প্রকৃতিপ্রেমিক বুদ্ধদেব গুহ

প্রকৃতিপ্রেমিক বুদ্ধদেব গুহ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে বাংলা সাহিত্যে বন, অরণ্য এবং প্রকৃতি-বিষয়ক লেখালেখির জন্য সুপরিচিত বুদ্ধদেব গুহ। তিনি আর এই নশ্বর পৃথিবীতে নেই। পাড়ি জমিয়েছেন অমৃতলোকে। এই প্রথিতযশা সাহিত্যিককে নিয়ে এই রচনা।

বুদ্ধদেব গুহের জন্ম ১৯৩৬ সালেন ২৯ জুন কলকাতায় হলেও তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল বাংলাদেশের বরিশাল ও রংপুরে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপরিচিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশুনা করেন।

পেশাগত জীবনে বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন একজন নামি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। দিল্লীর কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করেছিল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন তিনি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। একদা বামফ্রন্ট তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড এবং নন্দন উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য করেছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন পরিচালক সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন।

লেখালেখি ছাড়াও বুদ্ধদেব গুহ চমৎকার ছবি আঁকতেন। নিজের লেখা একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। শিকার করতেও ভালোবাসতেন। নানা সৃজনশীল কাজ সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ‘নন্দনতত্ত্বে সৃজনশীলতায় কোনো একটি ধারাই আশ্রয় করে কেউ বেঁচে থাকবে এমন কথা বলা নেই। যাঁরা সত্যিকারের সৃজনশীল মানুষ তাঁরা চিরদিনই সৃজনের সমস্ত দিকের প্রতি আকৃষ্ট তো ছিলেনই, তাঁদের অল্পবিস্তর পারদর্শিতাও ছিল, কারণ এই সৃষ্টিশীলতা একে অন্যের পরিপূরক এবং অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।’ 

‘জঙ্গলমহল’ বুদ্ধদেব গুহের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এরপর তাঁর বহু গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বাবলি, মাধুকরী, কোজাগর, হলুদ বসন্ত, একটু উষ্ণতার জন্য, অববাহিকা, বিন্যাস, অন্বেষ, ভোরের আগে, সন্ধের পরে, পুজোর সময়ে, নগ্ন নির্জন, চাপরাশ, চারুমতি, ছৌ, ওয়াইকিকি, ঝাঁকিদর্শন...।

বুদ্ধদেব গুহের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্টের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃতির বর্ণনায় ভরপুর তাঁর সাহিত্য। আর প্রকৃতি মানে শুধু গাছগাছালি নয়, নানা ধরনের বন্য প্রাণীও এর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর রসনাবিলাসী সত্তার প্রকাশও বিভিন্ন লেখায় রয়েছে। বলা যায়, বিভূতিভূষণের সঙ্গে মিল ও অমিল দুই-ই আছে।

যৌনতাও বুদ্ধদেবের গল্প-উপন্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য। তবে এক্ষেত্রে রগরগে বর্ণনার মাধ্যমে পাঠকদের সুড়সুড়ি দেওয়া নয়, তা শৈল্পিকভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। আর নারীদের তিনি প্রকৃতি সংলগ্ন হিসেবেই দেখেছেন। তাই তো রোমান্টিসিজমের ছাপও পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। উদাহরণ হিসেবে ‘বাংরিপোসির দু রাত্রির’ উপন্যাসের নায়ক তাঁর প্রিয় নারীকে যেভাবে স্নান করাতে চায়, সেটির অত্যন্ত রোমান্টিক বর্ণনা দিয়েছেন বুদ্ধদেব।

বুদ্ধদেবের লেখার আরেকটি বৈশিষ্ট্য, নানা ধরনের তথ্যের সমাবেশ। বলাই বাহুল্য, বর্ণনার গুণে তা বাহুল্য মনে হয় না, একঘেয়ে লাগে না।...তাঁর নায়কেরা নানাভাবে মানুষের উপকার করে, ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। অথচ সেইসব মানুষের কাছ থেকেই আঘাত পায়। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। এমন অভিজ্ঞতা আসলে স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহের। আত্মজৈবনিক এমন নানা উপাদানই তাঁর নানা লেখায় ছড়িয়ে আছে। আর ‘খেলা যখন’ উপন্যাসের রাজা আর বুলবুলি তো আসলে বুদ্ধদেব গুহ ও তাঁর স্ত্রী ঋতু গুহ। তাঁদের পরিচয় আর প্রেমই এই উপন্যাসের উপজীব্য।

বাংলা সাহিত্যে চিঠির আঙ্গিকে প্রথম উপন্যাস লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম। উপন্যাসটির নাম ‘বাঁধনহারা’। পরে বুদ্ধদেব গুহ এই আঙ্গিকে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। যেমন- সবিনয় নিবেদন, চান ঘরে গান, অবরোহী, মহুয়াকে, মহুলসুখার চিঠি...। আর পাঠকদের চিঠিপত্রের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারেও বুদ্ধদেব গুহের সুনাম ছিল।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অজ পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে অন্য রাজ্যের অনেক অঞ্চল নিয়েই লিখেছেন বুদ্ধদেব গুহ। বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশার বিভিন্ন রাজ্যসহ ভারতের নানা অঞ্চল। তবে পশ্চিমবঙ্গের হাজারীবাগের পটভূমিতে সবচেয়ে বেশি গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। যেমন- জঙ্গল মহল, বনবাসর, জঙ্গলের জার্নাল, বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকার, ভোরের আগে. অবরোহী, প্রতিপদে চাঁদনীসহ নানা রচনা। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, হাওয়াইয়ান আইল্যান্ডস, আফ্রিকাসহ নানা জায়গার পটভূমিতে লিখেছেন বুদ্ধদেব গুহ।

শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। তাঁর প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ ‘ঋজুদার সঙ্গে’। ঋজুদা বুদ্ধদেবের সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় অভিযাত্রিক চরিত্র। এই চরিত্রকে নিয়ে তিনি বহু উপন্যাস-গল্প লিখেছেন। 

বুদ্ধদেব গুহ কবিতাও লিখেছেন। বহু চমৎকার ছবি এঁকেছেন। এক্ষেত্রে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গোপাল ঘোষ, ইন্দ্র দুগার প্রমুখ। গানও লিখেছেন, ‘ও পাড়ায় গিয়ে দেখে এলাম একটি ডাগর কালো মেয়ে...’। অভিনয় করেছেন বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে। বিশেষত ‘মুক্তধারা’তে ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। আকাশবাণী কলকাতাতে অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘রবিবার’-এ।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব গুহর প্রিয় লেখক। তার সঙ্গে মিল-অমিল প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব বলেছেন, “উনি শিকারি ছিলেন। সারা পৃথিবীতে শিকার করেছেন। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন এবং আমারই মতো ‘ঠোঁট কাটা’। তাঁর নিজের সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ ছিল না। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তা সে শিকারই হোক, কী সমুদ্রে মাছ ধরা, কী বক্সিং, হারতে রাজি ছিলেন না। অত্যন্ত কম্পিটিটিভ ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। আমারও তাই। যদিও জানি যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ভালো না। তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতাও ছিলেন। তবে অমিলও কম নেই। ওঁর প্রচুর বন্ধু ছিল সবসময়ই বন্ধুবেষ্টিত থাকতে ভালোবাসতেন আর আমার বন্ধু বিশেষ নেই। তাছাড়া একা থাকতেই আমি বেশি ভালোবাসি।”

বুদ্ধদেব গুহ ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পান ১৯৭৬ নালে। বিদ্যাসাগর পুরস্কারসহ আরও কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেছেন। তবে পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিনি অবিচারের শিকার হয়েছেন। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার বা সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার পান নি। অবশ্য সবচেয়ে দুর্লভ পুরস্কার, পাঠকদের ভালোবাসা, সেই পুরস্কার থেকে তিনি বঞ্চিত হন নি।

বুদ্ধদেব গুহের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র খুব কম নির্মিত হয়েছে। যেমন- ‘ভোরের আগে’, ‘ডিকশনারি’...। এর কারণ হলো বুদ্ধদেব অনুমতি দেন নি। কারণ তাঁর নিরানব্বই শতাংশ লেখার পটভূমি কলকাতার বাইরের। অথচ নির্মাতারা শুটিং করতে চেয়েছেন কম খরচে, কলকাতায় বসে। এটি বুদ্ধদেব গুহের পছন্দ হয় নি।

জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বুদ্ধদেব গুহ লিখে গেছেন। কেননা তিনি মনে করতেন, লেখকদের কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই।

অন্যদিন-এর জন্মলগ্ন থেকে বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিন ঈদসংখ্যায় তিনি কয়েকটি গল্প লিখেছেন। তাঁর একটি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছিল অন্যদিন ঈদসংখ্যায়, ২০০০ সালে। উপন্যাসটির নাম ‘স্বপনে, নিভৃত স্বপনে’।

তাঁর স্মৃতির প্রতি অন্যদিন-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি।      

Leave a Reply

Your identity will not be published.