বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু কথা

বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু কথা

জীবনের চলার পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমরা অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হই। কেউ আসে, আবার কেউ চলে যায়। কিন্তু এমন অনেকেই আমাদের জীবনে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, তাদের বাদ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ভাবাই যায় না। আর তারা হলো আমাদের বন্ধু।

জীবনের প্রতিটি সময়ে বন্ধুরা আমাদের পাশে থাকে। যখন দুঃখে ভেঙে পড়ি, তখন তাদের সান্ত্বনা আমাদের মনকে শান্ত করে। যখন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হই, তখন তাদের উৎসাহ আমাদের আনন্দকে আরও দ্বিগুণ করে তোলে।

বন্ধুত্ব হলো পারস্পরিক স্নেহ, শ্রদ্ধা, এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি সম্পর্ক। এটি এমন একটি সম্পর্ক যেখানে ব্যক্তিরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি, সমর্থন এবং সহযোগিতা করে থাকে। বন্ধুত্বে পারস্পরিক বোঝাপড়া, আনন্দ ভাগাভাগি করা এবং কঠিন সময়ে একে অপরের পাশে থাকার বিষয়গুলি জড়িত। সততা এবং বিশ্বাস হচ্ছে বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি। যে কথাগুলো বাবা-মা, ভাইবোন কিংবা আত্মীয়স্বজনদের সাথে শেয়ার করা যায় না, সেই কথাগুলো অকপটে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যায়। বন্ধুরা হচ্ছে ওষুধের মতো। অসুস্থতার সময়ে বন্ধুরা যখন পাশে এসে দাঁড়ায়, অর্ধেক অসুখ ভালো হয়ে যায়। বন্ধুদের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যে-কোনো পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থাকা।

পকেটে টাকা থাকলে সমাজে অনেক স্বার্থপর বন্ধুর অভাব হয় না। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ওরা কেটে পড়ে। ছোটবেলায় ‘দুই বন্ধু ও ভাল্লুক’-এর গল্প আমরা প্রায় সকলেই শুনেছি। গল্পটি থেকে শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে যে, ‘বিপদের সময়ে প্রকৃত বন্ধুদের চেনা যায়’। আমরা বন্ধু নির্বাচনের সময় যেনো ভুল না করি, নতুবা ঠকতে হবে। 

‘দোস্ত পাতানো’ বা বন্ধু তৈরি করার সংস্কৃতি বাংলা সংস্কৃতিতে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। এটি সাধারণত ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্বের একটি বিশেষ সম্পর্ক বোঝায়, যা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গভীর হতে পারে। এই সংস্কৃতিতে বন্ধুত্বের জন্য আনুষ্ঠানিকতা বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বন্ধু নির্বাচন করা হতো বা ‘সই পাতানো’ (মেয়েদের মধ্যে) অথবা ‘দোস্ত পাতানো’ (ছেলেদের মধ্যে) নামে পরিচিত। আগেকার দিনে ‘দোস্ত পাতানো’ বা ‘সই পাতানো’ সংস্কৃতিতে বন্ধুত্বের জন্য অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গভীর এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠত। দোস্তালি কিংবা সই পাতানোর প্রথা আমাদের গ্রামাঞ্চলে বেশি প্রচলিত ছিল। 

ডাকযোগে পাঠানো চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন করার পুরোনো একটি মাধ্যম হচ্ছে পেনফ্রেন্ডশিপ। পেনফ্রেন্ডশিপ দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার মানুষের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করে, যা তাদের একে অপরের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। আগে কলম-বন্ধুদের জন্য ভালো বন্ধু পেতে একসময়ের জনপ্রিয় ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ম্যাগাজিনে পত্রমিতালীর বিজ্ঞাপনের জন্য একটি নির্দিষ্ট পাতা নির্ধারিত ছিল। সেখান থেকে পছন্দসই ঠিকানা সংগ্রহ করে কিশোর-কিশোরীরা পত্রমিতালি করত। 

পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ এসেছে। অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যিক একে অপরের বন্ধু ছিলেন। আমাদের সাহিত্যের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে কাজী নজরুল ইসলাম এবং মোতাহার হোসেনের বন্ধুত্বের বিষয়টি চলে আসবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের সম্পর্কের গোড়াপত্তন ঘটে ১৮৯৬ সালে। জগদীশচন্দ্র সার্থক বৈজ্ঞানিক সফর শেষে দেশে ফিরে এলে একগুচ্ছ ম্যাগনোলিয়া ফুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জগদীশ চন্দ্রের বাড়িতে বিজ্ঞানীকে অভিনন্দন জানাতে যান। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ফুলগুচ্ছ জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে রেখে আসেন। সেই থেকেই রবীন্দ্র-জগদীশের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের শুরু। ইংরেজ কবি কোলরিজ এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একে অপরের খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন। আবার টিএস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড পরস্পরের বন্ধু ছিলেন। আমাদের দেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ একে অপরের বন্ধু ছিলেন বা আছেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতায় বন্ধুত্ব বিভিন্ন পরিসরে স্থান পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে বন্ধুত্বের অবস্থান বেশ বড় পরিসরে রয়েছে। 

বন্ধুত্ব নিয়ে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে। লর্ড বায়রন তার কবিতার মাধ্যমে বন্ধুত্বকে আলাদা পরিসরে স্থান দিয়েছেন। চার্লস ডিকেন্স বন্ধুত্বের স্বরূপ নিয়ে অসাধারণ একটা উপন্যাস লিখেছেন। এটির নাম ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’। বন্ধুত্ব নিয়ে তার লেখা আরো দুটি উপন্যাস রয়েছে। এগুলো হলো ‘দি পিকউইক পেপারস’ এবং ‘দি গ্রেট এক্সপেক্টেটেশন’। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার লেখা জুলিয়াস সিজার, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এবং হ্যামলেটে বন্ধুত্বের চমৎকার স্থান দিয়েছেন। এভাবেই সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্ধু ও বন্ধুত্ব এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ব্যঞ্জনায়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বন্ধুত্ব 

সাদেক খান পরিচালিত ‘নদী ও নারী’-তে নজু মিয়া ও আসগরের গভীর বন্ধুত্বে চির ধরে এক নারীর জন্য। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর শত্রু হয়ে ওঠে। এর অবসান ঘটে নজু মিয়ার মৃত্যুতে। আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’-তে সুমিত ও অনিতার বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবিতে আমরা দেখতে পাই, বন্ধুত্বের জন্য মাসুম অর্থাৎ রাজ্জাক প্রেম ও একটি চোখের আলো বিসর্জন দিচ্ছে।

রাজ্জাক ও উজ্জলের বন্ধুত্বের ছবি ‘বন্ধু’ নির্মাণ করেন দিলীপ বিশ্বাস। জমিদারপুত্রের চরিত্রে অভিনয় করেন উজ্জল, দাসীর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের চিত্রনাট্যে ছবিতে দেখানো হয় শ্রেণিবৈষম্যের কাঁটা পেরিয়ে বন্ধুত্ব জয়ের গল্প। 

সৈয়দ শামসুল হকের গল্পে কিশোর অপরাধ নিয়ে দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুরস্কার’। সি বি জামানের পরিচালনায় ছবিতে ফুটে ওঠে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরদের জীবনযাপন ও তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বের গল্প।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলামের ছবি ‘দীপু নাম্বার টু’। ছবিতে দেখা যায়, মা-বাবার বিচ্ছেদের পর বাবার সঙ্গে থাকে দীপু। বাবার খেয়ালি মন আর চাকরির জন্য প্রায়ই নতুন স্কুলে ভর্তি হতে হয় দীপুকে। নতুন স্কুলে দীপুর পরিচয় হয় তারিকের সঙ্গে, মারামারি আর অকারণ ঝগড়া করা যার স্বভাব। ঘটনাচক্রে দীপু আর তারিক হয়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই জুটি পরাজিত করে দেশদ্রোহী এক ডাকাতদলকে। 

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে তৌকীর আহমেদের ছবি ‘দারুচিনি দ্বীপ’। তারুণ্যের জয়গান, ভালোবাসা, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেও ছবিতে ফুটে উঠেছে বন্ধুত্ব। রিয়াজ, জাকিয়া বারী মম, মোশাররফ করিম, বিন্দু, মামনুন ইমন, মুনমুনসহ বহু তারকাসমৃদ্ধ ছবিটি অনেকের প্রিয়। এছাড়া ‘সমাধি’, 'বন্ধু', ‘সূর্যকন্যা’, ‘বাল্যবন্ধু’ ‘দোস্ত দুশমন’, ‘জিঞ্জির’, ‘ভাইবন্ধু’, ‘বন্ধু আমার’, ‘লালুভুলু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘অভিযান’, ‘জাগো’সহ নানা ছবিতে বন্ধুত্ব মূর্ত হয়ে উঠেছে।

গানে বন্ধুত্ব

বন্ধুত্ব নিয়ে আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে। ‘নিথুয়া পাথারে...’ এই গানটি ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের হাত ধরে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর কথা ও সুর সংগৃহিত। ছবির গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু। পর্দায় গানটির সঙ্গে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। ছবিতে নতুন করে গানটির সংগীতায়োজন করেছেন অর্ণব ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ইকবাল এ. কবির।

‘তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও...’ গানটি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী জেমস। গানের প্রথম কথা হলো ‘তোমাদের মাঝে কেউ আছে বন্ধু আমার/ তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে পথ দেখা হবে বন্ধু...’। বন্ধুত্বের একটি আবেগঘন গান ‘দেখা হবে বন্ধু’। এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পার্থ বড়ুয়া। এর কথা লিখেছেন বেল নুর, সুর করেছেন পার্থ বড়ুয়া। এটি ‘দেখা হবে বন্ধু’ অ্যালবামের গান। এর কথাগুলো হলো ‘দেখা হবে বন্ধু কারণে আর অকারণে/ দেখা হবে বন্ধু চাপা কোনো অভিমানে/ দেখা হবে বন্ধু সাময়িক বৈরিতায় অস্থির অপারগতায়...’।

‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...’ বন্ধুদের নিয়ে ভারতের সংগীত শিল্পী মান্নাদের গাওয়া এই কালজয়ী গানটি মানুষ চিরদিন মনে রাখবে। 

বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু উক্তি

কখনো কোনো বন্ধুকে আঘাত কোরো না, এমনকি ঠাট্টা করেও না। সিসরো / বন্ধুত্ব একবার ছিঁড়ে গেলে পৃথিবীর সমস্ত সুতো দিয়েও রিপু করা যায় না। থমাস কার্লাইস / প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির নাম বন্ধুত্ব। এমারসন / একটি বই একশোটি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান। ডঃ এ.পি জে আব্দুল কালাম / অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়ে উত্তম। হেলেন কেলার / একজন সত্যিকারের বন্ধু তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অস্কার ওয়াইল্ড / বন্ধু হচ্ছে সূর্যের মতো, জীবনে যতই অন্ধকার আসুক না কেন আলো নিয়ে হাজির হবে। রেদোয়ান মাসুদ / প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়। Ñএরিস্টটল।

বন্ধুরা কখনো বন্ধুকে ছেড়ে যায় না

বন্ধুরা কখনো বন্ধুকে ছেড়ে যায় নাÑএই উক্তিটি জনপ্রিয় প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির। তিনি একটি টিভি চ্যানেলের একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে বন্ধুদের নিয়ে উপরোক্ত উক্তিটি করেছিলেন। হুমায়ুন ফরীদির এই অসাধারণ সুন্দর উক্তিটির সাথে আমার জীবনের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কথা বাস্তবে মিলে যায়। 

তখন আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি রংপুর জিলা স্কুল থেকে। শতাব্দী প্রাচীন এই স্কুলটিতে আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিলো মাত্র কয়েক মাস। এখানে আমার সাথে বিশেষভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ফরহাদ নামের একজন সহপাঠীর সাথে। সে স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো। দেশের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে। একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে ফরহাদকে স্কুলের হোস্টেলে না থেকে আমাদের বাসায় থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। সেই থেকে আমাদের দুই বন্ধুর বন্ধুত্বে নতুন মাত্রা যোগ পায়। ধীরে ধীরে সে আমাদের পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে যায়। ফরহাদ তার শিক্ষাজীবন শেষ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। অপরদিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীন জগন্নাথ কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে ওঈগঅই তে ভর্তি হই এবং পাশাপাশি টেক্সটাইল শিল্প ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি। সেই সময় টেক্সটাইল শিল্প ব্যবসার স্বর্ণযুগ চলছিলো। এই সুবর্ণ সুযোগটা আমি হাতছাড়া করি নি। তবে ফরহাদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। ঢাকায় ফরহাদের মাধ্যমে নতুন করে আবার যোগাযোগ হলো আমার রংপুর জিলা স্কুলের অনেক সহপাঠী বন্ধুদের সাথে। সেই যোগাযোগ এখনো রয়েছে।

এখানে বলে রাখি, ঘুরে বেড়ানো আমার অন্যতম একটি শখের বিষয়। সময়-সুযোগ পেলে ছুটির দিনগুলোতে আমরা দুই বন্ধু মোটরসাইকেলে করে দূর দূরান্তে ঘুরে বেড়াতাম। ফরহাদও ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসতো। আমাদের বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে ফরহাদকে সব সময় দাওয়াত করে খাওয়াতাম। আমাদের বাসার প্রতিটি রান্না সে অনেক মজা করে খেতো। ফরহাদের বাবা যখন ইন্তেকাল করেন, তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পর্বের ছাত্র। দিনাজপুর থেকে টেলিফোনে তার বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি কাল বিলম্ব না করে ঢাবির জসিমউদ্দীন হলে ছুটে গিয়ে ফরহাদকে দুঃসংবাদটি জানাই। অতপর তাকে আমার মোটরসাইকেলের পিছনে বসিয়ে সোজা ঢাকা বিমান বন্দরে চলে যাই। আমি বিমানের টিকেট কেটে ও পর্যাপ্ত নগদ টাকা ফরহাদের হাতে গুঁজে দিয়ে তাকে সৈয়দপুরগামী ডোমেস্টিক ফ্লাইটে তুলে দিই। সেইদিন সবকিছুই ঘটেছিলো মিরাকলভাবে। একটু দেরি হলে সে ফ্লাইট মিস করতো। ঢাকা থেকে গিয়ে বন্ধু ফরহাদ তার মৃত বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পেরেছিলো। একজন বন্ধুর বিপদের দিনে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর এই কাজটি আমার জন্য একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। আমার সকল সুখেদুঃখে ফরহাদকে সব সময় পাশে পেয়েছি। 

ফরহাদ তার চাকুরি জীবনে অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে ভালো বেতনে চাকরি করেছে। কিন্তু সে টাকা জমাতে পারে নি। নিজ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে সে কখনো পিছপা হয় নি। ছোটো ভাই,  ভাতিজাদের নিজ বাসায় রেখে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে, তাদের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে,  অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করিয়েছে। তার মধ্যে আমি লক্ষ করেছি ধার্মিকতা, সততা ও ন্যায়পরায়নতা। কখনোই তার মাঝে আমি খারাপ কিছু দেখি নি। পবিত্র কোরআন হাদিসের ওপর তার যথেষ্ট দখল ছিলো।  বিয়ে করেছে দিনাজপুর শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দুর্ভাগাক্রমে আমার এই বন্ধুটির স্ত্রী ২০১৯ সালে এক মেয়ে রেখে হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বন্ধুর এই বিপদের সময় আমরা স্কুলের বন্ধুরাই সবার আগে এগিয়ে আসি। সেই সময় ফরহাদের পকেটের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা থেকে বন্ধু স্ত্রীর মরদেহ দিনাজপুর শহরে পাঠানোর যাবতীয় খরচাদি আমরা বন্ধুরাই বহন করি। সপ্তাহখানেক পরে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ফরহাদ ঢাকার ভাড়া বাসায় ফিরে আসে। অসময়ে স্ত্রীকে হারিয়ে আমার এই বন্ধুর জীবনে নেমে আসে বড় ধরনের দুর্ভোগ ও শূন্যতা। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে মা-হারা মেয়েকে নিয়ে ফরহাদ দিন পার করছিল।

এদিকে ইংরেজি ২০২০ ও ২০২১ সালে আমাদের বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বেই ভয়াবহ আকারে করোনার আবির্ভাব হয়। সেইসময় একদিন আমার কাছে খবর আসে, ফরহাদ অসুস্থ হয়ে বাসায় শয্যশায়ী হয়ে পড়ে আছে। ওর বাসা আমাদের বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। গিয়ে দেখি তার মধ্যে করোনার লক্ষণসমূহ স্পষ্ট। কোভিড টেস্ট করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। পরের দিন তার কোভিড টেস্ট করার কথা। পরিস্থিতি আঁচ করে আমি আমাদের রংপুর জিলা স্কুলের সহপাঠী এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শ নিই। সে আমার মোবাইলের ওয়াটস্আপে কোভিড চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র পাঠিয়ে দেয়। আমি সেই মোতাবেক হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন, ওষুধপত্র, অক্সিমিটার, কিছু নগদ টাকা ও বাসায় রান্না করা খাবার নিয়ে ফরহাদের মেয়ের কাছে দুই দফায় দিয়ে আসি। আমাকে এইসব কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়েছে। এদিকে সময় যতই গড়াচ্ছিল ফরহাদের শরীরের অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছিল। আমি এদিকে ফরহাদের সম্ভাব্য করোনা আক্রান্তের খবর তার ভাই-ভাতিজাকে বারবার ফোনে জানিয়েও কারোরই কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ওরা একেকজন একেক রকম অপারগতার অজুহাত দেখাচ্ছিলো। সারা দিন শেষে রাত ৮টার দিকে আমাদের ডাক্তার বন্ধুটি আমাকে ফোন করে জানালো, অক্সিমিটারে ফরহাদের অক্সিজেন সেচুরেশন লেভেল ৮২-তে নেমে এসেছে। তাকে বাঁচাতে হলে কালবিলম্ব না করে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তা না হলে ওকে বাঁচানো যাবে না। আমি উপায়ন্তর না দেখে আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সহায়তা চাইলাম। ফরহাদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করলাম। পরিস্থিতি আঁচ করে ফরহাদের মেয়ে লুবাবা তার খালাকে ফোন করে ওর খালুকে বাসায় আসতে বলে। রাত ১০টার দিকে লুবাবার খালু গ্রীন রোড থেকে ওদের বাসায় এলে লোকজন ধরাধরি করে বহু কষ্টে ফরহাদের অচেতন দেহকে চারতলা থেকে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠায়। সেখান থেকে সরাসরি বাংলাদেশ মেডিক্যালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডিউটিরত ডাক্তররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাত ১১টায় ফরহাদকে মৃত ঘোষণা করে। ফরহাদের মৃত্যুসংবাদটি আমি তার ছোট ভাই হামিদকে ফোনে জানিয়ে দেই। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গাজীপুরের কাশিমপুরের বাসা থেকে ভাড়া করা গাড়িতে করে দ্রুত ঢাকায় চলে আসে হামিদ। এদিকে করোনা আক্রান্ত মৃত ফরহাদের লাশ গোসল দেওয়ার জন্য মোহাম্মদপুরের বাবর রোডস্থ আলমারকাজুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সকল আয়োজন শেষ করে আমার ভাড়া করা একই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দেশের বাড়ি রওয়ানা হতে তাদের রাত ৪টা বেজে যায়। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ও পথের যাবতীয় খরচের টাকা আমি একাই সেদিন বহন করেছি। টাকা নিয়ে কোনো চিন্তা প্রয়াত বন্ধু ফরহাদের ছোট ভাই হামিদকে আমি করতে দেই নি।  সেই রাতে স্কুলের বন্ধু ডা. মিজান ও আমাদের বাসার একটা মানুষও ঘুমায় নি। বন্ধুকে হারিয়ে আমি সেই রাতে অঝোরে কেঁদেছিলাম। পরের দিন বাদ জোহর জানাযা নামাজ শেষে ফরহাদকে দিনাজপুরে তার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে চিরশায়িত করা হয়। শেষ হয় ফরহাদ উপাখ্যান। নিজ জীবন বিপন্ন হতে পারে এই কথা জেনেও ফরহাদের জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বন্ধু হিসেবে আমি তাকে একা ফেলে যাই নি। সম্প্রতি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে। এতে বহু লোক হতাহত হয়। এক আহত কিশোর তার বন্ধুকে শ্রেণিকক্ষ থেকে আনতে যায়, ফায়ার বিগ্রেডের এক অফিসারের নিষেধ অমান্য করে। তখনো বন্ধুটি জীবিত ছিল। কিশোরটিকে দেখে সে হেসে বলে উঠেছিল, ‘আমি জানতাম তুমি আসবেই’। এটি ছিল তার শেষ কথা।

ইকো ফ্রেন্ডস ব্যাচ

বন্ধুত্বের অপর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমাদের  ‘ইকো ফ্রেন্ডস্ ব্যাচ-১৯৮০-৮১’। আমি ১৯৮৫ সালে জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) অর্থনীতি বিভাগ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তী সময়ে ভর্তি হই ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত ICMAB -তে। আমার মতো আমাদের অনেক সহপাঠী বন্ধু জগন্নাথ কলেজে মাস্টার্স পর্বে ভর্তি না হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে অন্যত্র ভর্তি হয়। বন্ধুদের কেউকেউ আবার উন্নত জীবন গড়তে বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেক দিন যাবৎ বন্ধুরা কে কোথায় আছে তা জানার কোনো উপায় ছিল না। মাঝেমধ্যে পথেঘাটে দুই-একজন বন্ধুর সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো, কথা হতো। তবে আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে আন্তরিকতার যে কোনো অভাব ছিল না এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি। বন্ধুরা কে কোথায় আছে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে আমাদেরই এক মহৎপ্রাণ বন্ধু হান্নান তালুকদার একাই মাঠে নামে। বিভিন্ন সূত্র থেকে নেওয়া বন্ধুদের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে একে একে হারানো বন্ধুদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে। কোথাও গিয়ে সে বন্ধুর দেখা পেয়েছে, আবার অন্য কোথাও গিয়ে কাক্সিক্ষত বন্ধুর দেখা কিংবা খোঁজ না-পেয়ে বিষণ্ন মনে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু সে হারানো বন্ধুদের খোঁজ পেতে হাল ছেড়ে দেয় নি। বিদেশি একটি কোম্পানিতে ভালো চাকরি করত হান্নান। দিনের পর দিন, বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে, কখনো বাসেÑকখনো রিকশায় কিংবা দীর্ঘপথ অলিগলিতে পায়ে হেঁটে আমাদের সেই মহৎপ্রাণ বন্ধুটিকে হারানো সহপাঠী বন্ধুদের খুঁজে বের করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। এই কাজটি কিন্তু এতো সহজ ছিল না। নব্বইয়ের দশকে এখনকার মতো মোবাইল ফোন, ফেইসবুক ছিল না যে সহজেই কারোর সাথে যোগাযোগ করা যাবে। হান্নান একদিন ঠিকানা যোগাড় করে আমাদের বাসায় এসেছিলো। আমি ও আমার স্ত্রী সেই সময় বাসায় ছিলাম না। সঙ্গত কারণে অপরিচিত হওয়ায় বাসার লোকজন তাঁকে ভেতরে বসতে বলে নি। বাড়ির দরজা থেকেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল। পরে বাসার লোকজন থেকে ওর নাম পরিচয় শুনে বুঝতে পেরেছিলাম হান্নান এসেছিল। সে কোনো ফোন নাম্বার না দিয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে তাঁর সঙ্গে সাথেসাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। হান্নান যে আমাদের বাসায় এসে না বসে, কিছু না খেয়ে দরজা থেকে চলে গিয়েছেÑএই  দুঃখ আমি সারাজীবন ভুলব না। পরে অবশ্য হান্নানের সাথে দেখা হলে বিনীতভাবে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম। বন্ধুরা ডাকলে তাদের মন রক্ষা করতে হয়। সেই বোধটুকু আমার সব সময়ই ছিল। পরবর্তী সময় হান্নান যখনই আমাকে রমনা রেস্টুরেন্টে বিকেলের আড্ডায় ডেকেছে, আমি উপস্থিত থাকতে চেষ্টা করেছি। আমরা কয়েকজন বন্ধু সেখানকার সবুজ মাঠে প্লাস্টিকের চেয়ারে গোল হয়ে বসে চা, শিঙারা / সমুচা খেতে থেতে গল্পে আড্ডায় মেতে উঠতাম। অনেক সুন্দর প্রাণবন্ত বিকেল কাটাতাম। রমনা রেস্টুরেন্ট ছাড়াও বাংলা মটরস্থ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের রুফটপ ক্যান্টিনের সামনে খোলা আকাশের নিচে পাতা চেয়ারে বসে আমরা ছুটির দিনগুলোতে প্রায়ই বসে সময় কাটাতাম। গল্প করতে করতে বিকেলের চা, নাস্তা খেতাম। সেই আড্ডা আমাদের এখনো মাঝেমধ্যে চলে। দুঃখের বিষয়, হান্নান জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বিগত ইংরেজি ২০২২ সালের ২৭ রমজানের রাতে না-ফেরার দেশে চলে গেছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে ১৯৯৩ সালের দিকে হাতে গোনা কিছু খুঁজে পাওয়া বন্ধুদের নিয়ে হান্নান ঢাকার রমনা রেস্টুরেন্টে প্রথমবারের মতো দুপুরের লাঞ্চ ও গেটটুগেদারের আয়োজন করেছিলো। আমার অন্যত্র জরুরি কাজ থাকায় উক্ত অনুষ্ঠানে আমি সেদিন উপস্থিত থাকতে পারি নি। এই আফসোস আমার মনে এখনো রয়ে গেছে। আমাদের ইকো ফ্রেন্ডস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হান্নান অসুস্থ হওয়ার পর থেকে গ্রুপের কাজ চালিয়ে নেওয়া, বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় আমাদের আরেক মহৎপ্রাণ বন্ধু মাহবুবুর রহমান। আমাদের ইকো গ্রুপ প্রতিষ্ঠায় হান্নানের পরে মাহবুব, ওয়ারেস, পবন, শহীদ, মুহিব, জলিলসহ আরও কিছু ত্যাগী বন্ধুদের অবদান আমি কৃতজ্ঞতার সাথে আজীবন স্মরণ করব। 

আমাদের অর্থনীতি বিভাগের সহপাঠীর সংখ্যা কতো ছিল তার সঠিক তথ্য আমার জানা নাই। তবে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের কতিপয় বন্ধু এখনো সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার সুবিধার্থে আমাদের বন্ধু ওয়ারেসের আইডিয়াতে বিগত ২০২৩ সালে মাহবুবকে এডমিন করে ‘Eco Friends Batch-1980-81’ নামে একটি WhatsApp গ্রুপ চালু করা হয়। বর্তমানে আমাদের গ্রুপ সদস্য ৭৫ জন। একই বছর আমাদের আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু পবনের স্পন্সরশীপে ও ওয়ারেস,  মাহবুব, শহীদ,  মুহিব, নিজাম, মোমিনসহ আরও কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে জিন্দা পার্ক রিসোর্টে ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে ‘Eco Friends Batch-1980-81’ ব্যানারে আমরা প্রথমবারের মতো দিনব্যাপী একটি বর্ণাঢ্য পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সক্ষম হই। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমেরিকা প্রবাসী আমাদের কয়েকজন বন্ধুও এসেছিলো।  ২০২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রামে মহাসড়ক ঘেঁষা ‘মেঘনা রিসোর্টে’ আমরা বন্ধুরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আনন্দঘন একটি বার্ষিক বনভোজনের আয়োজন করি। 

আমাদের অর্থনীতি বিভাগের বন্ধুরা বর্তমানে একটি পরিবারের মতো হয়ে গেছি। আমাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও গভীর মমত্ববোধ। আমাদের সন্তানেরা দেশে ও প্রবাসে সবাই শিক্ষা জীবনে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়।

বন্ধুত্বের কোনো বয়স সীমানা নাই। এই বিষয়টি বিবেচনায় এনে আমাদের ইকো ফ্রেন্ডস্ গ্রুপে ইতিমধ্যেই আমাদের সন্তানদের ও নাতি-নাতনিদের গ্রুপের সদস্য করে নিয়েছি। আমাদের WhatsApp গ্রুপে ওদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের দারুণভাবে আনন্দিত করে। আমরা ওদের ‘জুনিয়র ইকো বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে থাকি। আমাদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে প্রায় চার দশক আগে। এতগুলা বছর অতিবাহিত করার পরেও আমরা সহপাঠী বন্ধুরা এখনো যে বিরল ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছি, এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা বড় প্রাপ্তি। 

বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক যার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই, নেই কোনো দান-প্রতিদানের ব্যাপার। জগতের বিশুদ্ধতম সম্পর্ক ‘বন্ধুত্ব’। আগামীকাল ৩ আগস্ট বিশ্ব বন্ধু দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে আমার আজকের এই রচনা। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিন হোক বন্ধু দিবস!

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.