গত ২৪ জুলাই ছিল উত্তমকুমারের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮০ সালের এই দিনে তিনি না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু আজও তিনি বাঙালির প্রিয় নায়ক। যদিও তিনি এলাম দেখলাম জয় করলাম এ দলের লোক ছিলেন না। প্রচণ্ড পরিশ্রম এবং কঠিন অনুশীলনের দরুনই সাফল্য তার হাতে ধরা দিয়েছিল।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা একটু পেছনের দিকে তাকাই, উত্তমকুমারের বর্ণাঢ্য জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করি।... ।
ভবানীপুরের সেই ছেলেটি
উত্তমের জন্ম কলকাতায়, ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে, আহেরীটোলা স্ট্রীটে, মামার বাড়িতে। পৈতৃক বাসস্থান ভবানীপুরে। সেখানেই তার শৈশব-কৈশোর এবং তারুণ্যের দিনগুলো কেটেছে।
উত্তম স্কুলে পড়া অবস্থায় নাটকে অভিনয় করেন। পুরস্কার পান। সাঁতার কেটেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, মেডেল পেয়েছেন। এছাড়া কুস্তি লড়া, ব্যাডমিন্টন-ফুটবল খেলাতেও উত্তমের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় উত্তমের নেতৃত্বে তার পাড়াতে বের হতো স্বদেশী প্রভাতফেরি। সেই সময়ে নিজের লেখা গান নিজের সুরে গাইতেন উত্তম।
১৯৪৬-এ মেজ মামা গৌরীশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সূত্রে পোর্ট কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে দু’শ পঁচাত্তর টাকা মাইনের ক্যাশিয়ারের চাকরি জোটে। জীবনসংগ্রামের এই কঠিন সময়ে চক্রবেরিয়া (সাউথ) ‘মনোরমা’ স্কুলে গানের শিক্ষকতাও করেন উত্তম।
চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ
পাড়ার থিয়েটার ক্লাবের পরিচিত ভদ্রলোক গণেশ ব্যানার্জীর সূত্রে উত্তম ১৯৪৭ সালে অভিনয় করেন ‘মায়াডোর’ (ছবিটি মুক্তি পায় নি) হিন্দি ছবিতে। এই ছবির জন্য ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে পাঁচদিনের কাজ করেছিলেন। পারিশ্রমিক দৈনিক পাঁচ সিকি। প্রথমদিনের দৃশ্যটি ছিল এরকম—বর সেজে বিয়ে করতে বসেছেন তিনি, তাকে মেরে বিয়ের আসর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘মায়াডোর’-এর পরে উত্তম ওরফে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে—নায়ক অসিত বরণের ছোটবেলার চরিত্রে। এরপরে ‘ওরে যাত্রী’ ছবিতে জীবনে প্রথম বড় ভূমিকায় (একজন আর্মি অফিসারের চরিত্র) অভিনয়ের সুযোগ পান উত্তম। পরের বছর এল আরও বড় সুযোগÑ‘কামনা’ ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের। কিন্তু ‘কামনা’ ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হলো। ফলত পরবর্তী ছবি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো। অবশেষে পাওয়া গেল ‘মর্যাদা’ ছবির নায়কের রোল। অরুণ কুমারের স্থলে নতুন নামকরণ হলো অরূপ কুমার। কিন্তু ‘মর্যাদা’ও ফ্লপ হলো। স্টুডিও পাড়ায় অরুণের (উত্তম) তখন ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ হিসেবে বদনাম জুটে গেছে। এরই মধ্যে এমপি প্রোডাকশন্সের এক্সক্লুসিভ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন। মাসে পাঁচ শ’ টাকায় চুক্তি হলো। পোর্ট কমিশনারসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরিভাবে চলচ্চিত্রে আত্মনিয়োগ করলেন। এমপি’রই ‘সহযাত্রী’ ছবিতে আবার নামের পরিবর্তন হলো, ডাকনাম ‘উত্তম’-ই টাইটেলে গেল। সেই থেকে উত্তমকুমারের জন্ম হলো। উল্লেখ্য, ‘সহযাত্রী’ ছবিতে উত্তমের কিছুটা খ্যাতি জুটেছিল, কিন্তু তা স্থায়ী হয় নি। কেননা পরপর তিনটি ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
বসু পরিবার থেকে অগ্নিপরীক্ষা
অভিনেতা হিসেবে প্রথম উত্তমকুমার স্বীকৃতি পেলেন নির্মল দে পরিচালিত ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। এই ফ্যামিলি ড্রামাতে বড়ভাইয়ের চরিত্রে উত্তমের অভিনয় সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এরপরের ছবি ‘কাপ পাপে ?’ উত্তমের কেরিয়ারে নতুন কিছু সংযোজন করে না। তবে তার পরের ছবি নির্মল দের ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ উত্তম-সুচিত্রা প্রথম রোমান্টিক জুটি হিসেবে কিছুটা খ্যাতি কুড়ায়। অবশ্য ‘লাখ টাকা’ ও ‘নবীন যাত্রা’ (১৯৫৩)-তে অভিনেতা হিসেবে উত্তমের কিছু করণীয় ছিল না। তবে নরেশ মিত্র’র ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের এই চলচ্চিত্ররূপটির পর উত্তমের অভিনয়ের ধারা পাল্টে যায়।
১৯৫৪ সালের প্রথমার্ধ্বে মুক্তি পায়—ওরা থাকে ওধারে, চাঁপাডাঙার বৌ, কল্যাণী, সদানন্দের মেলা এবং অন্নপূর্ণার মন্দির। এই ৫টি ছবির মধ্যে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ ‘চাঁপাডাঙার বৌ’-এ মহাতপ চরিত্রে উত্তমের অভিনয় সবার মনে দাগ কাটে। বলা যায়, চরিত্রের সহজ সরল গ্রাম্য স্বভাবটা অতি স্বচ্ছন্দে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তবে উত্তমের জয়যাত্রা শুরু হয় সত্যিকার অর্থে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। অগ্রদূত ওরফে বিভূতি লাহা পরিচালিত এ ছবি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি দারুণ সাড়া ফেলে। ‘অগ্নিপরীক্ষার’-র মাধ্যমে দুজন বড় স্টার হলেন। বাংলা ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ আবার ফিরে এল। বাংলা ছবির দিকে আবার তারা মুখ ফেরালেন।
মঞ্চাভিনেতা
১৯৫৩ সালে পুজোর সময় উত্তমকুমার ‘শ্যামলী’ নাটকের নায়করূপে স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। তারপর দুই বছর দুই মাস তিনি এ নাটকে অভিনয় করেন। শ্যামলী চলাকালীন শেষের দিকে তিনি চলচ্চিত্রের কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে মঞ্চাভিনয় থেকে সরে আসতে হয়। উল্লেখ্য, ‘শ্যামলী’ নাটকে উত্তমকুমারের অভিনয় দেখে ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা অভিনেতা দম্পতি স্যার জন লুইস কেসন্ এবং ডেম সিবিল থ্রন্ডাইন ভূয়সী প্রশংসা করেন। উল্লেখ্য, মঞ্চের অভিজ্ঞতা উত্তমের চলচ্চিত্র অভিনয়ে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। অভিনেতা হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে।
চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের ধারণা, উত্তমকুমার মঞ্চে যদি আরও কিছুকাল অভিনয় করতেন তাহলে মঞ্চেও তিনি হতেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক।
নানা ছবি নানা চরিত্র
উত্তম নায়ক হিসেবে সর্বোত্তম এই কারণে যে তিনি বৃত্তাবদ্ধ অবস্থায় তথা অভিনয়ের কোনো বিশেষ ঢং (কমেডি বা ট্রাজেডি)-এর জন্য বিশিষ্ট নন। তিনি সব ধরনের চরিত্রেই ছিলেন সমানভাবে পারদর্শী। সেটা ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ভূতনাথ হোক বা এন্টনি ফিরিঙ্গি হোক, ‘বিচারক’-এর অপরাধী মন বিচারক, ‘ধন্যি মেয়ে’-র কৌতুক চরিত্র হোক, কলংকিত নায়ক চরিত্র হোক ‘কলংকিত নায়ক’-এর, ‘স্ত্রী’-র নারী বিলাসী সামন্ততন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু প্রতীক হোক।
‘হ্রদ’ ছবিতে অভিনয় করে উত্তম প্রশংসিত হন। সমালোচক লিখলেন : “উত্তমকুমার স্মৃতিভ্রষ্ট একটি যুবকের চরিত্রে প্রথম আবির্ভাব থেকেই দর্শক মনে এমন একটা সম্মোহনী প্রভাব বিস্তার করেন যে ছবি খানিকদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কোনো দৃশ্যে ওঁকে না পেলে দর্শকমন উদগ্রীব হয়ে ওঠে।”
অজয় ও বিজয়—দুটি বিপরীতধর্মী চরিত্রে যে অপূর্ব অভিনয় ক্ষমতা উত্তম ‘তাসের ঘর’ ছবিতে দেখালেন তাতে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখা হলো : “উত্তমকুমারই এ ছবির সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ”। উল্লেখ্য, পেশাগত সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে এক জনপ্রিয় চিত্রাভিনেতার নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা উপলব্ধির কাহিনি ‘নায়ক’ উত্তমকুমারের চলচ্চিত্র উপযোগী অভিনয়ে সমৃদ্ধ।
‘বিকেলে ভোরের ফুল’-এর মধ্যবয়সী অবিবাহিত ইঞ্জিনিয়ার-কবির চরিত্রে কিংবা ‘যাদুবংশ’-এ গণনাথের চরিত্রে যে আশ্চর্য অভিব্যক্তি তা অবিস্মরণীয়। একইসঙ্গে একটি গভীর মমতাময় ভালোবাসা আবার নির্মোহ নির্লিপ্ততা দর্শকের মনকে দারুণভাবে অভিভূত করে। কিংবা ‘চিড়িয়াখানা’-তে সত্য অনুসন্ধানী ব্যোমকেশ-এর চরিত্র কিংবা ‘নগর দর্পণে’-র নগর সভ্যতার শিকার এক যন্ত্রণাকাতর মানুষের প্রতিচ্ছবি সেলুলয়েডে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এমনিভাবে ‘রৌদ্রছায়া’, ‘বড়দিদি’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘লালপাথর’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘মৌচাক’, ‘রাজবংশ’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘সব্যসাচী’, ‘অমানুষ’, ‘জীবনজিজ্ঞাসা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘দুই পৃথিবী’, ‘অগ্নিশ্বর’, ‘যদি জানতেম’, ‘দেবাদাস’, ‘কলংকিনী কংকাবতী’, ‘সদানন্দের মেলা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে উত্তমকুমারের অভিনয়-প্রতিভার বহুমুখিতা লক্ষণীয়।
উত্তমের অভিনয় : মূল্যায়ন
উত্তম একজন জাত অভিনেতা। পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে উন্নীত করেন বড় অভিনেতার পর্যায়ে। চলচ্চিত্র অভিনয়ের শুরুতে উত্তমের বাচনভঙ্গিতে সামান্যতম জড়তা ছিল। এমনকি, সেই সময়ে তার কথার মধ্যে ক্ষীণভাবে একটুখানি তোতলামির ভাবও ছিল। বলা যায়, মধ্যপঞ্চাশ থেকে মধ্যষাট পর্যন্ত—অগ্নিপরীক্ষা, সাগরিকা, পথে হলো দেরী, শাপমোচন, হারানো সুর, শিল্পী ইত্যাদি চলচ্চিত্রে উত্তমকুমার কিছুটা চেহারা সর্বস্ব নায়কই ছিলেন। কিন্তু ‘নায়ক’ ছবির পর থেকে এক নতুন উত্তমের জন্ম হয়।
উত্তমকুমারের অভিনয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑস্বাভাবিকতা। এছাড়া তার কণ্ঠস্বর, এক-একটা সিকোয়েন্সকে হোল্ড করে রাখার ক্ষমতা বা স্ক্রিন পার্সোনালিটি ছিল অসামান্য।
কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও উত্তম অভিনয় করেছেন। নিজের প্রযোজিত ‘ছোট সি মুলাকাৎ’-এ উত্তম যে সফল হন নি, তার কারণ সেখানে ভাষাকে জয় করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ‘অমানুষ’-এর হিন্দি ভার্সনে সারা ভারতের হিন্দি দর্শক শ্রেণি উত্তমের অভিনয় ক্ষমতা অনুভব করতে পেরেছিল।
কিন্তু বাংলা ছবির চলচ্চিত্রকাররা উত্তমের অভিনয় ক্ষমতার খুব কমই ব্যবহার করতে পেরেছেন। ন্যাকা ন্যাকা তথা ভেজা ভেজা আবেগ আর মন মাতানো গান সমৃদ্ধ সিংহভাগ ছবিতেই উত্তমের অভিনয়ের প্রয়োগে ঘটেছে। পাশাপাশি আবার এটাও সত্যি যে, যতটুকু তার দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, ততটুকু সদ্ধ্যবহারে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। অর্থাৎ উত্তম ডি-গ্ল্যামারাইজড হতে চান নি এবং সেই কারণেই তিনি তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’-এর প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হন নি।
উত্তমের নায়িকারা
বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে উত্তমকুমার দু শ’র অধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। এ সমস্ত ছবিতে চার দশকের ৪৫ জন নায়িকা তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশের নায়িকা অলিভিয়াও রয়েছেন। উত্তম সবচেয়ে বেশি অভিনয় করেছেন তিনজন নায়িকার বিপরীতে। এই তিনজন হলেন সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয়া দেবী। ত্রয়ী এই নায়িকার বিপরীতে উত্তম যথাক্রমে ৩০, ২৭ এবং ৩১টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। উত্তমের অন্যান্য নায়িকারা হচ্ছেন : ছবি রায়, মনীষা দেবী, করবী গুপ্তা, ভারতী দেবী, সুনন্দা দেবী, সন্ধ্যারাণী, মঞ্জু দে, মায়া মুখোপাধ্যায়, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, প্রণতি ভট্টাচার্য, কাবেরী বসু, সবিতা চট্টোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্তা, সুমিত্রা দেবী, অনিতা গুহ, মালা সিনহা, সন্ধ্যা রায়, সুমিতা সান্যাল, বাসবী নন্দী, সুনীতা দেবী, নন্দিতা বসু, শর্মিলা ঠাকুর, তনুজা সমর্থ, লোলিতা চট্টেপাধ্যায়, সুলতা চৌধুরী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, রীণা ঘোষ, অঞ্জনা ভৌমিক, কণিকা মজুমদার, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, সুপর্ণা সেন, দীপা চট্টোপাধ্যায়, জয়া ভাদুড়ী, আরতি ভট্টাচার্য, মিঠু মুখোপাধ্যায়, মহুয়া রায় চৌধুরী, অলিভিয়া, প্রেম নারায়ণ, সুলক্ষণা পণ্ডিত, শকুন্তলা বড়ুয়া এবং গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়।
চিরন্তন জুটি সুচিত্রা-উত্তম
পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রে বড়ুয়া-কানন, উমাশমী-দুর্গাদাসের পরে পঞ্চাশের দশকে সুচিত্রা-উত্তম জুটির আবির্ভাব ঘটে। বলা যায়, এই জুটির মতো বিপুল জনপ্রিয়তা দুই বাংলাতে অন্য আর কোনো জুটি লাভ করতে সমর্থ হয় নি। প্রণয়ী যুগল হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা এক বিপ্লব ঘটালেন। কোনো ছবিতে এই জুটি একত্রিত হলেই তৎকালে (পঞ্চাশ/ষাট দশক) সেই ছবি দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভিড় উপচে পড়ত। এই জুটির ফ্যানদের আরও খুশি করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো : ছবির ক্ল্যাইম্যাকস-এ রোমান্টিক যুগলের মিলনের মুহূর্তে উত্তম-সুচিত্রার নিবিড় আলিঙ্গন থাকবে। একজন অপরকে বুকে টেনে নেবে। শটটা এই রকম—দুজন পরস্পরের কাছ থেকে একটু দূরে মুখোমুখি দাঁড়াবে, তারপর পায়ে পায়ে পরস্পরের কাছে হয়তো একটু এগিয়ে আসবে অথবা দাঁড়িয়ে থাকবে এবং শেষে উভয়েই দ্রুত এগিয়ে এসে আলিঙ্গনবদ্ধ হবে। ছবি শেষ, দর্শক খুশি। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি, অন্তত যে ছবিতে ওরা রোমান্টিক যুগল। অবশ্য শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী, শ্রীকান্ত-কমললতা, মহিম-অচলা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ফর্মুলাটি বাদ গিয়েছে। উল্লেখ্য, উত্তম-সুচিত্রা জুটি সম্পর্কে দর্শকের যে জল্পনা-কল্পনা ছিল তার পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিলেন তৎকালের মূলধারার বাংলা ছবির নির্মাতারা। পাশাপাশি উত্তম-সুচিত্রার জুটির মধ্যে যাতে দর্শকের অপূর্ণ বাসনার চরিতার্থ ঘটে—সে ব্যাপারেও তারা ছিলেন সচেষ্ট। মজার বিষয় হচ্ছে যে, উত্তম-সুচিত্রা দুজনেই জুটির বাইরেই তাদের সেরা অভিনয় উপহার দিয়েছেন।
হেমন্ত-উত্তম : সোনালি মেলবন্ধন
সুচিত্রা-উত্তম জুটির মতোই পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রে গায়ক-নায়কের এক সোনালি মেলবন্ধন গড়ে উঠেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উত্তমকুমারের মাঝে। হেমন্তের কণ্ঠে উত্তমের ঠোঁট মেলানোর যে খেলা তা অপূর্ব। চলচ্চিত্র দর্শক-শ্রোতার মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হয় যে, উত্তমই স্বয়ং গান গাইছেন। এর কারণ হলো হেমন্ত এবং উত্তমের দুজনেরই কণ্ঠস্বর, গলার টোনাল কোয়ালিটির মধ্যে প্রচণ্ড মিল।
গায়ক, সংগীত পরিচালক, প্রযোজক ও পরিচালক
উত্তমকুমারের প্রধান পরিচয় অভিনেতা হলেও আরও কয়েকটি ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে। যেমন, তিনি কয়েকটি ছবির গানের প্লেব্যাক সিঙ্গার ছিলেন। প্রথমে তিনি দেবকী বসু পরিচালিত ‘নবজন্ম’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে ছটি গানে নেপথ্য কণ্ঠদান করেন। এছাড়া সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন দুটি চলচ্চিত্রে (কাল তুমি আলেয়া এবং সব্যসাচী)।
যুগ্ম প্রযোজক হিসেবে উত্তম যাত্রা শুরু করেন ‘হারানো সুর’-এর মাধ্যমে। তারপরে প্রযোজনা করেন ‘জতুগৃহ’, ‘সপ্তপদী’, ‘খেলাঘর’, ‘শুন বরনারী’, ‘কায়াহীনের কাহিনী’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ এবং হিন্দি ছবি ‘ছোটি সি মুলাকাত’।
উত্তমকুমার পরিচালিত ছবি হচ্ছে ‘শুধু একটি বছর’ (১৯৬৬), ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (১৯৭৩) এবং ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ (১৯৮০)। শেষের ছবিটি অবশ্য উত্তম শেষ করে যেতে পারেন নি।
জন দরদি উত্তম
দরদি মানুষ হিসেবেও উত্তম ছিলেন অসাধারণ পুরুষ। ১৯৭৮-এর বিধ্বংসী বন্যায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ যখন বিপর্যস্ত, তখন উত্তমকুমার অন্য শিল্পী ও কলাকুশলীদের সংগঠিত করে বহু টাকা ও সাহায্য তুলে দিয়েছিলেন বন্যা দুর্গত পশ্চিমবঙ্গবাসীদের জন্য। এছাড়া দুঃস্থ শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতি তার অকৃত্রিম মমত্ববোধ একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শিল্পী সংসদের সভাপতি ছিলেন তিনি। এবং এই সংগঠনের পক্ষে দুঃস্থ শিল্পীদের সহায়তাকল্পে দুটি ছবি তৈরি করেছিলেন।
প্রেম-পরিণয়-ভালোবাসা
উত্তমের জীবনে প্রথম প্রেম আসে ১৯৪৬-এ। তখন তিনি পোর্ট কমিশনারস অফিসে চাকরি করছেন। এই সময়ে এক ছুটির দিনে জ্যাঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার বান্ধবী গৌরীরাণী গাঙ্গুলীকে প্রথম দেখে প্রেমে পড়ে যান। তার উদ্দেশে একের পর এক গান গেয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে এই প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়, যার উপসংহার বিয়েতে। ১৯৫০ সালের ১ জুন ল্যান্স ডাউন রোডের গাঙ্গুলী বাড়ি থেকে গৌরী দেবী বধূ বেশে ৪৬-এ গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ির উঠোনে পা রাখেন। দাম্পত্যজীবনের বেশ কয়েকটি বছর ওঁরা কাটিয়ে দেন অদ্ভুত রোমান্সের জগতে। একমাত্র পুত্র গৌতমের জন্ম হয় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫১)। তারপর ঘটে ছন্দপতন। উত্তমের জীবনে আসে দ্বিতীয় নারী। সুপ্রিয়া দেবী।
স্বামীর সঙ্গে সুপ্রিয়া দেবীর বনিবনা হচ্ছিল না। সেই সময়ে উত্তম সমব্যথী বন্ধু হিসেবে তার পাশে এসে দাঁড়ান। ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং অবশেষে ১৯৬৩ সালে উত্তমকুমারের ময়রা স্ট্রীটের বাড়িতে সুপ্রিয়ার দাদা অনিল বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তমের হাতে তুলে দেন সুপ্রিয়াকে। শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গেই তাদের বিয়ে হয়েছিল।
গৌরী ও সুপ্রিয়া দেবী ছাড়া সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট’ হয়েছিল। এই দুজনকে তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু উত্তমের ভাষায় ‘সে ভালোবাসা অন্য জাতের, অন্য ধরনের। কামগন্ধ নাহি তায়’।
উত্তমের জীবনে অন্য আর নারী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
নিঃসঙ্গ নায়ক
উত্তম বাংলা ছবির সর্বাধিক জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাই তাকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিক জীবনের জন্য তিনি ছিলেন কাঙাল। বন্ধুদের সঙ্গে এক আড্ডায় উত্তমকুমারের হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উচ্চারিত কথার মধ্যে তার যন্ত্রণা কাতর সত্তাটি প্রকাশিত: “দূর দূর এটা একটা জীবন নাকি ? ইচ্ছে মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারি না, বাজারে গিয়ে দরদস্তর করে মাছ কিনতে পারি না। গড়ের মাঠে দাঁড়িয়ে ফুচকা কিংবা চিনে বাদাম খেতে পারি না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে পারি না। জেলের কয়েদিরাও বোধহয় এর চেয়ে সুখে থাকে। আমি তো আর এখন মানুষ নই, আমি একটা সেলেবল কমোডিটি। প্রোডিউসার ডিরেকটরদের ক্রীতদাস। পুতুল নাচের রঙচঙে পুতুল।” সত্যি কথা বলতে কী, জীবনের শেষ পর্যায়ে ঘরে-বাইরে কোথাও উত্তমের শান্তি ছিল না। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহারের কারণে কাগজে সাংবাদিকরা তাকে বয়কট করেছিলেন। ছবি ছাপানো হতো, তলায় নাম না দিয়ে লেখা হতো জনৈক শিল্পী। কিন্তু কেন যে তিনি সেই সাংবাদিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন, সেদিন কেউ তা তলিয়ে দেখতে চায় নি। আবার হিন্দি ছবির আগ্রাসন থেকে বাংলা ছবিকে বাঁচাতে বাংলা ছবি দেখানোর সম্মানজনক একটা ব্যবস্থা করার জন্যে উত্তম সংরক্ষণ সমিতিকে মদত দিয়েছিলেন। এতে প্রদর্শকরা তাকে বয়কট করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া গৌরী কিংবা সুপ্রিয়া দেবী কারও কাছ থেকেই তিনি মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছিলেন না। রবি বসু লিখেছেন : “বাইরে থেকে অনেকে মনে করবেন উত্তমকুমার কত সুখী। কিন্তু তার মতো অত দুঃখী মানুষ আমি আর একটিও দেখি নি। দুঃখী এবং নিঃসঙ্গ। তাঁর সব ছিল অথচ কেউ ছিল না। কিছুই ছিল না।”
উত্তমের প্রস্থান
১৯৬৭ সালে প্রথম উত্তমের হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপর মাঝখানে আরেকবার এবং সর্বশেষের অ্যাটাকে এই মহানায়কের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার, রাত ৯.৩০ মিনিটে, কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিক-এ। পরদিন কেওড়াতলার শ্মশানে সাজানো চিতাতে এই দুঃখী, নিঃসঙ্গ মানুষটি সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.