[আগামী ২৫ ডিসেম্বর চার্লি চ্যাপলিনের ৪৮তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ফিচারটি পত্রস্থ হলো।]
পরনে বগি টাউজার্স, খুলে পড়বে বলে কোমরে দড়ি, মাথায় ক্ষুদ্রকায় বাউলার টুপি, গায়ে অতি আঁটসাট একটা কোট, পায়ে অতিকায় জুতো—উল্টো করে পরা যদি খুলে যায়। আর নাকের নিচে ট্রুথব্রাশের আঁশের মতো এক চিমটি গোঁফ। আর হাতে রয়েছে সর্বকর্মক্ষম একটি ছড়ি।
চিনতে পারছেন ? হ্যাঁ, চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)। বহু ছবিতে এই বেশে তাঁকে দেখা গেছে, ভাঁড় ও ভবঘুরে হিসেবে। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই মানুষটিকে চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলে মনে করা হয়।
চ্যাপলিনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বাবার অনুপস্থিতি ও মায়ের অর্থাভাবের কারণে নয় বছর বয়সের আগেই তাঁকে দুবার একটি কর্মশালায় যেতে হয়েছিল। চ্যাপলিনের চোদ্দ বছর বয়সে পাগলাগারদে পাঠানো হয়েছিল তাঁর মাকে। এই অসহ্য অবস্থা ও দরিদ্র জীবনের ছায়া চ্যাপলিন অভিনীত চলচ্চিত্রের চরিত্রসমূহে পড়েছে।
১৯১০ ও ১৯১২, দু'বার আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিলেন চ্যাপলিন, নাচগানের দলের সদস্য হিসেবে। কিন্ত থাকতে পারেন নি। অবশেষে ১৯১৩ সাল থেকে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পেলেন। অভিনয় করতে লাগলেন একের পর এক চলচ্চিত্রে, সেই ভাঁড় ও ভবঘুরের বেশে। বলা যায়, ১৯১৪ থেকে ১৯৪০ সাল, ‘কিড অটো রেস অ্যাট ভেনিস’ থেকে ‘দি গ্রেট ডিকটেটর’ পর্যন্ত ৭৬টি ছবিতে ওই একই বেশে চ্যাপলিনকে দেখা গেছে। কখনো সে বেহালাবাদক, কখনো পুলিশ, আবার কোথাও কর্মচারী, কোথাও নাপিত, সৈন্য অথবা অন্যকিছু। তবে সব সময়ই তাঁর ভেতরে কাজ করে না-পাওয়ার বেদনা।
চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রের মূল ভাব কী ? সেটি এই লেখার শিরোনামেই প্রকাশিত। বিষয়টি চ্যাপলিনের মাথায় কীভাবে এসেছিল ? শোনা যাক তাঁর বয়ান:
আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ দলে দলে ভেড়া নিয়ে যায় কসাইখানায়। একদিন কেমন করে একটা ভেড়া দলছুট হয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল। এই না দেখে হই হই। লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে মজা দেখতে। ভেড়ার মালিকরা চেষ্টা করছে ভেড়াটাকে ধরতে। কিন্তু ভেড়া ধরা দেবে না। ছোটাছুটি। এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল। অবশেষে ভেড়া ধরা পড়ল। পড়তেই হবে। ভেড়া তো ভেড়াই। মানুষের চালাকির সঙ্গে পারে কখনো! বোকা ভেড়াটাকে কাঁধে নিয়ে একজন কসাইখানার দিকে চলল। ভেঢ়ার পরিণতি ভেবে হঠাৎ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাই তো! একটু আগে যে ভেড়ার ছোটাছুটি দেখে আমি হাসছিলাম, তার পরিণতি এখনই মৃত্যু। আর থাকতে পরলাম না। ছুটে ভেতরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম—মাগো ওমা ওরা ভেড়াটাকে মেরে ফেলবে। একই সঙ্গে পাশাপাশি দুটি ছবি। হাসির এবং কান্নার। একটি মজার অন্যটি দুঃখের। এই ঘটনা আমি কোনোদিন ভুলতে পারলাম না। এটি আমার চিন্তার জগতকে ধরে রেখেছে। জানি না, এটাই আমার চিন্তার মূলসূত্র কি না। আমার ছবিতে ঘুরেফিরে এই অনুভবের মিশ্রণ। একটি আনন্দের অন্যটি বেদনার।
এবার কয়েকটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কান্না-হাসির এই বিষয়টি তুলে ধরা যাক।
দি ব্যাংক (১৯১৫) ছবিতে চার্লি একটি ব্যাংকের দারোয়ান ও ঝাড়ুদার। ভালোবাসে ব্যাংকের এক মেয়ে কর্মচারী। সেই মেয়েটিকে নিয়ে চ্যাপলিন স্বপ্ন দেখে:
বাংক লুটেরারা ঢুকেছে। ঢুকেই ম্যানেজারকে পরাভুত করে তারা প্রথমে গেল ভোল্ট খুলতে। ডাকাতদের দেখে ক্যাশিয়ার গেল পালিয়ে। ডাকাতরা মহানন্দে লুটপাট করছে। ভীতা এডনার তখন বড় করুণ অবস্থা। এইসব দেখে বীরের দম্ভে এগিয়ে এল চার্লি। সে ভোল্টে ঢুকে ডাকাতদের পরাস্ত করে, এডনাকে উদ্ধার করে নিয়ে এল। শুধু তাই নয়, সে ভোল্টের মধ্যে ডাকাতদের আটকে রেখে দিল। বিজয়ী চার্লি এডনাকে নিয়ে এল ম্যানেজারের ঘরে। চার্লি আবার ছুটে গিয়ে সর্বশেষ ডাকাতটাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়ে ফিরে এল। চার্লির বীরত্বে মহাখুশি ম্যানেজার অপদার্থ ক্যাশিয়ারটাকে লাত্থি মেরে তাড়িয়ে দিল। আর বিজয়ী চার্লি তার (প্রয়সী এডনাকে নিয়ে আদর করতে লাগল। প্রেমের সাগরে ডুব দিল দুজনে।
স্বপ্নভঙ্গের পর দেখা যায়, চ্যাপলিন এতক্ষণ ঝাড়ু দেওয়া কাঁটার গায়ে হাত বুলাচ্ছিল। আসলে সেই এডনা চ্যাপলিনকে নয়, ভালোবাসে ব্যাংকের ক্যাশিয়ারকে।
আবার ইজি স্ট্রিট (১৯১৭) ছবিতে চ্যাপলিন পুলিশ। একবার এক গুন্ডাকে শায়েস্তা করে সে। কীভাবে:
চার্লি পুলিশ হয়ে এল রাস্তায়। তার ব্যাটন দিয়ে ঠকাস করে মারল সেরা গুন্ডাক্ েকিন্তু ব্যাটনটা ভাঙল, গুন্ডাটা রইল অক্ষত। চার্লিকে তার বিক্রম দেখাবার জন্য গুন্ডাটা রাস্তায় গ্যাস লাইনের খাম্বাটা হাত দিয়ে টেনে বাঁকিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিল। চার্লিও এক কাণ্ড করল। সে পট করে গুন্ডার ঘাড়ে বসে তার মুখটাকে গ্যাসের বাতির খোপের মধ্যে ঠেসে ভরে দিয়ে গ্যাসের মুখ খুলে দিল। গ্যাসের অত্যাচারে গুন্ডার বারোটা বেজে গেছে। চার্লি এক মহা সাহসী বীর পুলিশ হয়ে গেল। অসহায় গুন্ডা গেল থানাতে।
অন্যদিকে দি ইমিগ্রান্ট (১৯১৭) ছবিতে দেখা যায় জাহাজে চড়ে চ্যাপলিন আসছে স্বপ্নের দেশ আমেরিকাতে। সেই সময় সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে খাবার খাওয়ার সময় যাত্রীরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। চ্যাপলিনও:
ভবঘুরে চার্লি জাহাজের রেলিং ধরে ঝুঁকে আছে জলের দিকে। মনে হয় তাকে সমুদ্রপীড়ায় ধরেছে। বোধহয় সে বমি করছে। না, চার্লি দেহ ঝুঁকিয়ে মাছ ধরছে। তার পাশের একজন যাত্রীকে রোগে ধরেছে, সে বমি করছে। তাই দেখে চার্লিরও বমি বমি এসে গেছে। সামলে নিয়ে চার্লি গেল ডাইনিং হলে। সবাই খেতে বসেছে। খাবে কেমন করে, তরঙ্গের দোলায় তখন জাহাজ উথাল-পাথাল করছে। খাবারের গামলা একবার দোল খেয়ে টেবিলের এধারে, আবার দোল খেয়ে ওধারে দৌড় দিচ্ছে। তার মধ্যেই যে পারছে সে-ই খাবার তুলে নিচ্ছে।
চ্যাপলিনের সেরা ছবি গোল্ডরাশ (১৯২৫)। স্বর্ণ অভিযানের কাহিনি। বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। তবে বাস্তবে অভিযাত্রীরা খিদের জ্বালায় মানুষখেকো হয়ে পরস্পরের জীবন নিয়েছিল। কিন্ত ছবিতে চ্যাপলিন বিষয়টিকে দেখেছেন রঙ্গচোখে, জীবন সংগ্রামের মানবিক দৃষ্টিতে। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, ক্ষুধার জ্বালায় চ্যাপলিন নিজের জুতোকেই খেতে চাইছে, অন্যদিকে আরেক অভিযাত্রী জিম তাকেই খাদ্য হিসেবে কল্পনা করছে:
ক্ষিধের জ্বালায় থাকতে না পেরে চার্লি খাবারের একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। তার বেঢপ জুতোর একটা সেদ্ধ করা হলো। জুতোর ওপরের চামড়াটা খেতে বসল জিম। আর নিচের অংশ ফিতা পেরেক চুষে চুষে খেতে লাগল চার্লি। এমন সুস্বাদু খাবার যেন চার্লি কোনোদিন খায় নি। আর কী চমৎকারভাবে সেই জুতোটা রান্না হয়েছে। যেন সর্বোৎকৃষ্ট ডিনার খাচ্ছে। জিম চামড়া কামড়াচ্ছে আর চার্লিকে দেখছে। ক্ষুধার্ত জিমের দৃষ্টিতে চার্লি রূপান্তরিত হলো একটি তাজা মোরগে। ক্ষুধার্ত জিম এই সরল টলটসে মোরগটাকে খাবে। জিম ছেড়ে আসছে। মোগররূপী চার্লি আত্মরক্ষার জন্য ছোটছুটি করছে। জিমের অবশ্য ভুল ভাঙল। চার্লি তখন দ্বিতীয় জুতোটা সেদ্ধ করতে বসেছে। জিমের আবার ভ্রম হলো। আবার সে মোগর দেখছে। পুনরায় ছোটোছুটি।
আবার দি সার্কাস (১৯২৮) ছবিতে দেখা যায়, পুলিশের সঙ্গে চ্যাপলিনের লুকোচুরি:
পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চার্লি পালাচ্ছে। তার পেছনে প্রকৃত চোর ছুটছে। ছোটছুটিতে চার্লি সার্কাসের আয়নাঘরে উপস্থিত। আয়নাঘরে ঢুকেই আর এক বিপদ। আয়নার প্রতিচ্ছায়ার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে চার্লি, পুলিশ আর চোর সবাই নাস্তানাবুদ। সেখান থেকে পালিয়ে সরাসরি সার্কাস এরিনাতে প্রবেশ। আর এক বিপর্য্যস্ত অবস্থা। ঘূর্ণিপাকে কখনো চার্লি পুলিশের আগে, কখনো পেছনে। আবার ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে পুতুল হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা। পুলিশ ধরতেই পারে না, পুতুলটা আসল, নাকি পলাতক চার্লি এই পুতুল!
সিটি লাইটস (১৯৩১) ছবিতে ভবঘুরে চ্যাপলিন ভালোবাসে রাস্তার এক অন্ধ ফুলওয়ালিকে। তার সাহায্যেই মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি লাভ করে। পরে মেয়েটির সঙ্গে চ্যাপলিনের দেখা হয়। ভবঘুরে চ্যাপলিনকে প্রথমে সে চিনতে না পারলেও শেষে চিনতে পারে। দুজনের মিলন হয়:
মেয়েটি একটি ফুল আর কিছু পয়সা নিয়ে চার্লির কাছে এল। চার্লি তাকে অপলক দেখে আছে। মেয়েটি অস্বস্তি বোধ করছে।
চার্লি হাত দিয়ে মেয়েটির হাত থেকে ফুল আর পয়সা নিল। হাতে হাত লাগতেই মেয়েটি শিহরিত হলো, চমকিত হলো। এই স্পর্শ তার খুব পরিচিত। এই হাতের ছোঁয়া সে কিছুতেই ভুলতে পারে না।
তুমি!
হ্যাঁ, আমি।
চার্লি আর তার প্রেয়সী অপরূপ দৃষ্টি মেলে পরস্পরকে দেখছে।
মডার্ন টাইমস (১৯৩৬) অন্য ধরনের ছবি। বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। প্রথম দৃশ্যেই সেই মজার শুরু। কারখানার শ্রমিকেরা যেন মানুষ নয়, ভেড়া:
একটি নিরীহ হতভাগ্য ভেড়া ভেসে উঠল পর্দাতে। তারপরই এক পাল ভেড়া ঢুকছে খোয়ারে। পরের শটেই একপাল মানুষ ঢুকছে কারখানাতে। তাদের মধ্যে একটি মানুষ, অসহায় হতভাগ্য চার্লি। তার সেই কোট প্যান্ট টুপিসহ।
অন্য ধরনের ছবি দি গ্রেট ডিকটেটর (১৯৪০)-ও। এখানে নাপিত ও হিটলার (ছবিতে যার নাম হিংগেল), এই দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন চ্যাপলিন। বলাই বাহুল্য, ছবিতে হিটলারের প্রতি নিজের ক্রোধ প্রচণ্ডভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি। তাঁর অভিনীত নাপিত চরিত্রটি এখানে শান্তিপ্রিয়। তাই সে যুদ্ধে দুর্বল:
নাপিতের ভূমিকায় চার্লি তাঁর গতানুগতিক ভবঘুরে বেশে এবং তেমনই বিবিধ ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়া অসহায় এক মানুষ। শত্রু পক্ষের কামানের দিকে গুলি ছুড়তে গিয়ে সে পায়নানার দিকে গুলি করে। তার অস্ত্রের মুখ দিয়ে শেল ছুড়লে সেই শেল তার দিকেই তীব্র বেগে ঘুরে ঘুরে আসে।
পাঠক, মজার বিষয় কী জানেন ? চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যুর পরেও বিধাতা তাঁকে নিয়ে একটি মজার ঘটনা সৃষ্টি করেছিলেন। কিডন্যাপেরা কফিন থেকে তাঁর শবদেহ চুরি করেছিল। কিন্তু ধরা পড়ে তা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের ডেভি শহরের উত্তরে গ্রাম কর্সিয়ার কবরস্থানে আবার শায়িত হয়েছিলেন চ্যাপলিন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.