৭৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার অনুমতি পান। তিনি নর্মাল স্কুল থেকে ১৮৮১ সালে এফ.এ পাস করেন। ১৮৮৩ সালে বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৮৮৪ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ পাস করেন। বেথুন কলেজে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে প্রথম চাকরি করেন। পরে সেই কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ আসে। বেথুন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হলে ১৮৮৬ সালে তিনি প্রথম সেই কলেজের অধ্যক্ষা হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮৮৬-১৯০১ সাল পর্যন্ত বেথুন কলেজে অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করে রাখেন। ১৯০১ সালে অবসর গ্রহণ করে আবার দেরাদুন যান। চন্দ্রমুখীর স্বামীর নাম কেশবানন্দ মমগায়েন। অবসর জীবন ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেরাদুনে কাটে। চন্দ্রমুখী রসরাজ অমৃতলালের খুড়তুতো বোন। চন্দ্রমুখী বসু, বাংলার প্রথম এম.এ, প্রথম উচ্চশিক্ষিত নারী যিনি প্রথম বেতনসহ চাকরি করেন কোনো কলেজে (বেথুন কলেজ)। প্রথমে কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্র্রেশনে কাজ করলেও পরে বেথুন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সর্বশেষে বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা হন। তিনিই দক্ষিণ এশীয় কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহিলা অধ্যক্ষা।
৩৩) চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০) : বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের একমাত্র আদরের কন্যা চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম সুলোচনা। অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি খনা, দ্বিতীয় কবি রামী বা রজকিনী, তৃতীয় মাধবী এবং চতুর্থ কবি চন্দ্রাবতী। প্রথম নারী কবি হিসেবে চন্দ্রাবতীর যে সম্মান, তা বাংলাদেশে। পুরো বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান চতুর্থ। তখনকার দিনে চন্দ্রাবতীর মতো উঁচু মাপের নারী কবির আর অস্তিত্ব ছিল না। তাঁর রচনাগুলোর মধ্যে—‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ও ‘রামায়ণ কথা’ অন্যতম। ‘রামায়ণ কথা’ যা তিনি পিতার পরামর্শে বাংলাতে লিখতে শুরু করেছিলেন, এক ভিন্ন ধরনের রামায়ণ। এটি মূল রামায়ণের অনুবাদ নয়। বরং নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এই রামায়ণে সীতার প্রতি অবিচার এবং তার মর্মবেদনা অত্যন্ত দরদের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। চন্দ্রাবতীর স্বহস্তে লিখিত রামায়ণের পাণ্ডুলিপিটি এখনো সযত্নে রক্ষিত রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘মৈয়মনসিংহ গীতিকা’য় তাঁর কথা পাওয়া যায়। তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাথা ‘চন্দ্রাবতী’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে।
৩৪) জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪) : শহীদ জননী জাহানারা ইমাম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন । বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্যে তিনি ১৯৮৮ সালে ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যান এবং ১৯৬৬ সালে দেশে ফেরেন। ১৯৯১ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার বড়পুত্র ও স্বামীকে প্রায় একত্রে হারাবার পরেও সমগ্র প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল, বিবেকবান মানুষকে একটি ব্যানারের নিচে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি শুধু শহীদ রুমির মাতা ছিলেন না, রাতারাতি সকল মুক্তিযোদ্ধদের মাতা বনে গেছিলেন। বিশেষ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের।
৩৫) জোবেদা খাতুন চৌধুরানী (১৯০১-১৯৮৬) : সিলেটের রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজনীতিবিদ জোবেদা খাতুন। সমাজের প্রবল প্রতিরোধে স্কুলে বেশি দিন পড়ার সুযোগ পান নি। খানবাহাদুর আবদুর রহিম চৌধুরীর সঙ্গে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়। ১৯২৮ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। কাজী নজরুল ইসলাম, এ কে ফজলুল হক, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সিলেটে গেলে তাঁদের যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, জোবেদা খাতুন প্রথম বোরকা ছেড়ে সেই সভায় যোগ দেন। কংগ্রেসের উদ্যোগে যে আইন অমান্য, লবণ আইন আন্দোলন ও বিদেশি জিনিস বর্জনের আন্দোলন গড়ে ওঠে, জোবেদা তাতেও যোগ দেন। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই নারী সামাজিক সব বাধা অতিক্রম করে সিলেটের মণিপুরী কৃষকদের আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। জোবেদা খাতুন ও সরলাবালা দেব-এর সঙ্গে যুগ্ম নেতৃত্বে এক অভিনব উপায়ে পিকেটিং করতেন সিলেট মহিলা সংঘের কর্মীরা। পিকেটিংরত একদল মহিলাদের ধরে নিয়ে গেলে অন্যদল এসে পিকেটিং করেন। দেশবিভাগের পর যখন হিন্দুরা ভারতে চলে যান, তখন সিলেট মহিলা কলেজসহ বহু সরকারি কলেজকে ছাত্রীর অভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সরকার। জোবেদা খাতুন গভর্নরের কাছে এক বছর সময় ভিক্ষা নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়ে ছাত্রী জোগাড় করে সিলেট মহিলা কলেজটিকে বাঁচিয়ে রাখেন। ১৯৪৮ সালে সিলেট মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে মহিলারা, সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আবেদন জানান। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে জোবেদা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আইন পরিষদ নির্বাচনে যোগ দেন। কিন্তু তিনি জয়ী হন নি। ১৯৭০ সালে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন।
৩৬) জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী (১৮৮৯-১৯৪৫) : বাংলার প্রথম ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুশিক্ষিতা কন্যা জ্যোতির্ময়ী দেবী বিক্রমপুরের মেয়ে। তাঁর পিতা নারীর সামাজিক নিপীড়ন বন্ধের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন। জ্যোতির্ময়ী আমরণ স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে নারী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর অধিনায়কত্ব দেন। একনিষ্ঠ কংগ্রেসকর্মী হিসেবে নানা সংস্থা ও সমিতিতে যোগ দিয়ে কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করেন। ১৯৩০ সালে নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সভানেত্রী হয়েছিলেন। ১৯৩০-৩২ সালে কারারুদ্ধ ছিলেন আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্যে। ১৯৩৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত অন্ডারম্যান জ্যোতির্ময়ী দেবী। আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি নায়কদের মুক্তির দাবিতে ১৯৪৫ সালের ২২ নভেম্বর যে ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রা বের হয়, তাতে মিলিটারি ট্রাকের পরিকল্পিত ধাক্কায় নিহত হন জ্যোতির্ময়ী দেবী। ওইদিন পুলিশ ও মিলিটারির গুলিবর্ষণে আরও অনেক ছাত্র নিহত হয়।
৩৭) জ্যোতির্ময়ী দেবী (১৮৮৯-১৯৪৫) : বিশিষ্ট বাঙালি লেখক। প্যারীচরণের একখানি বই আর বিদ্যাসাগরের পাঁচখানি পাঠ্যবই পড়ার পরেই বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর অল্পদিনের মধ্যেই বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। সেখানে সমবয়সীদের সাহায্য নিয়ে নিজ চেষ্টায় আরও লেখাপড়া বিশেষ করে ইংরেজি শেখেন। নারীর বিভিন্ন সমস্যা ও নারীর অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ও মুখর জ্যোতির্ময়ী নারী-বিষয়ে বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতা লিখে সেই সময়কার লেখক, চিন্তাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর লেখা ১৮/২০টি প্রকাশিত বই সেই সময় চারদিকে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। কঠিন এবং নিষ্ঠুর সত্য ও তথ্য অতি সহজ ভাষায় বলার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি গান্ধীজির অনুসারী ছিলেন। সর্বভারতীয় মহিলা সংগঠনসহ অওডঈ-তে তিনি সহ-সভানেত্রী ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে ছায়াপাত, মনের গোচরে, এপার বাংলা ওপার বাংলা ও আত্মজীবনী স্মৃতি-বিস্মৃতির তরঙ্গ উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বহু লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, প্রবঞ্চিত নারীর কথা এতে মিশে আছে। যারা আমাদের ঘরের কোণে কোণে আছে। কত ভদ্র মনে কু শান্ত ধৈর্যে বহু আশায় নিজেদের কথা লুকিয়ে রাখে, কেউ কাউকে বলে না। বলতে পারে না। মনে অনুভব করে, তাদের রক্ত মাংসে শিরায় শিরায় সে কথা লুকানো আছে। এবং সে যা একদিন চূর্ণ টুকরো হয়ে যায়। আর তাদের অপ্র অন্তঃপুরের ওই সব নিঃশব্দ অনাচার অবিচার পুরুষেরা, অন্য পরিজনা কি জানেন ? জানতে পারেন ? অথবা জেনেও জানেন না। কিংবা গুরুজনের ভয়ে নীরব থাকেন। হয়তো তাই। কে বলতে পারে কী জন্য! আর আজ আশ্চর্য হয়ে শিখলাম, দেখলাম, দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের সব উক্তি সব কথাই সত্য, সব কটুক্তিই সত্য। আমরা সত্যি বলি না। মেয়েরা সতী হন, কিন্তু সত্যশীলা, সত্য ভামিনী, সত্যবতী নন। হতে পারেন না।’
৩৮) তরু দত্ত (১৮৫৬- ১৮৭৭) : তরু দত্ত ও অরু দত্ত (১৮৫৪-৭৮) দুই বোন। পিতা গোবিন্দচন্দ্র খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সুশিক্ষা, উন্নত রুচি ও মানস গঠনের জন্যে তিনি দুই কন্যাকে খুব ছোটবেলায় (১৮৬৯ সালে) ফ্রান্স, ইতালি ও ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন। তাঁরাই সম্ভবত প্রথম বাঙালি নারী উচ্চ শিক্ষার্থে যাঁরা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে যান। তাঁরাই বাঙালি নারীদের ভেতর প্রথম যাঁরা ইংরেজি ও ফরাসিতে কবিতা রচনা করেন। তরু দত্ত অনেক ফরাসি কবিতা ও লেখা অনুবাদ-ও করেন। দুজনেরই অকাল মৃত্যু হয়। তরুর অধিকাংশ মৌলিক কবিতা ও ফরাসি থেকে অনূদিত কবিতা ও রচনা তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় এবং পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তরু দত্তের লেখা বই ঔড়ঁৎহধষ ফব গধফবসড়রংবষষব ফ’অৎাবৎং, (১৮৭৯) ফরাসি ভাষায় কোনো বাঙালির লেখা প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস এবং ইরধহপধ, ড়ৎ ঃযব ণড়ঁহম ঝঢ়ধহরংয গধরফবহ, (১৮৭৯) ইংরেজিতে লেখা কোনো বাঙালি নারীর প্রথম উপন্যাস।
৩৯) তাহেরুন্নেসা বিবি (১৯/২০ শতাব্দী) : তাহেরুন্নেসা প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী গদ্যলেখক। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রণী লেখিকা, কলকাতার ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় লিখতেন। দিনাজপুরের বোদা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর লেখা ‘বামাগণের রচনা’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায়। এই রচনায় তিনি নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত কুণ্ঠাহীনভাবে ব্যক্ত করেছেন। নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
৪০) তৃপ্তি মিত্র (১৯২৫-১৯৮৯) : বাংলা নাট্যজগতের মুকুটহীন রানি। তৃপ্তি মিত্র এক কিংবদন্তি অভিনেত্রীর নাম। কিন্তু তাঁর মেধা ও মনন কেবল অভিনয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না, নাট্যজগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত প্রখর। পারদর্শিতা ছিল অসাধারণ। বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আধুনিক বাংলা নাটকের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তৃপ্তি মিত্র ও তাঁর স্বামী শম্ভু মিত্র। বাংলার প্রতিটি নাট্যামোদী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁদের। অনেকটা গুরুর মতো ছিলেন দুজন উৎসাহী, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ নাট্যব্যক্তিত্ব। আর সেটা সকল নবাগত নাট্যামোদীদের কাছেই। তৃপ্তি মিত্র ও শম্ভু মিত্রের একমাত্র কন্যা শাঁওলী মিত্রও খুব উঁচু মাপের অভিনেত্রী। তৃপ্তি মিত্রের একক অভিনয় দর্শকের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে এবং এটা নতুন এক ধারার সৃষ্টি করে। দুই উঁচু মাপের শিল্পীর গৃহস্থালিতে সাধারণত যা হয়, এমন একটা সময় আসে যখন পারস্পরিক প্রচণ্ড নির্ভরতা ও শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও একসঙ্গে বসবাস করা সম্ভব হয় নি তাঁদের। তৃপ্তি মিত্রের শেষ জীবনে কন্যা ছাড়া পাশে কেউ তেমন ছিলেন না। তবে ব্যক্তিগত জীবন যেভাবেই চলুক না কেন থিয়েটারের স্বার্থে শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্র সারা জীবন পাশাপাশি যৌথভাবে কাজ করে গেছেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.