তিনি এদেশের স্বনামধন্য চিত্রপ্রযোজক ও পরিচালক। ‘এ দেশ তোমার আমার’-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। নতুন নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি। বহু নায়ক-নায়িকাকে ব্রেক দিয়েছেন তিনি। এদের মধ্যে রয়েছেন—রহমান, নাদিম, নাঈম, শবনম, শাবানা, শাবনাজ, শাবনূর, শাবজান, মুনমুন...। তাদের গডফাদারই শুধু নন; ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইডের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি... তিনি যখন ছবি নির্মাণে আসেন তখন এ দেশে হলিউডের ইংরেজি হবি, ভারতের হিন্দি-বাংলা ছবি ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবি প্রদর্শিত হতো। বিশেষত উর্দু ছবির একটি বিরাট বাজার ছিল এই ভূখণ্ডে। তিনি তাই উর্দু ছবি নির্মাণে উদ্যোগী হন, যেন তা পুরো পাকিস্তানেই বাজার পায়।
তিনি এহতেশাম। এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের অন্যতম স্থপতি। ২০০১ সালের জুলাইতে তার সঙ্গে তার ও এদেশের চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছিলেন মোমিন রহমান। আগামী ১২ অক্টোবর এহতেশামের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ এখানে এহতেশামের জবানিতে উল্লেখ করা হলো।]
যৌবনের দিনগুলো
আমি পুরোনো ঢাকার বংশাল এলাকায় জন্মগ্রহণ করি এক বনেদি পরিবারে, ১৯২৭ সালের ১২ অক্টোবর। আমার বাবা ছিলেন ঢাকার ইসলামি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাবিদ্যালয়)-এর প্রিন্সিপাল। ‘প্রিন্সিপাল ইউসুফ’ নামে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে, আমার মা’ও অভিজাত পরিবারের কন্যা। আমার নানা হাকিম হাবিবুর রহমান পুরোনো ঢাকার এক নামি মানুষ ছিলেন।
অল্প বয়সে আমার বাবা মারা যান। ফলে জীবনসংগ্রামে আমাকে নামতে হয় তারুণ্যের প্রথম বেলাতেই। যদিও আমাদের প্রতি আমার নানার ছিল সজাগ দৃষ্টি। আমাকে তিনি দিল্লি পাঠান তার এক বন্ধুর কাছে পড়াশোনার জন্যে। আমার মনোবাসনা ছিল—আমি আর্মিম্যান হব, দেরাদুনে যাব পড়তে। ফলে দিল্লি যাওয়ার পর আমি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকি। এক সময় পেয়ে যাই সেই সুযোগ। সোজা চলে যাই আলিগড়ে। সেখানকার পরিবেশ আমার ভালো লাগে। পড়ালেখার প্রতি নতুন করে ভালোবাসা জন্মায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই—নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মনোগত এই ইচ্ছা পূরণের জন্যে আমি চলে যাই করাচিতে। সেখানে আমাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য এক খ্রিষ্টান পার্টি পিছু নেয়। কিন্তু তারা আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না। আমি এক সময় সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাশ করি। তারপর আবার মন বলে ওঠে, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।’ কাজেই আবার পথে নেমে পড়া। এবার বোম্বের উদ্দেশে যাত্রা। ... বোম্বে এসে আমি এক সরাইখানায় উঠি। চাকরি খুঁজতে থাকি। এক সময় এক জুতার দোকানে কাজ পেয়ে যাই। কয়েক মাস পরে সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে—আর্মি রেলওয়েতে লোক চাই। আমি গার্ড পদে আবেদন করি এবং মনোনীত হই। ট্রেনিং-এর জন্যে আমাকে ঝাঁসিতে অবস্থিত বীনাতে পাঠানো হয়। সেখানে এক মেজরের সুনজরে পড়ে আমি ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগদানে সমর্থ হই। প্রশিক্ষণের জন্যে দেরাদুনে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে আসামের কোহিমায় জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করি। যুদ্ধ শেষে আমার পদোন্নতি ঘটে। আমি তখন ক্যাপ্টেন। কলকাতায় যাই। সেখানে চাচাত বোন নাজমাকে বিয়ে করি। অতঃপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন।
প্রদর্শকের ভূমিকায়
ঢাকায় ফেরার পরে একদিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারলাম লালমনিরহাটে একটি সিনেমা হল ভাড়া দেওয়া হবে। আমার কাছে তখন খুব বেশি টাকা ছিল না, তবু আমি সিনেমা হলটি ভাড়া নিলাম। ঢাকার লায়ন সিনেমা হলের মালিক কাদের সর্দার ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। আমি তার কাছে গিয়ে একটি প্রজেক্টর মেশিন চাইলাম। বললাম, এখন টাকা-পয়সা দিতে পারব না। তিনি আশ্চর্য রকম সহযোগিতা করলেন। প্রজেক্টর মেশিন আমার হাতে তুলে দিলেন। এভাবেই প্রদর্শক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু।... লালমনিরহাটের সিনেমা হল থেকে প্রচুর অর্থাগম হতে থাকল। ফলে এই ব্যবসায় আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। শান্তাহার, নাটোরেও আমি সিনেমা হল করলাম। ঢাকার রাজার দেউড়িতে পরিবেশনা সংস্থা ‘লিও ফিল্ম’ প্রতিষ্ঠা করলাম।
চলচ্চিত্র প্রযোজক/পরিচালক
চলচ্চিত্র নির্মাণের যাবতীয় দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে আমার লাহোরে। সেখানে বিখ্যাত পরিচালক জিয়া সারহাদ্দি (যিনি নূতন ও বলরাজ সাহানীর আবিষ্কারক) ছবি নির্মাণ ব্যাপারটির সঙ্গে আমাকে পরিচিত করেন। চিত্রনাট্য রচনা থেকে সম্পাদনার সকল দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।
এদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর নির্মাণ কাজ দেখে আমি খুশি হতে পারি নি। এ ছবির ফটোগ্রাফি ও সাউন্ডের মান ভালো ছিল না। তখন ঢাকার বিজি প্রেসে ভালো ক্যামেরা ও রেকর্ডার ছিল। সেখান থেকে সরকারি প্রচারচিত্রগুলো নির্মিত হতো।... আমি তৎকালীন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়ে বিজি প্রেসের ক্যামেরা ও রেকর্ডার ধার চাইলাম। তিনি বিস্মিত হলেন আমি আর্মিম্যান হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করব শুনে। তিনি আমাকে সহযোগিতা করলেন। শুধু তাই নয়, অল্পদিনের পরেই ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিল উথাপন করেন। ফলে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এফডিসি প্রতিষ্ঠার দু’বছর সময়ের মধ্যে আমার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায়। এ ছবির নায়ক-নায়িকা ছিল খান আতা ও সুমিতা। ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন কিউ এম জামান এবং সহকারী পরিচালক জহির রায়হান। আর হ্যাঁ, একটি দৃশ্যে দিল্লির বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী পান্না অংশগ্রহণ করে।
‘এ দেশ তোমার আমার’ ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী দোসানী ফুল দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানান এবং আমার অংশীদার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফলে ‘লিও দোসানী ফিল্মস’ আত্মপ্রকাশ করে। এর অফিস ছিল গুলিস্তান সিনেমা হলের বিল্ডিংয়ে।
আমি এই পর্যন্ত বহু ছবি নির্মাণ করেছি। পাকিস্তান থেকে নির্মাণ করেছি ‘মিট্টিকা পুতলী’। ছবিটি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয়েছিল।
উর্দু ছবি নির্মাণ
লাহোরে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার চলচ্চিত্রের মানুষদের জীবনধারা দেখে আমি বিস্মিত হলাম—ওরা দামি পোশাক পরে, দামি গাড়িতে চড়ে, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকে। ওদের এই রমরমা অবস্থা উর্দু ছবির কারণে, যেহেতু উর্দু ছবির বাজার পুরো পাকিস্তানজুড়ে। আমার মনে তখন এক জেদ কাজ করল, এক কঠিন প্রতিজ্ঞা—উর্দু ছবি নির্মাণ করে বাজার দখল করতে হবে। এর ফলে আমি নির্মাণ করলাম ‘চান্দা’। ছবিটি অভাবনীয় ব্যবসা করল। এতে আমি যেমন অনুপ্রাণিত হলাম এখানকার অন্যান্য নির্মাতারাও অনুপ্রাণিত হলেন। এখানে উর্দু ছবি নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেল। এ জন্য অনেকে আমাকে দোষারোপ করে, আমার কারণেই নাকি এখানকার বাংলা ছবির নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু উর্দু ছবি নির্মাণের পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল—পশ্চিম পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একচেটিয়া প্রাধান্যকে ব্যাহত করা, পাকিস্তানজুড়ে যে বিশাল বাজার সেই বাজার দখল করা। আর উর্দু ছবি আমিই শুধু নির্মাণ করি নি; জহির রায়হান, কাজী জহির, খান আতা প্রথম সারির এইসব নির্মাতাও উর্দু ছবি নির্মাণ করেছে। পরিস্থিতিই আসলে আমাদের বাধ্য করে উর্দু ছবি নির্মাণে। এদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কি আমি উর্দু ছবি নির্মাণ করেছি ?
‘চান্দা’ প্রসঙ্গে আরেকটি অভিযোগ তোলা হয়, ছবিতে পাহাড়ি মেয়ের ভূমিকায় নায়িকা সঠিক পোশাক পরে নি। কিন্তু পাহাড়ি মেয়েরা তো ভালগার পোশাক পরে। সেটি তো আমি দেখাতে চাই নি। ‘চান্দা’য় পাহাড়ি মেয়ের ভাষা নিয়েও সমালোচকদের আপত্তি—আমি উর্দুকে প্রাধান্য দিয়ে একটি মিশ্রভাষা চরিত্রটির মুখ দিয়ে বলিয়েছিলাম। এটা করা হয়েছিল দর্শকদের কারণেই। উপজাতীয় মানুষেরা যে ভাষায় কথা বলে সেটি ছবিতে রাখলে কি দর্শকরা বুঝতে পারত ?
নতুন শিল্পী সৃষ্টি
নতুনদের প্রতি আমার বরাবরই ঝোঁক। নতুন শিল্পী ও কলাকুশলী সৃষ্টি আমার নেশা।
জীবনের প্রথম ছবিতেই আমি নতুনদের সুযোগ দিয়েছি। ‘এদেশ তোমার আমার’ ছিল সংগীত পরিচালক হিসেবে খান আতার প্রথম ছবি। রহমান, সুভাষ দত্ত, শবনম প্রথমবারের মতো এই ছবিতে অভিনয় করে। ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতেই রবিন ঘোষ ও ফেরদৌসী রহমান প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। এরপর শাবানা, নাদিম, শাবনাজ, নাইম, শাবনূর, শাবজান, সাথী, মুনমুনসহ অনেককেই ব্রেক দিয়েছি চলচ্চিত্রে।
রহমান ছিল হোটেলের রিসেপসনিস্ট। আজকে যেখানে পিজি হাসপাতাল, পঞ্চাশের দশকে সেখানে বিরাট হোটেল ছিল। একবার একটি কাজে সেই হোটেলে আমি গিয়েছিলাম। কাজটি সেরে ফেরার পথে রহমানের সঙ্গে দেখা। দেখেই আমি মুগ্ধ। তখনই আমি ওর সঙ্গে আলাপ করলাম। এবং ছবিতে অভিনয়ের অফার দিলাম। রহমান তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তো প্রথমে ছোট্ট একটি চরিত্র রহমানকে দিয়ে অভিনয় করালাম ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে। তারপর ‘রাজধানীর বুকে’-তে নায়ক হিসেবে রহমান অভিনয় করেছে। আমার ভাই মোস্তাফিজের ‘হারানো দিন’ ও ‘তালাশ’-এর নায়কও ছিল রহমান।
সুভাষ দত্তকেও আমি চলচ্চিত্রে ব্রেক দিই।...সুভাষ আমার কাছে এসেছিল পাবলিসিটির কাজ পাওয়ার জন্য। আমি ওকে ছবিতে অভিনয়ের অফার দিই এবং তা সে গ্রহণ করে। সুভাষ দত্ত শুধু ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ নয়, আমার ‘রাজধানীর বুকে’, ‘চান্দা’, ‘নতুন সুর’ ছবিতেও অভিনয় করেছে।
শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক। ওর বাবা ছিল আমার বন্ধু। পুরোনো ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওকে নাচতে দেখেছি আমি। তখনই সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি ওর বাবাকে বলি যেন তিনি মেয়েকে ছবিতে অভিনয়ের অনুমতি দেন। তিনি আমার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না, অনুমতি দিলেন। শবনম অভিনয় করল ‘এদেশ তোমার আমার’ ও ‘রাজধানীর বুকে’-তে ছোট্ট দুটি চরিত্রে। ফতেহ লোহানীর ‘আসিয়া’, জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’-তেও সে অভিনয় করেছিল। তবে নায়িকা হিসেবে ওর প্রথম ছবি আমার ছোট ভাই মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’। তখনই ওর নাম পাল্টিয়ে আমি শবনম রাখি।...রহমান-শবনম অভিনীত ‘হারানো দিন’ উত্তম-সুচিত্রার ‘হারানো সুর’-এর সঙ্গে চলেছিল এবং মজার বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়িক দিক থেকে ‘হারানো সুর’-কে হটিয়ে দেয় ‘হারানো দিন’। এটি এদেশের প্রথম রজতজয়ন্তী সপ্তাহ পালনকারী চলচ্চিত্র।
শাবানার বাবা ছিলেন কোর্টের কর্মচারী। একদিন তিনি আমার বাসায় এসে আর্থিক অনটনের কথা জানালেন। আমি তখন বললাম, ‘তুমি তোমার মেয়ে রত্নাকে ছবিতে কাজ করতে দাও। এতে তোমার সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে।’ তখন রত্না মানে এখনকার শাবানা আমার ‘নতুন সুর’ ছবিতে অভিনয় করে ছোট্ট চরিত্রে। পরে মুস্তাফিজের ‘তালাশ’, ‘ডাকবাবু’সহ অন্যদের ছবিতেও ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করে রত্না।
‘চকোরী’-র নায়ক ছিল নাদিম। সে-ও আমার আবিষ্কার। হায়দারাবাদের লোক সে। ওর বাবা এখানকার এক কটনমিলে চাকরি করত। বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে সে এসেছিল। সুইট হ্যাভেন রেস্টুরেন্টে ওর সঙ্গে আমার দেখা। আলাপ পরিচয় হলো। জানলাম ওর নাম নাজির বেগ। গান গায় সে। শুনে আমি ছবিতে প্লেব্যাক করার প্রস্তাব দিলাম। সে আমার ছোট ভাই মুস্তাফিজের একটি বাংলা ছবির নেপথ্যে কণ্ঠদান করল। যেহেতু ভিন্নভাষী মানুষ সেহেতু গানের কথার উচ্চারণে একটু সমস্যা ছিল। এ জন্য নাজির খুবই লজ্জিত হলো। আমি তাকে উৎসাহ জোগালাম এবং বললাম তাকে আগামী ছবির হিরো করতে চাই। সে রাজি হলো না। তখন আমি গান গাওয়ার প্রস্তাব দিলাম এবং জানালাম ছবিটি উর্দু ভাষায় নির্মিত হবে। এবার সে রাজি হলো। সেদিন আমি নাজিরকে নিয়ে গেলাম। সাউন্ড রেকর্ডিস্টকে ইশারা করতেই তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। আজ আর গান রেকর্ড হবে না।’ একথা শুনে সবাই বেরিয়ে গেল। গায়িকা ফেরদৌসীও বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি ওকে আটকালাম এবং চুপি চুপি জানালাম যে, গান রেকর্ডিং হবে। সে থেকে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে নাজিরের সঙ্গে গাইল ‘চকোরী’ ছবির সেই বিখ্যাত গান—‘ও শামা...’। গান রেকডিং-এর প্রথম দিকে নাজির একটু নার্ভাস ছিল। কিন্তু পরে সে সামলিয়ে নেয় নিজেকে। আমি প্রশংসা করতে নাজির বলে, ‘কী যে বলেন, আমি তো মামুলি সিঙ্গার।’ তখন আমি জানালাম যে কোনো আপত্তি শুনব না। ‘চকোরী’ ছবির নায়ক হিসেবে তাকেই চাই আমার। অগত্যা রাজি হতে হলো নাজিরকে। আমি তখন ওকে বললাম, ‘তোমার নাম চেঞ্জ করতে হবে। আজ থেকে তুমি নাদিম।’ উল্লেখ্য, ‘চকোরী’ ছবির নায়ক-নায়িকা হিসেবে আমি মনোনীত করেছিলাম আজিম-সুজাতাকে। ওরা তখন কক্সবাজারে গিয়েছিল একটি ছবির শুটিংয়ে। আমি মুস্তাফিজের মাধ্যমে ওদের অনুরোধ করলাম—এ ছবিটি যেন ওরা ছেড়ে দেয়। ওদের আমি পরে অন্য ছবিতে নেব। আর ড্রাইভারকে দিয়ে রত্নাকে ডেকে এনে জানালাম যে, ‘চকোরী’ ছবির নায়িকা সে। শুনে তো ও মহাখুশি। রত্নার নামও পাল্টে ‘শাবানা’ রাখলাম। এভাবে ‘চকোরী’ ছবির মাধ্যমে সাড়া জাগানো নতুন এক জুটি আত্মপ্রকাশ করল।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে আরেকটি জুটি আমি উপহার দিই ‘চাদনী’ ছবিতে। ওরা হলো নাইম-শাবনাজ। এরপর তো নতুনদেরই জয়জয়কার এদেশের চলচ্চিত্রে। ... শাবনাজকে আমি দেখি আমার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। ওর স্মার্টনেস আমাকে টানে। আমি ওকে ডেকে নিয়ে ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব দিই। ও বলে বাবার অনুমতি ছাড়া ছবিতে কাজ করবে না। অগত্যা ওদের বাসায় যাই। ওর বাবার অনুমতি নিই। অন্যদিকে নাইম হলো আমার বন্ধুর ছেলে। আমার পাশের বাসায়ই ওরা থাকত। ওকে নায়ক হিসেবে পেতে আমার কোনো সমস্যাই হয় নি।
এ সময়ের এক নম্বর নায়িকা শাবনূরও আমার আবিষ্কার। ওর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটি বলা যায়। ... আমার দুটি নেশা রয়েছে—ধূমপান করা ও মাছ ধরা। তো একবার বাহাদুরবাদের ঘাটে বসে মাছ ধরছি। একজন ভদ্রলোক এসে আমার পাশে বসল। শিল্পমনা এই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল আমার। তিনি আমার অফিসের ঠিকানা চেয়ে নিলেন। তারপর একদিন আমার অফিসে হঠাৎ তার আগমন, সঙ্গে একটি মেয়ে। পরিচয় হতেই জানলাম মেয়েটি তার কন্যা। মেয়েটিকে দেখেই আমার মনে হলো একে আমার আগামী ছবির নায়িকা করা যায়। ...আমার অফিসে আমার নায়িকাদের জন্যে সব সময় একটি চেয়ার সংরক্ষিত থাকে। আমি সেই চেয়ারে শাবনূরকে বসতে বললাম। তারপর জানালাম—ওকে আমি নায়িকা করতে চাই। শুনে মেয়েটি তো বটেই, ওর বাবাও অবাক হলো। মেয়েটি জানাল সে অভিনয়ের কিছু জানে না, কীভাবে সে নায়িকা হবে ? এটা কি সম্ভব? আমি বললাম, হ্যাঁ, সম্ভব। তবে এর জন্য ট্রেনিং নিতে হবে। তারপর মেয়েটিকে গড়ে নিয়ে ‘চাঁদনী রাতে’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করালাম। এই মেয়েটিই আজকের শাবনূর। বলাই বাহুল্য, শাবনূর নামটি আমারই দেওয়া।
শিল্পীদের নতুন নাম
অনেক পরিচালকের অনেক রকম বাতিক থাকে। যেমন, কাজী জহিরের বাতিক ছিল ছবির নাম পাঁচ অক্ষরের হতে হবে। যেমন—নয়নতারা, ময়নামতি, মধুমিলন, অবুঝ মন...। পাঁচ অক্ষরের নাম নাকি তার জন্য লাকি। হয়তো নিজের নামটিও পাঁচ অক্ষরের বলে এর প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। আবার সুভাষ দত্ত শিল্পীদের নতুন নাম দেন। চলচ্চিত্রে যেমন কবরী, সুচন্দা, উজ্জ্বল—এসব নাম তারই দেওয়া। প্যাকেজ নাটকেও তিনি নতুন শিল্পীদের নতুন নাম দিয়েছেন—সতীর্থ রহমান, লুনা কান্তি...। সুভাষের মতো আমারও প্রবণতা শিল্পীদের নতুন নাম দেওয়া। যেমন, নাজির বেগের নাম দিয়েছি আমি নাদিম, ঝর্ণা বসাককে করেছি শবনম। অবশ্য নায়িকাদের নামের ক্ষেত্রে শুরুতে আমি ‘শাব’ শব্দটি রাখি। ‘শাব’ শব্দটি পারস্য শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে রাত্রি। এ কথা নিশ্চয় সবাই মানবেন যে, দিনের বলায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জমে না। রাতেই এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গ্ল্যামার জগতের যারা নায়িকা—যাদের কাজ দর্শকদের আনন্দ দেওয়া, তারা তো মোহনীয় রাত্রিরই প্রতিনিধিত্ব করে। তাই আমার ছবির নায়িকাদের নাম বদলিয়ে আমি অন্য নাম রেখেছি এবং সেই নামের শুরুতে ‘শাব’ শব্দটি রয়েছে। যেমন—শবনম, শাবানা, শাবনাজ, শাবনূর ...। ‘শবনম’ নামের অর্থ ভোর রাতের শিশির ; এবং ‘শাবানা’ রাতের সুন্দরী, ‘শাবনাজ’ রাতের নখড়া এবং ‘শাবনুর’ রাতের আলো। অবশ্য মুনমুনের নাম আমি পাল্টাতে পারি নি। ওরা মা আপত্তি করেছিলেন।
চলচ্চিত্রের পরিবেশ
আমাদের সময়ে চলচ্চিত্রের পরিবেশ সুন্দর ছিল। সবাই ছিল এক পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তবে হীন রেষারেষি ছিল না। শিক্ষিত ও উপযুক্ত মানুষেরাই তখন এ জগতে আসত। সবারই একটি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। চলচ্চিত্র শুধু লাভজনক মাধ্যমই নয়, এখান থেকে যে সৃজনশীলতার আনন্দ পাওয়া যায়—সেটি টের পাওয়া যেত। এখন তো সবাই টাকার পেছনে ছুটছে। সৃজনশীলতার আনন্দ কোথায় ? কাপড়ের ব্যবসায়ীরাও এখন ছবির প্রযোজক। ...আগে ফিল্ম মিডিয়া সত্যিকার অর্থেই ছিল ডিরেক্টরস মিডিয়া। পরিচালকই শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করত। এখন শিল্পীরা পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ করে। এর জন্য দায়ী তথাকথিত পরিচালকরাই। তারা নিজেরাই নষ্ট করেছে ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশ। একজন পরিচালক হিসেবে এতে আমার দুঃখ হয়। ভীষণ দুঃখ।
অশ্লীল চলচ্চিত্র ও বিদেশি শিল্পী
বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতা গ্রাস করেছে। অশ্লীল সংলাপ, অশ্লীল গানের কথা, অশ্লীল পাত্র-পাত্রীদের পোশাক, নৃত্যের মুদ্রায় অশ্লীলতা—সর্বত্রই অশ্লীলতা। এছাড়া কাট পিসের দৌরাত্ম তো রয়েছেই। আমি অবশ্য আশাবাদী এই অবস্থা থাকবে না। চলচ্চিত্রশিল্পের পরিবেশের যেমন উন্নতি হবে, চলচ্চিত্রও অশ্লীলতার রাহুগাস থেকে মুক্ত হবে। অবশ্য এর জন্যে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে হবে। পরিচালকদের অনুধাবন করতে হবে যে পোশাক আমি আমার মেয়ে-বোনদের গায়ে দেখতে চাই না, সেই পোশাক আমি শিল্পীদের পরাব না। আসলে পরিচালকরাই তো একটি ছবির নিয়ন্ত্রক। শিল্পীদের নিয়ন্ত্রিত করেন তিনিই। একটি ছবির ভালো-মন্দের সকল দায়-দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। ...সম্প্রতি এফডিসিতে যে মহাসমাবেশ হলো এখানে অনেকে এদেশের চলচ্চিত্রের অশ্লীলতার জন্যে ভারতের নায়িকা ঋতুপর্ণাকে দায়ী করল। এটা কি ঠিক ? ঋতুপর্ণাকে চালিত করেছে কারা ? তারাই তো প্রকৃত অপরাধী। ...এছাড়া আমরা কেন বিদেশি শিল্পীকে অভিনয়ের জন্যে ডেকে আনি ? আমাদের দেশে শিল্পীর কি অভাব ? বহু সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী রয়েছে। তাদের গড়েপিটে নিলেই হয়। আমিই তো বহু নতুন শিল্পীকে সুযোগ দিয়েছি। নতুন শিল্পী দর্শকরাও দেখতে চায়।
সেন্সর বোর্ড
দেশীয় চলচ্চিত্রে যে অশ্লীলতা এর জন্যে সেন্সর বোর্ডও দায়ী। সেন্সর বোর্ড কেন ছাড়পত্র দেয় অশ্লীল চলচ্চিত্রের ?... অনেকে অবশ্য সেন্সর বোর্ডই তুলে দিতে বলেন। আমি এটা সমর্থন করি না। এতে হিতে বিপরীত হবে। একটা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই থাকা দরকার। মাথাব্যথার সমাধান মাথা কাটা হতে পারে না। ... সেন্সর বোর্ডকে পুনর্গঠিত করতে হবে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট লোকদের বেশি করে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। নীতিমালায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রেক্ষাগৃহ
দেশের প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশও একটি সমস্যা। নোংরা বাথরুম, ছবির প্রজেকশন ভালো না, সিট ভাঙা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে এসি বন্ধ থাকা, নিচু শ্রেণির দর্শকের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদির কারণে মধ্যবিত্ত দর্শক সপরিবারে ছবি দেখতে যাচ্ছে না। তবে সবচে’ বড় সমস্যা হচ্ছে, ভালো ছবির অভাব। ভালো ছবি যদি নিয়মিত মুক্তি পায়, তবে মধ্যবিত্ত দর্শকরাও নিয়মিত ছবি দেখতে যাবেন এবং প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশের উন্নতি ঘটবে। দর্শক-চাহিদার কারণেই এমনটি হবে।
ফিল্ম ইনস্টিটিউট
ভালো ছবি নির্মাণের জন্যে ভালো ও দক্ষ নির্মাতা দরকার। এই নির্মাতা সৃষ্টির জন্য দরকার একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট। সরকার যদি এফডিসিতে একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে, তবে দক্ষ পরিচালক ও কলাকুশলীর সৃষ্টি হবে। ভালো ও মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রও তখন আমরা পাব।
পুরস্কার
এই জীবনে আমি সরকারি পুরস্কারের মধ্যে পেয়েছি এফডিসির রজতজয়ন্তী ট্রফি। অন্য কোনো পুরস্কার নয়। এজন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। দর্শকদের ভালোবাসাই আমার কাছে বড় পুরস্কার।
পরিকল্পিত ছবি
একটি ছবি নির্মাণ করার পরিকল্পনা আমার রয়েছে। এই ছবিতে আমি এই সমাজের ছবি তুলে ধরব এবং তখন দর্শক-মনে এই প্রশ্ন জাগ্রত হবে—এই জন্যই কি আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম ? ছবির শেষে এ প্রজন্মের একদল তরুণ-তরুণী প্রতিকূল এ পরিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। নতুন সমাজ গড়ে তোলার কাজে মনোযোগী হবে তারা। ...এখনকার চারপাশের পরিস্থিতি আমাকে ভাবায়। এই ভাবনারই ফসল আমার এই পরিকল্পিত ছবি। এই ছবিটি নির্মাণ করতে পারলে আমি তৃপ্তি পাব।
Leave a Reply
Your identity will not be published.