জন্মশতবর্ষে গুরু দত্ত

জন্মশতবর্ষে গুরু দত্ত

[ভারতের স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার-অভিনেতা গুরু দত্ত। চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। গত ৯ জুলাই ছিল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে এই রচনাটি পত্রস্থ হলো।]

গুরু দত্তের জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ জুলাই। আসল নাম বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন। কোঙ্কনী চিত্রপুর সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান গুরু দত্তের বাবা ছিলেন হেডমাস্টার (পরে ব্যাংককর্মী)। বাবা শিবশঙ্কর, মা বাসন্তী। তাঁদের সম্পর্কের টানাপোড়েন, মামার আচরণ আর সাত মাসের ভাই শশীধরের মৃত্যু গুরু দত্তের ভবিষ্যতের নকশা তৈরি করে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে সৃষ্টিতে রূপান্তরের ললাটলিখন শৈশবেই গুরু দত্তের হয়ে গিয়েছিল।

 

ছায়ার উৎস আলো। চাঁদের বিপরীত পিঠের মতো ছায়ার রহস্য আলো দিয়ে ব্যাখ্যা করার অভিজ্ঞান শৈশবেই পেয়ে গিয়েছিলেন গুরু দত্ত। শৈশব কেটেছে কলকাতায়। মেধাবী ছাত্র। কিন্তু অর্থাভাবে কলেজে যেতে পারেন নি। যোগ দেন উদয়শঙ্করের নাচের দলে। ১৯৪১ সালে আলমোড়ায় ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে গুরু দত্ত যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। বছরে ৭৫ টাকার (তখনকার দিনে অনেক টাকা) বৃত্তি পেতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪৪ সালে, এই পর্বের সমাপ্তি।

প্রথমে কাজ পেয়েছিলেন কলকাতায়, টেলিফোন অপারেটরের। ছেড়ে দিয়ে বম্বেতে মা-বাবার কাছে চলে যান। গুরু দত্তের কাকা তাঁর জন্য কাজের খবর আনলেন, পুণের প্রভাত ফিল্ম কোম্পানিতে। এই কোম্পানি ছেড়ে ভি শান্তারাম ততদিনে তাঁর ‘কলামন্দির’ তৈরি করে ফেলেছেন। এখানেই দুই অভিনেতা রহমান ও দেব আনন্দের সঙ্গে গুরু দত্তের পরিচয়—যা দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল।

ছোট চরিত্রে অভিনয়, সহকারী হিসেবে পরিচালনা, কোরিওগ্রাফি; এখান থেকেই সিনেমাজগতে গুরু দত্তের সূচনা। প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর গুরু দত্ত বেকার হয়ে যান। এই পর্বেই তিনি প্রায় আত্মজীবনীমূলক ‘পিয়াসা’-র স্ক্রিপ্ট লেখেন।

 

গুরু দত্তের প্রথম ছবি ‘বাজি’। নবকেতনের ব্যানারে ১৯৫১ সালে মুক্তি পায়। দেবানন্দ গুরু দত্তকে বলেছিলেন, তিনি কখনো প্রযোজক হলে গুরু দত্তকে পরিচালক করবেন। আর গুরু দত্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি কখনো ছবি করলে নায়ক হবেন দেব আনন্দ। ‘বাজি’-তে কথা রেখেছিলেন দেব আনন্দ। ‘সিআইডি’-তে তাঁকে নিয়েছিলেন গুরু দত্ত, প্রযোজক ছিল গুরু দত্ত মুভিজ, তবে পরিচালনা তাঁর সহকারী রাজ খোসলার। ফলে টেকনিক্যালি দেখলে গুরু দত্ত কথা রাখেন নি। ‘বাজি’-তে ক্লোজ শটের আশ্চর্য ব্যবহার করেন গুরু দত্ত। ভারতীয় ছবিতে ক্লোজ শটে নিজের স্বাতন্ত্র্য তৈরি করেন তিনি। এই ছবিতেই নিজের ভাবী স্ত্রী গীতা রায়ের সঙ্গে গুরু দত্তের পরিচয়।

‘বাজি’ মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে হিট। ‘জাল’ ও ‘বাজ’ মোটামুটি; ‘আর পার’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫’, ‘সি আইডি’, ‘সৈলাব’, ‘পিয়াসা’-য় ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। জনি ওয়াকার, ভি কে মূর্তি, আব্রার অলভিকে নিয়ে টিম তৈরি হলো গুরু দত্তের। আঘাতটা এল ১৯৫৯ সালে ‘কাগজ কে ফুল’-এ। নায়িকা-পরিচালক সম্পর্কের রসায়ন দর্শক নিল না। নায়িকা ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক পরবর্তীকালে গুরু দত্ত-গীতা দত্তের দাম্পত্যে গভীর প্রভাব রেখে গেছে। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’ দর্শক-সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু ততদিনে বক্স অফিসে ব্যর্থতা চরম আকার ধারণ করেছিল। ‘চৌধব কা চাঁদ’-এ সেই ব্যর্থতা আরও প্রকট হয়।

আমরা জানি, দেশভাগের অসহ্য যন্ত্রণা ঘুরেফিরে এসেছে ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে। সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এমনকি যৌথ নির্জনের আর্কিটাইপ অতিক্রম করে শিল্পী ঋত্বিকের প্রশ্ন ছিল, উদ্বাস্তু! উদ্বাস্তু কে নয় ?

গুরু দত্তের জীবননাট্যও তিনটি ছবিতে অনুপ্রবেশ করেছে—পিয়াসা, কাগজ কে ফুল, সাহেব বিবি অউর গোলাম। এ একরকম আত্মধ্বংসেরই ধারাবিবরণী।

‘পিয়াসা’ আর ‘কাগজ কে ফুল’-এর হিরোর জন্ম রোমান্টিক ধারণা থেকে যে, তারা সৃষ্টিশীল এবং তাদের মাথার চারপাশে প্রতিভার জ্যোতি ঠিকরে বের হচ্ছে। সমাজ যা চায় কবিকেও সেটাই করতে বাধ্য করে। একে জব্দ করতে না পারলে কবিকে সে পূজার ছলে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। স্বয়ং কবিকে তারই স্মরণসভায় এনে হাজির করে। যেমনটা ঘটেছে ‘পিয়াসা’-য়। কবি তখন বহুজন পরিবৃত এবং পরিত্যক্ত। ‘কাগজ কে ফুল’-এর সুরেশ সিনহা তাই। শুধু গণিকা, ড্রাইভারের হৃদয় কবিকে বুঝতে পারে। রোমান্টিক মননের বিক্রয়মূল্যের নাম সাফল্য। তাই সাফল্য আসলে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এই অসুখ থেকে বাঁচতে হলে সমাজ ছেড়ে পালাতে হবে, নয়তো নিজেকে শেষ করে দিতে হবে। 

শুরু দত্তের ছবিতে বারবার এসেছে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর চিত্রকল্প। ‘পিয়াসা’-য় নিজের স্মরণসভায় বিজয় আসে—সে যেন যিশুর নবজন্ম।

‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ ও ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’—তিনটি ছবিতেই আলোর আশ্চর্য প্রয়োগ। চরিত্রের একপাশে আলো পড়ে, অন্যপাশে বাক্সময় অন্ধকার। এছাড়া আছে সিনেমাস্কোপের (ভারতীয় ছবিতে সেই প্রথম) ব্যবহার এবং দৃশ্যের গভীরতা। চরিত্রের একক নিঃসঙ্গতা প্রকট হয়ে ওঠে। দর্শক কারিগরি জ্ঞান ছাড়াই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান নিজের অজান্তে। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এও তাই। চরিত্ররা মদ খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ মাতাল হয়ে প্রতিবাদ জানায়, কেউ মাতালই হয় না। কেননা ভালো না বাসতে পারলে মদ খাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায় না। এই যোগ্যতা এবং ভালোবাসায় তিনটি ছবিতেই আশ্রয়হীনতার কথা আছে। সেই সঙ্গে খাবার আর পোশাকের মালিন্য। পৃথিবীর হিংস্র পেরেক যাকে গেঁথে ফেলতে চায় (চ্যাপলিনের লাইমলাইট-এর মতো), সে-ই বলতে পারে, জগৎ আসলে আয়নানির্মিত। স্বচ্ছ। কিন্তু প্রতিবিম্বিত। সিনেমা জীবন থেকে তৈরি নাকি জীবন সিনেমা থেকে, এমন প্রশ্নে হতবাক হয়ে যেতে দর্শক বাধ্য। তথাকথিত মুক্ত মানুষের মুক্তির খোঁজে অভিযাত্রার সংকল্প গুরু দত্তের এই তিনটি ছবিতে এসেছে। চরিত্রগুলো হাঁটাচলা করতে করতে বুঝেছে যে পরিচালনার কঠিন নিয়ন্ত্রণে থেকেও তারা স্বাধীন। তারা আসলে হাসপাতালের মতো নিয়মনীতি মানতে বাধ্য। কেননা বেঁচে থাকার পরম্পরায় হাসপাতাল একদিন না একদিন আসবেই। জীবনের আনন্দকে ভরা-ভর্তি বোতলে পুরে শুতে যাওয়ার প্রাত্যহিকে অভ্যস্ত দর্শক এই তিনটি ছবি দেখলে বুঝবেন, ঘুমের ভেতর মধুর আতঙ্কে তার দাঁতে দাগ পড়ে গেছে। তাতে শ্রান্তি আছে, ক্লাস্তিও আছে। আর আছে তৃষ্ণা।  

১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর গুরু দত্তকে তাঁর মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে মৃত পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, মদ আর ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তিই তাঁর মৃত্যুর কারণ। এই মৃত্যু একটি রহস্য রেখে গেছে পেছনে। হয়তো একটু বেশি ঘুমোতে চেয়েছিলেন গুরু দত্ত। অথচ পরদিনই ছিল মালা সিনহা ও রাজ কাপুরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আব্রার অলভি আর গুরু দত্ত—এই দুজনই আত্মহত্যার সঙ্গে এক ইনিংস খেলে হেরে গিয়েছিলেন। নিজেদের মধ্যে আত্মহত্যা নিয়ে খোশগল্পও করতেন। জানা যায়, সেদিন মধ্যরাতে আশা ভোঁসলেকে ফোন করেছিলেন গুরু দত্ত। স্ত্রী গীতা দত্তের সঙ্গেও হয়েছিল শেষ কথাবার্তা। 

গুরু দত্তের ছিল দ্বৈত সত্তা—কাজের ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা কিন্তু ওলটপালট ব্যক্তি জীবন। তিনি কাছের বন্ধুদেরও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলতেন না, তবে আসল খ্যাতি পেলেন মৃত্যুর পর। যে ‘কাগজ কে ফুল’-কে তিনি ফ্লপ দেখে গিয়েছিলেন, সেটাই হয়ে গেল চিরকালের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র। এ ছবিতে মানের সঙ্গে আপস করবেন না বলে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢেলেছিলেন গুরু দত্ত। ছবি ফ্লপ হওয়ায় আর্থিকভাবে ভীষণ বিপদে পড়েন। কাছের বহু মানুষের আসল রূপ এই সময় গুরু দত্ত দেখতে পান। হ্যাঁ, তিনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সময়ের যন্ত্রণাকে অস্বীকার করতে পারেন নি। তাই নায়ক হয়েও তিনি রক্তমাংসের মানুষ, যিনি নিজের মর্মান্তিক পরিণতি নিজেই রচনা করেছিলেন।

গুরু দত্ত চলচ্চিত্রে দুঃখকে শিল্পে রূপান্তর করেছিলেন। আর মৃত্যুর প্রতি ছিল তাঁর টান। তাই তিনি দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। জীবনের শেষ রাতেও সেই চেষ্টাই অব্যাহত ছিল। তিনি আকণ্ঠ মদ পান করেছিলেন। ঘুম না আসায় খেয়েছিলেন অত্যধিক ঘুমের ওষুধ। পরদিন তাই দরজা ভাঙার পরে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

আসলে ব্যক্তিগত জীবন ও চলচ্চিত্রে ক্রমাগত ব্যবসায়িক ব্যর্থতা গুরু দত্তকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের জালে জড়িয়েছিলেন যে নায়িকার সঙ্গে, সেই ওয়াহিদা রহমান তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সাংসারিক অশান্তির কারণে স্ত্রী গীতাও তিন সন্তান নিয়ে আলাদা থাকছিলেন। সবমিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন গুরু দত্ত।

ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে ফর্মুলাভিত্তিক হিন্দি ছবির চেনা পথ ছেড়ে গুরু দত্ত ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। সেই পথ ছিল দুর্গম।  আর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাঁকে আর তাঁর চলচ্চিত্রকে সেকালের সাধারণ দর্শক বুঝতে পারে নি। আর সেটাই স্বাভাবিক। পরে অবশ্য হিন্দি চলচ্চিত্রের দর্শকেরা ঠিকই মূল্যায়ন করেছিল গুরু দত্তকে।

জন্মশতবর্ষে গুরু দত্তকে শ্রদ্ধা।

 

 

বক্স

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

বাজি (১৯৫১), জাল (১৯৫২), বাজ (১৯৫৩), আর-পার (১৯৫৪), মিস্টার এন্ড মিসেস ৫৫ (১৯৫৫), সিআইডি (১৯৫৬), পিয়াসা (১৯৫৭), ১২ ০’ ঈষড়পশ (১৯৫৮), কাগজ কে ফুল (১৯৫৯), চৌধব কা চাঁদ (১৯৬০), সাহেব বিবি আউর গোলাম (১৯৬২)।

 

 

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.