সুচিত্রা সেন: সিনেমার আকাশে ধ্রুবতারা

সুচিত্রা সেন: সিনেমার আকাশে ধ্রুবতারা

[আজ ১৭ জানুয়ারি, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অন্যদিন পাঠকদের জন্য বিশেষ এই রচনা।]

বাংলা সিনেমার জগতে রমা দাশগুপ্ত তথা সুচিত্রা সেন এক মহীরুহের নাম। প্রকৃত উর্বশী বলতে যার মুখ ভেসে আসে সবার আগে, তিনি সুচিত্রা সেন। দেশভাগের পর প্রায় অস্তমিত পোড় খাওয়া টলিপাড়াতে পাবনার এই ভূমিকন্যার আগমন বসন্তের এক দমকা হাওয়ার মতো এবং তাঁর টানেই দর্শকেরা ফের হলমুখী হয়েছিলেন। রমা ছাড়াও বাড়িতে তাঁর ডাকনাম ছিল কৃষ্ণা এবং সেই কৃষ্ণা তথা দ্রৌপদী হয়েই তিনি অবতীর্ণ হলেন বাংলা সিনেমাকে বিপর্যয়ের মুখ থেকে পুনরুদ্ধার করতে, হয়ে উঠলেন কোটি দর্শকের হৃদয়ের রানি।

সুচিত্রার আগে দীর্ঘদিন ধরে দর্শকের মনের আসনে বিরাজ করেছিলেন সুপারস্টার অভিনেত্রী কানন দেবী, যিনি ধীরে ধীরে প্রধান নায়িকার ভূমিকা থেকে সরে আসছিলেন। অন্যদিকে আদিনাথ সেনের পুত্রবধূ বলেই সুচিত্রা সেনের প্রধান নায়িকা হওয়ার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। ‘সাত নম্বর কয়েদী’র আগে প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ অর্থের অভাবে মুক্তি পায় নি। সেখানেই সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতিশ রায়ের অধীনে রমা থেকে সুচিত্রা হিসেবে আত্মপ্রকাশ।

ক্যারিয়ারের শুরুতে তাকে অরুন্ধতী দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা দেবী, সন্ধ্যারানী, মঞ্জু দে, অনুভা গুপ্ত প্রমুখ অভিনেত্রীদের সঙ্গে টক্কর দিতে হয়েছিল, এমন কি এক্সট্রা হিসেবে কিছু ছবিতে কাজ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং শেষে তিনিই জয়ী হয়েছিলেন।

দেবকী বোসের ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় তিনি প্রথম সাফল্যের স্বাদ পান। এরপর দেখা দিলেন নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। হাস্যরসাত্মক এই ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী মূল আকর্ষণ হলেও দর্শকেরা আদৌ জানতেন না যে, এ ছবির মাধ্যমে রামপ্রীতি-রমলার ভূমিকায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রার সূচনা হতে চলেছে। সেই সময় ‘ফ্লপমাস্টার’ হিসেবে খ্যাত উত্তমকুমার সে রকম আশাতীত সাফল্য পাচ্ছিলেন না সমসাময়িক অন্যান্য নায়িকাদের সঙ্গে। তবে সুচিত্রার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে রসায়নটি জমে উঠল।

এরপর ‘মরণের পরে’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরী’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘ইন্দ্রানী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’ ইত্যাদি ছবি দিয়ে শুরু হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রার স্বর্ণখোচিত অধ্যায়। মাঝে স্বর্ণযুগের এই অন্যতম জুটি একসঙ্গে সিনেমা করা কমিয়ে দিলেও ষাট ও সত্তর দশকেও উপহার দিয়েছিলেন, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘আলো আমার আলো’, ‘হার মানা হার’, ‘নবরাগ’-এর মতো হিট ছবি। উত্তম-সুচিত্রার ছবিতে তাঁদের রাগ-অনুরাগ ও প্রেম-বিরহের মাঝে সেই সময়ে দর্শকেরা নিজেদের খুঁজে পেতেন, এমনই ক্যারিশমা ছিল এই জুটির। উত্তম ও সুচিত্রার গ্ল্যামারাস অথচ জ্বলজ্বলে উপস্থিতি ছাড়াও হেমন্ত-সন্ধ্যা ও মান্না-আরতির মনমাতানো গান, সব মিলিয়ে উত্তম-সুচিত্রা ছিলেন বক্স অফিসের সাফল্যের অন্যতম জুটি।

তবে সুচিত্রা সেন মানেই যে শুধু উত্তম-সুচিত্রার একাংশ, তা একেবারে ভুল। বরং তিনি এর অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। স্বয়ং উত্তমকুমার ‘মহানায়ক’ খেতাব পেলেও শেষের দিকে অর্থসহ নানা কারণে তিনি ক্রমশ চরিত্রাভিনয়ে ঢুকে পড়েছিলেন, যে পথে একদমই পা বাড়ান নি মিসেস সেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটির বাইরেও একক নায়িকা হিসেবেও যে তিনি সফল, এর প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে আছে ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘ফরিয়াদ’, ‘দত্তা’, ‘দেবী চৌধুরানী’ ও ‘আঁধি’র মতো ছবি। বিশেষ করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাসগুলোর নায়িকাদের রক্তমাংসের রূপ দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। তাছাড়া পুরুষ শাসিত একটি ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি ছিলেন ক্ষমতায়নের প্রতীক। খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ পারিশ্রামিকপ্রাপ্ত স্টার এবং তাঁর জন্যই চিত্রনাট্য বাঁধাই করে আনা হতো।

উত্তমের আগে নিজের নামটি বসিয়ে সুচিত্রা-উত্তম করানো ছিল তাঁর যুগান্তরকারী এক উদ্যোগ। তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের খাতিরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রাজ কাপুর ও জেমিনি গণেশনদের মতো তারকাদের ছবি, এমনকি অন্য পরিচালকদের বঞ্চিত করতে নারাজ বলেই সত্যজিৎ রায়ের মতো নির্মাতার এক্সক্লুসিভ কন্ট্রাক্ট নির্দ্বিধায় ছিঁড়ে ফেলেন। কেরিয়ারের শুরুতে অন্য নায়িকাদের বহু নিপীড়িত হতে দেখেছেন এবং নিজেও কিছুটা শিকার হওয়ার পর কঠিন পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির ‘ম্যাডাম’, যাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত স্টুডিওপাড়া, এবং যাঁর অদম্য ব্যক্তিত্ব ও মহানুভবতায় মুগ্ধ ছিলেন তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুরা। বলাই বাহুল্য, বাংলা সিনেমার জগতে নারীক্ষমতার প্রথম নিশান উড়ান সুচিত্রা সেন, যিনি নায়িকাদের সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন এবং এখানেই তিনি অনন্যা।

সুচিত্রা অবিনশ্বর এক নক্ষত্রের নাম। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, এবং তিনি বেঁচে থাকবেন চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের চিত্তে, বিরাজ করবেন দর্শকদের মনের মণিকোঠায় বাংলা সিনেমার রাজরাজেশ্বরী হিসেবে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.