মোহাম্মদ নজিবর রহমান : চরবেলতৈলের ক্ষণজন্মা পুরুষ

মোহাম্মদ নজিবর রহমান : চরবেলতৈলের ক্ষণজন্মা পুরুষ

এদেশের একটি সোনালি অতীত রয়েছে। স্বর্ণালি সেই অধ্যায়ে আলোকিত মানুষেরা বিচরণ করতেন। তাঁরা আপন প্রতিভার দ্যুতিতে নিজেদের জীবনকে যেমন উদ্ভাসিত করেছেন, তেমনি এদেশের মানুষকেও আলোকিত করার মহান ব্রতে থেকেছেন সচেষ্ট। এইসব মানুষের শেকড় অন্বেষনে অন্যদিন কাজ করে যাচ্ছে। সেই অন্বেষণেরই প্রতিফলন ঘটছে এই বিভাগে।

অন্যদিন-এর এই বিভাগে আগে তুলে ধরা হয়েছে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য সাহিত্যস্রষ্টাকে। ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভূমির পরিচয়ও উঠে এসেছে। এই সংখ্যায় তুলে ধরা হলো কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমানের জীবন ও জন্মভূমিকে। উল্লেখ্য, আগামী ২৩ অক্টোবর মোহাম্মদ নজিবর রহমানের ১০২তম মৃত্যুবার্ষিকী।

সিরাজগঞ্জের পথে পথে ঘুরছি আমরা। নগরে-প্রান্তরে। গ্রামে-গঞ্জে।

আমরা হাঁটছি শাহজাদপুরের ঘোড়শাল গ্রামের মেঠোপথের ওপর দিয়ে। আলোকিত মানুষদের শেকড় সন্ধানে ছুটে চলেছি। এই সূত্রেই ঘোড়শাল গ্রামে সাহিত্যিক বরকতুল্লাহর বাড়িতে এসেছিলাম আমরা। লক্ষ করেছি প্রয়াত সাহিত্যিকের পৈতৃক ভিটার বর্তমান দশা।

এখন আমরা চলেছি পাশের গ্রাম চরবেলতৈলে। এখানে জন্মছিলেন আরেক সাহিত্যিক—মোহাম্মদ নজিবর রহমান। জনপ্রিয় উপন্যাস-‘আনোয়ারা’-র লেখক। কবে ? এ নিয়ে অবশ্য নানা জনের নানা মত—কেউ বলেন ১৮৪৭, কেউ বলেন ১৮৫২, আবার কারও মতে ১৮৬০, এমনকি ১৮৭৮ সালের কথাও বলেন কেউ কেউ। তবে ১৮৬০ সালের আগে বোধহয় মোহাম্মদ নজিবর রহমান জন্মগ্রহণ করেন নি। যাহোক, তাঁর বাবার নাম জয়েন উদ্দিন (মতান্তরে আবেদউদ্দিন বা জোনাব আলী সরকার)। মা হালিমুন্নেসা (মতান্তরে বেগম সোনাবানু বা সোনাবিবি)। পূর্বপুরুষেরা তৎকালীন বাংলাদেশের রাজধানী মুর্শিদাবাদের অধিবাসী ছিলন। জনৈক পূর্বপুরুষ ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবের স্টেট ম্যানেজার। তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে নবাব পরিবারের জনৈক পরমা সুন্দরী বিধবা মহিলার সঙ্গে। একদিন তারা দু’জন পালিয়ে আসেন পাবনা জেলার মালতিডাঙ্গা গ্রামে। পরে নানা জায়গায় তারা আত্মগোপন করে থাকেন। এ সময় মির্জা উপাধির পরিবর্তে সরকার উপাধিতেই পরিচিত হন। তাদের পরবর্তী বংশধর অর্থাৎ জোনাব আলী সরকার শাহজাদপুর থানার অধীনে বেলতৈল গ্রামে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের মতে, নজিবর রহমানের পিতৃ-পরিবার কৃষিজীবী ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক ঘণ্টা পরে আমরা পৌঁছি চরবেলতৈল গ্রামে। এটাই মোহাম্মদ নজিবর রহমানের গ্রাম। মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন যাকে বলেছেন ‘বেলতৈল’। আসলে চরবৈলতৈল ও বেলতৈল পাশাপাশি দুটি গ্রাম। বোধহয়, বেলতৈল গ্রামেরই সম্প্রসারিত বসতি পরবর্তীকালে চরবৈলতৈল নামে আলাদা হয়ে গেছে।

চরবৈলতৈলের একটি মুদি দোকানের সামনে আমরা দাঁড়াই। জিজ্ঞেস করি মোহাম্মদ নজিবর রহমানের কথা। তৎক্ষণাৎ চিনতে পারে দোকানি। নজিবর রহমানের বাড়ির পথ বাতলে দেয়। দক্ষিণ দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, ওই ব্রিজটি পার হলেই আপনারা বাড়িটা খুঁজে পাবেন। শুকুর মাহমুদের বাড়ি বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে।

সত্যিই তাই, পাঁচ মিনিট পরে যখন আমরা ব্রিজটি পার হয়ে উঁচু মতন একটি জায়গায় পৌঁছাই, বিশ-বাইশ বছরের এক তরুণকে জিজ্ঞেস করা মাত্র সে বাড়িটি চিনতে পারে এবং নিজেই পালন করে পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা। তরুণটিকে অনুসরণ করে পৌঁছে যাই মোহাম্মদ নজিবর রহমানের পৈতৃক ভিটায়।

কয়েক বিঘা জমিজুড়ে বাড়িটি। নানা শরিকের মধ্যে বিভক্ত। আম, কাঁঠাল, নারকেলসহ বিভিন্ন ধরনের গাছে ঘেরা। টিনের তৈরি বেশ কয়েকটি ঘর এখানে-সেখানে অবস্থান করছে।

বাড়িটি উঁচু জায়গায় অবস্থিত—এ তো দেখতেই পাচ্ছি। কেন ? গবেষক-লেখক মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন তাঁর একটি গ্রন্থে লিখেছেন—‘১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সৌভাগ্যক্রমে আমি নজিবর রহমানের জন্মস্থান দর্শন করতে গিয়াছিলাম। এই গ্রামটি একটি নিচু বিলের পার্শ্বে অবস্থিত—চক্রাকারে। অদূরে একটি নদী প্রবাহিত রহিয়াছে।’ ধারণা করা যায়, নদীর পাশে বাড়ি ছিল বলেই ভিটা উঁচু জায়গায় অবস্থিত। এখন অবশ্য নদী অনেক দূরে সরে গেছে।

মনে পড়ে যায়, এই গ্রামের মিডল ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করতেন সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। ঘোড়শাল গ্রাম থেকে প্রতিদিন এখানে আসতেন। আর এই বাড়িতে যিনি জন্মেছিলেন—সেই মোহাম্মদ নজিবর রহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় শাহজাদপুর ছাত্রবৃত্তি বিদ্যালয়ে। পরে তিনি ঢাকা নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সঙ্গে ত্রৈবার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর বাংলা ভাষার ওপর তাঁর যে দক্ষতা আমরা লক্ষ করি—তা কি নর্মাল স্কুলের পরীক্ষা পাসের ফল স্বরূপ ? এ সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যায় না।...মোহাম্মদ নজিবর রহমানের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বেশিদূর এগোয় নি। আর্থিক অনটনের কারণে উচ্চ শিক্ষা লাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসি। লক্ষ করি বিশ্বজিৎ ছবি তুলতে শুরু করেছে। তার ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হতে শুরু করেছে মোহাম্মদ নজিবর রহমানের পৈতৃক ভিটার বর্তমান দশা। আমি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি। বিরাট বাড়ি। নানা অংশে বিভক্ত এই বাড়িটির ভেতরে ঘুরে বেড়াই। আমাকে ঘিরে ধরে নানা বয়সী মানুষেরা। বৃদ্ধ থেকে বালক। এক বালকের পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সে একটি লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। জানতে পারি, গাছ থেকে পতিত হওয়ার ফলে বালকটির পায়ের হাড় ভেঙে যায়। শাহজাদপুরের সরকারি হাসপাতাল থেকে তার পায়ের হাড় জোড়া লাগানো হয়েছে। কিন্তু ছেলেটি যে অবলীলায় এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার ব্যান্ডেজে লাগছে ধুলো-বালি—এদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই! সচেতনতা তথা শিক্ষার বড়ই অভাব। অথচ এই বাড়ির এক আলোকিত সন্তান—মোহাম্মদ নজিবর রহমান—শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী ছিলেন। তিনি এই গ্রামে একটি মক্তব স্থাপন করেন। পরে এটি তাঁর অনুপ্রেরণায় একটি আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এছাড়া সলঙ্গা ও হাটি কুমরুলেও স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

কয়েকজন প্রবীণ মানুষ নানা কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেন। আমিও মোহাম্মদ নজিবর রহমান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করি তাদের কাছে। কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেন না। তারা বলেন জনৈক শুকুর মাহমুদের কথা—যিনি বসবাস করেন শাহজাদপুরের চুন্নাখালি পাড়ার ইসলামী ভিলায়। তিনিই মোহাম্মদ নজিবর রহমান সম্পর্কে আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন—এমন দাবি করেন প্রবীণেরা।

এই বাড়িতে কারা থাকে এখন ? জবাব আসেÑমোহাম্মদ নজিবর রহমানের আপন ভাই এবং চাচাত ভাইয়ের ছেলে ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা থাকে এখানে। আর মোহাম্মদ নজিবর রহমানের স্থায়ী বসত-ভাটি হচ্ছে হাটি কুমরুল গ্রামে। সেখানকার মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন।

মোহাম্মদ নজিবর রহমানের উত্তরাধিকারী কারা ? হ্যাঁ, আমরা জানি যে, তিনি চারটি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী সাহেরা বানু ওরফে সাবান বিবি ছিলেন এই গ্রামের মেয়ে। মুনশী মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের কন্যা। বিয়ের সাত বছর পর নিঃসন্তান অবস্থায় তিনি মারা যাওয়ার পর নজিবর দ্বিতীয় বিয়ে করেন কুড়িগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে। অতঃপর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার তামাই গ্রামে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। আর চতুর্থবার বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তখনই—যখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রী মারা যান। চতুর্থ স্ত্রীর নাম, রহিমা খাতুন। মনে পড়ে যায়, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের যে জীবনী লিখেছেন মযহারুল ইসলাম—সেখানে নজিবরের চতুর্থ বিয়ে সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন—“শ্রুতি সাপেক্ষ যে, নজিবর রহমান ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাঁর এক প্রিয় ছাত্রের স্কুল পরিদর্শনে যান। তার এই ছাত্রের নাম মুনশী ওয়াহেদ আলী। স্কুল পরিদর্শনকালে তিনি উক্ত স্কুলের ছাত্রী মুনশী ওয়াহেদ আলীর পিতৃব্য বিত্তবান বাবু মুনশীর কন্যা নুরজাহান ওরফে আফরোজের রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহের প্রস্তাব করেন। কিন্তু ধনী পিতা পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গে পঞ্চদশ বৎসর বয়সী তরুণী কন্যার বিবাহ দিতে অসম্মত হন। এ কারণে উক্ত মর্যাদাবান পণ্ডিত নজিবর রহমানের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে এবং সেখানেই নুরজাহানের সহপাঠিনী মোহাম্মদ বদরুদ্দিনের কন্যা রহিমা খাতুনকে বিবাহ করেন।” কিন্তু নুরজাহানকে বোধহয় নজিবর রহমান ভুলতে পারেন নি। এই ঘটনার এগারো বছর পরে লেখা ‘গরীবের মেয়ে’ উপন্যাসের নায়িকার নাম নুরী আর তার স্বামীর নাম নুর মোহাম্মদ—নূরজাহানের নামের সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য। এটা কি কোনো ইঙ্গিত বহন করে ? যাহোক, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের তিন ছেলে ও চার মেয়ের কথা আমরা জানি—এর মধ্যে আমিনা বেগম ও গোলাম বতু দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত। তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা খাতুন, শিরতন্নেসা ও মীর মোহাম্মদ হায়দার রহমান। চতুর্থ স্ত্রীর গর্ভজাত ছিলেন হবিবর রহমান ও মমতাজ মহল।

চরবৈলতৈল গ্রামের মোহাম্মদ নজিবর রহমানের এই বসত ভিটায় আমরা এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হলো। এর মধ্যে কোনো নারী মুখ দেখতে পাই নি। পরিবারটি যে রক্ষণশীল আর মেয়েরা যে পর্দা রক্ষা করে—এটা বোঝা যায়। আমাদের মনে পড়ে যায় যে, মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত উপন্যাসের নায়িকাদের কথা। তাঁর উপন্যাসের নায়িকারা পর্দা রক্ষা করতেন। যদিও ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়—কাহিনির সূত্রপাত ঘটেছে নারী-হৃদয়ে প্রেমানুরাগ উন্মেষের ভেতর দিয়ে। পরপুরুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ তখনকার ধর্মীয় সংস্কারে অনভিতপ্রেত হলেও মোহাম্মদ নজিবর রহমান তা মানেন নি। আনোয়ারা তাদের বাড়ির খিড়কি দ্বারে বন্যার পানিতে ওজু করতে বসে শুভ্র-সুন্দর নুরুল এছলামকে দেখে মুগ্ধ হয়। তখনকার বর্ণনাটিও ঔপন্যাসিক বড় সুন্দরভাবে দিয়েছেন। “তখন অলক্ষিতে তাহার গোলাপ গণ্ড রক্তিমাভ হইয়া উঠিল, স্বেদবারি বিন্দু মুখমণ্ডলে ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। পাঠক, সোনার গাছে মুক্তাফল বুঝি ঔ রূপেই ফলে। বালিকা এখনি সেই দূর ভবিষ্যৎ আশার আলোকে নিজেকে ডুবাইয়া দিয়া অস্ফুট স্বরে বলিয়া উঠিল—তবে ইনিই কি তিনি ?” (প্রথম পরিচ্ছেদ : পূর্বরাগ পর্ব)

‘আনোয়ারা’ মোহাম্মদ নজিবর রহমানের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার অধিকারী একটি গ্রন্থ। আর এর কারণ হচ্ছে, এই গ্রন্থে লেখক সমাজে শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন, বহুবিবাহের কুফল, স্ত্রৈণ্যতার দোষ, স্ত্রী-শিক্ষার উপকারিতা, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর সমঝোতা, কুলগর্বের অন্তঃসারশূন্যতা, চাকরিজীবনের বিড়ম্বনা ও স্বাধীন ব্যবসায়ে সুখ, গ্রাম্য দলাদলি, স্বার্থান্ধর হিতাহিতজ্ঞানশূন্যতা, গুন্ডা-বদমায়েশদের ষড়যন্ত্র, প্রকৃত সতীত্বের গৌরব আর ধর্মজীবনের মাহাত্ম্য প্রভৃতি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সাধারণ মুসলমানদের কাছে তার যে গভীর আবেদন রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মোহাম্মদ নজিবর রহমানের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে—বিলাতী বর্জন রহস্য (১৯০৪), সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯০৪), চাঁদতারা বা হাসান গঙ্গা বাহমনি (১৯১৭), প্রেমের সমাধি (?), পরিণাম (১৯১৮), গরীবের মেয়ে (১৯২৩), দুনিয়া আর চাই না (১৯২৪), মেহের উন নিসা (?)

কে যেন আমার হাত ধরে টান দেয়। সংবিত ফিরে পাই। হ্যাঁ, শাহজাদপুর চরবৈলতৈল গ্রামে কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমানের পৈতৃক ভিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে স্পর্শ করেছে বিশ্বজিৎ। ওর কাজ শেষ। সে চোখের ইঙ্গিতে আমাকে সামনের দিকে এগুতে বলে।

আমরা বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সমুখে এগোই। কিছুদূর যাওয়ার পরে লক্ষ করি পথের ধারে একটি টিনের ঘর। তার সামনে ভিত্তিপ্রস্তর। সেখানে লেখা রয়েছে—‘নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন স্মৃতি পাঠাগার। চরবৈলতৈল গ্রাম, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন মাননীয় সংসদ সদস্য মোঃ কামরুদ্দীন এহিয়া খান মজলিস, ৩১. ১০.৯২।’ দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের অবস্থা এখন কেমন ? কৌতূহল জাগল। আমি ও বিশ্বজিৎ পাঠাগারের চত্বরে প্রবেশ করলাম। চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোকের মুখোমুঝি হলাম। তিনি জানালেন, এই পাঠাগারের শুধু ভিত্তিপ্রস্তরই স্থাপন করা হয়েছে। পাঠাগার কক্ষটি শূন্য। ব্যাপারটি অবাক করার মতোই। স্থানীয় এমপি ভদ্রলোক এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেন কেন ? এর কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না কারও কাছ থেকেই।

মোহাম্মদ নজিবর রহমানের নামাঙ্কিত পাঠাগারে কোনো বই নেই, কিন্তু মোহাম্মদ নজিবর রহমানের লেখা বই আজও এদেশের নানা পাঠাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। বইয়ের স্টলেও পাওয়া যায় কয়েকটি বই। এতে সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর কৃতিত্বই প্রকাশ পায়। যদিও তাঁর শিল্পজগৎ পাপ ও পুণ্য—এই দুই মোটা দাগে বিভক্ত হয়ে আছে। আর এক্ষেত্রে নজিবর রহমানের মানসাদর্শে গঠিত চরিত্রগুলো—নুরুল এছলাম (আনোয়ারা), চাঁদ (চাঁদ তারা বা হাসান গঙ্গা বাহমনি), মতি (প্রেমের সমাধি), আবুওল খয়ের (প্রেমের সমাধি), নূর মোহাম্মদ (গরীবের মেয়ে)—ঔপন্যাসিকের মতাদর্শ বহন করছে। তারা লেখকের হাতের পুতুল। তারা বাস্তব পৃথিবীর মানুষ নয়। কেননা তাদের চরিত্রে কোনো বিচ্যুতি নেই। তবে কখনো কখনো বিভ্রান্তি আছে। অন্যদিকে, নারী চরিত্রগুলোও নানা গুণে গুণান্বিত। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো—তারা সতী। আনোয়ারা (আনোয়ারা), মরিয়ম (প্রেমের সমাধি), নুরী (গরীবের মেয়ে), এরা সবাই সতীত্বের পরীক্ষায় ফুল মার্ক পাওয়া চরিত্র। এই নারী-পুরুষদের মধ্যে কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই। অন্যদিকে, অসৎ চরিত্রগুলো অনেক ক্ষেত্রেই টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়েছে। অনুশোচনায় ভুগেছে। কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে মানবিকবৃত্তির অভিপ্রকাশ ঘটিয়েছে।...‘চাঁদ তারা বা হাসান গঙ্গা বাহমনি’ ছাড়া মোহাম্মদ নজিবর রহমানের সবগুলো উপন্যাসই পারিবারিক ও সামাজিক। আর এইসব উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু গ্রাম। ফলে সঙ্গত কারণেই গ্রামের পরিবার ও সমাজ হয়েছে নজিবরের শিল্পের মূল উপকরণ। বলা যায়, মোহম্মদ নজিবর রহমান উপন্যাসে তাঁর চেনা জগতকেই মূর্ত করে তোলার চেষ্টা করেছেন।

মোহাম্মদ নজিবর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল স্বসমাজ মানে মুসলমান সমাজের উন্নতি। এক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এই শিক্ষা শুধু পুরুষের নয়, নারীরও। আরও লক্ষ করি, দুটি উপন্যাসের নায়ক স্কুলশিক্ষক—মতি (প্রেমের সমাধি) ও নূর মোহাম্মদ (গরীবের মেয়ে)। মোহাম্মদ নজিবর রহমান নিজেও ছিলেন তাই। আর তাঁর উপন্যাসের স্বামীরা এক-একজন শিক্ষক। নারীদের সতীত্ববোধের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নিয়েছে, আর এইসব শিক্ষণীয় প্রসঙ্গ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বহু বিবাহের কুফল নজিবর রহমান তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এটি বোধহয় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল।

আমরা জানি যে, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের শেষ জীবনটা সুখে কাটে নি। বড় ছেলের আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এমনি নানা কারণে তাঁর জীবনাবসান হয়। কবে ? জন্মসালের মতো এক্ষেত্রেও মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, ১৯২৩ সালের ১৮ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর মোহাম্মদ নজির রহমানকে হাটি কুমরুল গ্রামে তাঁর বাড়ির এককোণে কবরস্থ করা হয়।

আমরা আবার পথে নামি। চরবৈলতৈল গ্রাম পেছনে পড়ে থাকে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.