ধারাবাহিক রচনা নায়করাজ রাজ্জাক (পর্ব-৮)

ধারাবাহিক রচনা  নায়করাজ রাজ্জাক  (পর্ব-৮)

[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।

চলচ্চিত্রে জুটিÑএই বিষয়টি নতুন নয়। বরং এখন এ মাধ্যমটিতে নানা ধরনের জুটি দেখা যায়। এর মধ্যে নায়ক-নায়িকার জুটি অনেক আগে থেকে প্রচলিত। ...নায়ক-নায়িকার জুটি ব্যবসায়িক কারণেই গড়ে ওঠে। তবে এটি তৈরি করা যায় না, হয়ে যায়। অর্থা দর্শকই জুটির স্রষ্টা।

প্রতিটি মানুষের মাঝেই অপূর্ণতা রয়েছে; রয়েছে সীমাবদ্ধতা। সে অতৃপ্তিতে ভোগে। মানস-পুরুষ বা মানসীকে খুঁজে বেড়ায়। তাই চলচ্চিত্রের কোনো নায়ক কিংবা নায়িকার হাবভাব, চুল, পোশাকসহ নানা কিছু দ্বারা সে প্রভাবিত হয়। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন বা কামনা-বাসনা পূরণ করতে চায় প্রিয় নায়ক-নায়িকার মাধ্যমে।

জুটির একটি মায়াবী আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণের টানে প্রিয় জুটির চলচ্চিত্র দেখে দর্শকরা। ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যের ক্ষেত্রে জুটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে টালিউডে নির্মিত ‘প্রাক্তন’ ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হয়েছে। এক্ষেত্রে ছবির গল্প, পরিচালক জুটির কারিশমা তো রয়েছেই পাশাপাশি প্রসেনজি ও ঋতুপর্ণার কেমিস্টিরও একটি ভূমিকা আছে। কেননা বহু বছর পর এই ছবিতে প্রসেনজি ও ঋতুপর্ণা অভিনয় করেছেন। অতীতে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের বহু ছবিও হিট হয়েছে তাদের অনন্যসাধারণ রসায়নের দরুন।

যাহোক, রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি গড়ে উঠেছিল পাঁচজনের। তারা হলেন কবরী, সুচন্দা, সুজাতা, শাবানা ও ববিতা। এখানে এই পাঁচটি জুটির কথা উল্লেখ করা হলো।

রাজ্জাক-কবরী

উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনের পর বাংলা চলচ্চিত্রে আরেকটি সেরা জুটি হচ্ছে রাজ্জাক-কবরী। গত শতকের ষাট দশকের মাঝামাঝি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাসায় দুজনের প্রথম আলাপ। গাজী মাজহারুল আনোয়ার সেদিন তাদের তার পরিকল্পিত চলচ্চিত্র ‘যোগাযোগ’-এ অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন। দুজন সম্মতিও জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি আর হলো না। পরে তারা অভিনয় করেন সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’-এ। যদিও প্রথম মুক্তি পায় ‘নিশি হলো ভোর’ ছবিটি। তখন ১৯৬৮ সাল। তারপর মুক্তি পায় ‘বাঁশরী’। তবে এই জুটি লাইমলাইটে আসে কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ মুক্তির পরে। ছবিটি অভাবনীয় ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করে। রাজ্জাক-কবরীকে দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে তাদেরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।

রাজ্জাক-কবরী জুটির উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে—আবির্ভাব, ময়নামতি, নিশি হলো ভোর, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, কত যে মিনতি, ক খ গ ঘ ঙ, আঁকাবাকা, দর্পচূর্ণ, দীপ নেভে নাই, কাঁচ কাটা হিরে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, রংবাজ, অনির্বাণ, বেঈমান, অবাক পৃথিবী, ত্রিরত্ন, গুণ্ডা, অধিকার, স্মৃতিটুকু থাক, কাঁচের স্বর্গ, পরিচয়।

নানা ছবিতে নানা চরিত্রে রাজ্জাক-কবরী এমনভাবে একাত্ম হয়ে যেতেন যে দর্শকদের মধ্যে এই বোধ সঞ্চারিত হতো ‘দে আর মেড ফর ইচ আদার’। গ্রামীণ পটভূমির ছবি ‘ময়নামতি’তে গ্রামের উচ্ছল-চঞ্চল ময়নার ভূমিকার কবরী এবং শহর ফেরত উচ্চশিক্ষিত মতির ভূমিকায় রাজ্জাক চমৎকার অভিনয় করেন। ‘নীল আকাশের নিচে’-তে ধনী অভিজাত পরিবারের মেয়ে কবরী আর রাজ্জাক নিম্নমধ্য পরিবারের এক গাড়িচালকের ছোটভাই; ‘ক খ গ ঘ ঙ’-তে রাজ্জাক গ্রামের দুরন্ত চঞ্চল এক ছেলে আর কবরী বড়বোনের বাড়িতে আশ্রিতা এক তরুণী; ‘কত যে মিনতি’-তে কবরী নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুণী—যে রাজ্জাকের প্রেম নিবেদনে সাড়া দেয় না; কেননা রাজ্জাকের গাড়ির নিচে চাপা পড়েই মারা যান তার বাবা। ‘দর্পচূর্ণ’-তে কবরী অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে এবং রাজ্জাক তাদের বাড়ির কাজের লোকের ছদ্মবেশে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়ে।

রাজ্জাক-কবরী জুটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণই রয়েছে। যেমন শারীরিক দিক থেকে তারা মানানসই ছিলেন। দুজনই দীর্ঘাকৃতির নন। দুজনের চেহারাতেই বাঙালি রমণী বা পুরুষের এমন ছায়া রয়েছে—যার সঙ্গে সহজেই দর্শকরা একাত্ম হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে রাজ্জাক-কবরীর মধ্যে বেশ আন্ডারস্টেন্ডিং ছিল একজন আরেকজনকে ভালো বুঝতে পারতেন। ফলে রোমান্টিক দৃশ্যে তাদের অভিনয় হতো দারুণ আবেদনময়। তাছাড়া কবরীর সুন্দর চোখ, বিশেষত স্নিগ্ধ হাসি দর্শকদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল।

পেশাগত সম্পর্কের বাইরেও রাজ্জাক-কবরীর মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল। বন্ধুত্ব ছিল। এই সম্পর্ক তাদের পারফরমেন্সে ছায়া ফেলেছিল।

১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে রাজ্জাক-কবরী জুটিতে ভাঙন ধরে। যদিও ১৯৭৭ সালে কাজী জহির একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই জুটিকে নিয়ে কাজ করবেন বলে। ‘বধূ বিদায়’ ছবিতে তাদের কাস্ট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সফল হন নি। সেই ছবিতে তাই রাজ্জাকের পরিবর্তে বুলবুল আহমেদকে দেখা গেছে।

রাজ্জাক-কবরী জুটি ভাঙার পিছনে দুজনের ছিল দুধরনের অভিমত। কবরীর ভাষ্য হচ্ছে: ‘স্বাধীনতার পর ভারত থেকে দেশে আসার পর দেখি, সব বদলে যাচ্ছে। যে ছবিতে আমি ও রাজ্জাকের একসঙ্গে থাকার কথা ছিল, সেখানে নাকি আমি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, রাজ্জাক আমার বদলে অন্যদের নিতে বলেছেন।’

এ প্রসঙ্গে রাজ্জাকের কথা হলো, “কবরীকে নিয়ে কিন্তু আমি আমার নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকেই ‘রংবাজ’ বা ‘বেঈমান’ ছবিগুলো বানিয়েছি। হঠা শুনলাম, কবরী বিয়ে করতে চলেছেন। আমি তাকে বন্ধুর মতো পরামর্শ দিয়ে বললাম, এখন আপনার ক্যারিয়ার তুঙ্গে। বিয়েটা কি এক্ষুণি করতে হবে ? কবরী বোধহয় তার ব্যক্তিগত জীবনে আমার পরামর্শকে হস্তক্ষেপ মনে করলেন। তাই বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে যে-কোনো ঘটনার পেছনেই আমার উপস্থিতি খুঁজতে লাগলেন। আমি তার ভুল ভাঙাতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি।” দুজনের সম্পর্কের বরফ গলতে সময় লাগল পঁচিশ বছর। ২০০৪ সালে তারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন ‘আমাদের সন্তান’ ছবিতে, বয়স্ক বাবা-মার ভূমিকায়।

 

রাজ্জাক-সুচন্দা

রাজ্জাকের প্রথম নায়িকা সুচন্দা। প্রথম ছবি ‘বেহুলা’-র বেহুলা। ছবিটি দেশব্যাপী রাজ্জাক-সুচন্দাকে পরিচিত করে তোলে। জনপ্রিয় তো বটেই। মজার ব্যাপার হলো, সনাতন ধর্মাবলম্বী কোনো কোনো মানুষ রাজ্জাক-সুচন্দাকে দেবদেবীর মতোই দেখত, সম্মান জানাত। ‘আনোয়ারা’র শুটিংয়ের সময় তাদের একনজর দেখার জন্য এত মানুষ ভিড় জমিয়েছিল যে, একপর্যায়ে শুটিং করাই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।

এই জুটির উল্লেখযোগ্য ছবি হলো—বেহুলা, আনোয়ারা, দুইভাই, সুয়োরানী দুয়োরানী, কুঁচবরণ কন্যা, মনের মত বউ, সখিনা, জুলেখা, যোগ-বিয়োগ, যে আগুনে পুড়ি, সংসার, প্রতিশোধ, জীবন সঙ্গীত, অশ্রু দিয়ে লেখা, জীবন থেকে নেয়া।

এই জুটি আসলে স্বাধীনতা পূর্বকালে জনপ্রিয় ছিল। ‘প্রতিশোধ’ স্বাধীনতার পরে মুক্তি পেলেও এটির নির্মাণ কাজ স্বাধীনতার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। আর ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’র মূল নায়িকা সুজাতা, সুচন্দা নন। যাহোক এই জুটির গ্রহণযোগ্যতার একটি কারণ হলোÑবেহুলার ক্রেজ। তাই লোকছবি থেকে সামাজিক ছবিতে অভিনয়  করলেও রাজ্জাক-সুচন্দাকে সাদরেই দর্শক গ্রহণ করেছিল। আরেকটি কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জহির রায়হান পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রেই এই জুটিকে দেখা গেছে। আর স্বাধীনতা উত্তরকালে এই জুটিকে যে তেমন দেখা যায় নি, তার কারণ হলো প্রযোজক-পরিচালকরা তাদের নির্বাচিত করেন নি। এছাড়া তখন সুচন্দার জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, স্বামী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হন হঠা নিখোঁজ হওয়ায়। ফলে চলচ্চিত্রে কাজের ব্যাপারে তিনি তখন পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন নি।

 

রাজ্জাক-সুজাতা

সুচন্দার পরে রাজ্জাক অভিনয় করেছিলেন সুজাতার সঙ্গে,             ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে। ভারতীয় একজন লেখকের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি সুপারহিট হয়। প্রযোজক পরিচালকরাও বুঝতে পারেন যে, নায়ক-নায়িকা হিসেবে রাজ্জাক-সুজাতার গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাই নারায়ণ ঘোষ মিতা ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে তাদের নির্বাচিত করেন। এই ছবিটিও দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পরে এই জুটি অভিনয় করেন ‘প্রতিনিধি’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘আপনজন’-সহ কয়েকটি ছবিতে। এরপর সুজাতা চলচ্চিত্র জগ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তাই রাজ্জাক-সুজাতাকে কোনো চলচ্চিত্রে দেখা যায় নি। তবে সুজাতা নিজের পরিচালিত ‘অর্পণ’-এ নায়ক হিসেবে রাজ্জাককেই নিয়েছিলেন। ছবিটি ছিল দুইবোনের গল্প। দুইবোনই ভালোবাসে রাজ্জাককে। কিন্তু বড়বোন তার ভালোবাসা প্রকাশ করে না। এখানে বড়বোন  সুজাতা এবং ছোটবোনের ভূমিকায় ববিতা অভিনয় করেছিলেন। তবে নির্মাণে দুর্বলতা ছিল বলে ছবিটি দর্শকরা গ্রহণ করে নি।

 

রাজ্জাক-শাবানা

শাবানার বিপরীতে রাজ্জাক প্রথম অভিনয় করেন ‘পায়েল’ (১৯৭০) ছবিতে। শাবানা তখন উর্দু ছবিই করছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তাকে আনেন রাজ্জাক। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাকের ভাষ্য হলো: ‘পায়েল নামে একটি ছবি করার সময় একদিন শাবানা দুঃখ প্রকাশ করেন আমার কাছে। বাংলা ছবিতে তিনি সুযোগ পাচ্ছেন না। আমি যেন তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করি। সুলতানা জামান তখন ছদ্মবেশি নামে একটি ছবি করবেন। নায়ক যথারীতি আমি। নায়িকা হিসেবে কবরী অথবা অন্য কাউকে ভেবেছিলেন তারা। আমিই এই ছবিতে শাবানাকে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। সুলতানা জামান প্রথমে আপত্তি তোলেন। তিনি বলেন, শাবানা উর্দু ছবির নায়িকা। বাংলা ছবিতে তাকে মানাবে না। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার কথার গুরুত্ব দিয়েছেন, যেহেতু আমি তখন ছবির নায়ক হিসেবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছি। সে কারণে আমার কথা ফেলতে পারে নি।’ রাজ্জাক-শাবানার ‘ছদ্মবেশী’ কিন্তু সুপারহিট হয়েছিল। এই সময় শাবানা-রাজ্জাককে কাস্ট করে স্বনামধন্য পরিচালক কাজী জহির নির্মাণ করলেন ‘মধুমিলন’ (১৯৭০)। সামাজিক ও রোমান্টিক এই চলচ্চিত্রটি হিট হয়। তবে রাজ্জাক-শাবানা জুটির ভিত শক্ত হয় স্বাধীনতার পরে, কাজী জহিরেরই অমর সৃষ্টি ‘অবুঝ মন’ মুক্তির পরে। ছবিটি সুপারহিট হয়। পরে এই জুটি অভিনয় করেনÑ ঝড়ের পাখি, সাধু শয়তান, ভাইবোন, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, আগুন, অমর প্রেম, অভিমান, মহানগর, মায়ের আঁচল, ছুটির ঘণ্টা, মাটির ঘর, অলংকার, অনুরাগ, সখি তুমি কার, পুত্রবধূ, দুই পয়সার আলতা, রজনীগন্ধা ইত্যাদি চলচ্চিত্রে।

রাজ্জাক-শাবানা জুটির সফলতার পেছনে কারণ হলো, তাদের পরস্পরের মধ্যে চমৎকার সমঝোতা ছিল। ভীষণ প্রফেশনাল ছিলেন তারা। অবশ্য পেশাদারিত্বের পাশাপাশি তাদের মধ্যে মানবিক দিকও ছিল। তাইতো শাবানা প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাটির ঘর’-এর পারিশ্রমিক রাজ্জাক পরে নিয়েছিলেন, যাতে শাবানার কোনো অসুবিধা না হয়।

 

রাজ্জাক-ববিতা

ববিতার প্রথম ছবি ‘সংসার’ (১৯৬৮)। জহির রায়হান প্রযোজিত এই ছবিতে তিনি রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন সাজ্জাদ হোসেন। তখন তার নাম ছিল সুবর্ণা। পরে তিনি অভিনয় করেন জহির রায়হান পরিচালিত উর্দু ছবি ‘জ্বলতে সুরুজ কে নিচে’-তে। এখানে সুবর্ণা থেকে হন ববিতা। নায়ক নাদিম। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত ছবিটি মুক্তি পায় নি। ফলে ববিতাকে নায়িকা করে জহির আরেকটি ছবির প্রযোজনা করেন— ‘শেষ পর্যন্ত’। এরপর এতেশাম পরিচালিত ‘পিচঢালা পথে’-য়েও ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন রাজ্জাক। বাবুল চৌধুরীর ‘টাকা আনা পাই’-তেও ছিলেন রাজ্জাক ও ববিতা। এখানে চঞ্চল এক মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন ববিতা। সেই সময় নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘স্বরলিপি’-র চরিত্রটিও একই ধরনের ছিল ববিতার। এইসব ছবির প্রতিটিই ব্যবসাসফল হয়।

স্বাধীনতার পরে মুক্তি পায় রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত বহু চলচ্চিত্র। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছেÑ মানুষের মন, প্রিয়তমা, স্লোগান, ভুল যখন ভাঙল, বাঁদী থেকে বেগম, আলো তুমি আলেয়া, আকাক্সক্ষা, কি যে করি, সোহাগ, জিঞ্জির, আনারকলি, নাতবৌ, বদনাম, কালো গোলাপ, লাইলী মজনু, বিরহ ব্যথা, প্রফেসর, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি।

নিজের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭)-এ রাজ্জাক নায়িকা হিসেবে নিয়েছিলেন ববিতাকে। আবার ববিতাও নিজের প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘ফুলশয্যা’ (১৯৮৬)-য় নায়ক হিসেবে পছন্দ করেছিলেন রাজ্জাককেই।

রাজ্জাকÑববিতা জুটি সফল হওয়ার পেছনে কারণ হলো, দুজনের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া ছিল। দুজনেই চলচ্চিত্রকে ভীষণ ভালোবাসেন। ভালো ছবির জন্য দুজনেই ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যেহেতু ববিতার দুলাভাই প্রয়াত জহির রায়হানের হাত ধরেই রাজ্জাক চলচ্চিত্রে এসেছিলেন, সেহেতু দুজনের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। রাজ্জাককে বড়ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন ববিতা। অন্যদিকে দুজনই ভীষণ পেশাদার ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘অনন্ত প্রেম’-এ ববিতাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ করেছিলেন রাজ্জাক। ছবিটির শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল। শুটিং করার আগে রাজ্জাক যখন বিষয়টি জানালেন, তখন ববিতা অতিরিক্ত বিশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন। রাজ্জাকও রাজি হয়েছিলেন। এমন সুন্দর ও পেশাদার সম্পর্ক ছিল বলেই রাজ্জাক-ববিতা জুটি চল্লিশটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সেগুলোর অধিকাংশই ব্যবসাসফল।

জুটির বাইরেও রাজ্জাক বেশ কয়েকজন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। এমনকি নবাগত নায়িকার সঙ্গেও। নিজের ছবিতে ব্রেকও দিয়েছেন। রাজ্জাকের এসব নায়িকার কথা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।

 

নূতন

এদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে নৃত্যপটিয়সী নায়িকা ছিলেন নূতন। তার অভিষেক চলচ্চিত্র মুস্তাফা মেহমুদ পরিচালিত ‘নতুন প্রভাত’ (১৯৭০)। তারপর স্বাধীনতার পরে বহু চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। সংখ্যার হিসাবে তা দু শ’ ছাড়িয়ে গেছে।

নূতনের সঙ্গে রাজ্জাক বেশি ছবিতে অভিনয় করেন নি। তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘সৎভাই’ (১৯৮০)। তাছাড়া ‘পাগলা রাজা’, ‘বদনাম’, ‘অলংকার’-সহ কয়েকটি ছবিতে নূতনের সঙ্গে রাজ্জাককে অভিনয় করতে দেখা গেছে (এইসব ছবিতে অবশ্য নূতন দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে কাজ করেছেন, উল্লেখ্য নায়ক হিসেবে সর্বশেষ যে ছবিতে রাজ্জাক অভিনয় করেন, সেই ‘মালামতি’ (১৯৯০)-র নায়িকাও নূতন। বলা যায়, শুধু সামাজিক নয় পোশাকি ছবিতেও নূতনের সঙ্গে রাজ্জাক অভিনয় করেছেন।

 

অলিভিয়া

প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার সবচেয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী প্রজেক্ট ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ (অসমাপ্ত) ছবির নায়িকা হিসেবে প্রথম নির্বাচিত করেন অলিভিয়াকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি অলিভিয়াকে ছবি থেকে বাদ দেন। এরপর বেবী ইসলাম ‘সংগীতা’ নামে একটি ছবিতে নায়িকা হিসেবে অলিভিয়াকে সিলেক্ট করেন, কিন্তু সেই ছবিটিও শেষ পর্যন্ত নির্মিত হয় নি। অবশেষে অলিভিয়া সেলুলয়েডের রুপালি পর্দায় দর্শকদের অভিবাদন জানান এস.এম.শফি পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ (১৯৭২)-তে। উল্লেখ্য, এ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। রাজ্জাক হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন অলিভিয়ার বিপরীতে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘পাগলারাজা’ এবং ‘যাদুর বাঁশি’ ছবি দুটি। বিশেষত ‘যাদুর বাঁশি-তে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছেন অলিভিয়া। এক নিঃসন্তান রমণীর চরিত্রে এ ছবিতে তিনি সত্যি অনন্যা—যার বাইরে হাসির ছটা ভেতরে অশ্রুজল।

 

সুচরিতা

সুচরিতার অভিনয় জীবন শুরু হয় শিশুশিল্পী হিসেবে। তখন তার নাম ছিল বেবী হেলেন। শিশুশিল্পী হিসেবেই সুচরিতা কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নির্মাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘বাবলু’ ছবিতে অভিনয় করে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে শিশুশিল্পী হিসেবে সুচরিতা খ্যাতি অর্জন করেন। নায়িকা হিসেবে সুচরিতা প্রথম অভিনয় করেন আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘স্বীকৃতি’ ছবিতে। প্রথম দিকে সুচরিতা দর্শকদের খুব বেশি নাড়া দিতে না পারলেও কালক্রমে তিনি প্রথম শ্রেণির নায়িকার কাতারে চলে আসেন।

সুচরিতার বিপরীতে রাজ্জাক প্রথম অভিনয় করেন ‘সমাধি’ ছবিতে (১৯৭৬)। ছবিটি সুপারহিট হয়। পরে ‘আপনজন’সহ আরও কয়েকটি ছবিতে সুচরিতার বিপরীতে রাজ্জাককে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এইসব ছবির মধ্যে ‘কাজললতা’ ছবিটি ব্যতিক্রম। এখানে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন সুচরিতা। এ ছবির ‘এই রাত ডাকে/ওই চাঁদ ডাকে’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

সুচরিতার সঙ্গে রাজ্জাকের বয়সের বেশ ব্যবধান ছিল। তারপরও কখনোই রাজ্জাককে বেমানান মনে হয় নি। অভিনয়ের গুণে তিনি উতরে গিয়েছিলেন এবং বড়পর্দায় তার অভিনীত চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।

 

শবনম

এদেশের চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য নায়িকা শবনম। এহতেশামের আবিষ্কার এই নায়িকা শুরুতে জুনিয়র শিল্পী হিসেবে এদেশের চলচ্চিত্রে পা রাখেন। নায়িকা হিসেবে তার অভিষেক চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘হারানো দিন’ (১৯৬১)। ছবিটি সেই সময়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন রকর্ড সৃষ্টি করেছিল। রজতজয়ন্তী সপ্তাহ পালন করেছিল ‘হারানো দিন’। পরে তিনি উর্দু ছবিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই সূত্রে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার বহু বছর পড়ে তিনি এদেশের মাটিতে পা রাখেন। তখন তিনি চরিত্রাভিনয়ে ঝুঁকে পড়েন।

শবনমের সঙ্গে রাজ্জাক  প্রথম অভিনয় করেন ‘নাচের পুতুল’ (১৯৭১) ছবিতে। এ ছবির ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানটিকে বলা হয় নায়ক রাজ্জাকের রোমান্টিক ইমেজের ট্রেডমার্ক। এ গানে ফোনের ওপাশে ছিলেন শবনম।...স্বাধীনতার পরে ‘সন্ধি’, ‘যোগাযোগ’সহ আরও কয়েকটি ছবিতে শবনমের বিপরীতে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এসব ছবিও জনপ্রিয় হয়।

 

রোজিনা

ঢাকার মঞ্চনাটক থেকে রোজিনার অভিনয়জীবন শুরু হয়। চলচ্চিত্রে আসার আগে রোজিনা ছিলেন মঞ্চের একজন নিয়মিত শিল্পী। এই সময়ে রোজিনা কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে অংশ নেন। যার মধ্যে ‘মায়াবড়ি’ বিজ্ঞাপনচিত্রটি উল্লেখযোগ্য। একসময় রোজিনা সুযোগ পেয়ে যান বড়পর্দার সহনায়িকা হিসেবে ‘জানোয়ার’ (১৯৭৬) ছবিতে। এ ছবির পর ‘মিন্টু আমার নাম’ ছবিতে তাকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করা হলেও পরবর্তী সময়ে রোজিনাকে বাদ দেওয়া হয়। বেশ কিছুদিন বিরতি দিয়ে রোজিনা একক নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্রে আসেন এফ কবির চৌধুরী পরিচালিত ‘রাজমহল’ ছবির মাধ্যমে। প্রথম ছবিতেই তিনি অন্য নির্মাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং একসময়ে প্রথম শ্রেণির নায়িকায় পরিণত হন।

গত শতকের আশির দশকে রাজ্জাক হাতে গোনা কয়েকটি ছবিতে রোজিনার বিপরীতে অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অভিযান’ (১৯৮৪) চলচ্চিত্রটি।

 

অঞ্জনা

অঞ্জনা মূলত নৃত্যশিল্পী। শামসুদ্দীন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’ (১৯৭৬)-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসার আগে নৃত্যশিল্পী হিসেবেই তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। এবং সত্যি কথা বলতে কী, নৃত্যের ক্ষেত্রে অঞ্জনার এই প্রসিদ্ধি চলচ্চিত্র জগতে তার আগমনের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

অঞ্জনার সঙ্গেও রাজ্জাক সামান্য কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি আজিজুর রহমানে ‘অশিক্ষিত’ ছবিটি। ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’ গানের জন্য বিখ্যাত এ ছবিটি। এ গানে অংশগ্রহণ করেছিলেন রাজ্জাক ও অঞ্জনা। এছাড়া রাজ্জাক নিজের প্রযোজনায়ও অঞ্জনাকে নিয়ে কাজ করেছেন ‘অভিযান’ ছবিতে।

 

কাজরী

কাজরী জুনিয়র শিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিতে। অবশ্য তখন তার নাম কাজরী ছিল না। রাজ্জাকই ‘কাজরী’ নামটি প্রদান করেন তাকে এবং নায়িকা হিসেবে অভিনয় করার সুযোগ দেন। ছবির নাম ‘জোকার’। পরে ‘মৌচোর’সহ আরও কয়েকটি ছবিতে কাজরীর সঙ্গে অভিনয় করেন রাজ্জাক।

এছাড়া কবিতা, অঞ্জু ঘোষসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গেও রাজ্জাক অভিনয় করেছেন নায়ক হিসেবে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.