পথশিশুদের সৃজনশীলতার দ্যুতি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও লীডো’র যৌথ প্রয়াস

পথশিশুদের সৃজনশীলতার দ্যুতি  মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও লীডো’র যৌথ প্রয়াস

গতকাল ২৬ জুলাই, শনিবার, আগারগাঁওস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হলো এক ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান এখানে বিভিন্ন মাধ্যমে করা পথশিশুদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী এবং তাদের ওপর নির্মিত ‘Where the kids have no name’ নামের একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় এটির আয়োজক ছিল যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং Local Education and Economic Development Organization (LEEDO)

২০২৪ সালের মে মাসে ইউনেস্কোর  ‘বিশ্বস্মৃতি বা ওয়ার্ল্ড মেমোরি তালিকায় স্থান পেয়েছিল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা নারীর মুক্তিপ্রত্যাশী উপন্যাসসুলতানা ড্রিম এরপর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রোকেয়ারসুলতানা ড্রিম-এর অনুপ্রেরণায় নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে যেমন, ২৮টি লাইব্রেরির ছেলেমেয়েরাসুলতানা ড্রিম পাঠ করে এবং পুরস্কৃত হয়; নিশাত মজুমদারের নেতৃত্বে হিমালয়ের তিনটি পর্বতের চূড়ায় ওঠে বাংলাদেশের পাঁচজন নারী, একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয় এবং সর্বশেষে তরুণ ভাস্কর রূপকল্প চৌধুরীর পরিচালনায় কয়েকজন পথশিশুদের নিয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় এখানে তিনটি পর্যায়ে তার, মাটি কাগজের মাধ্যমে নানা শিল্পকর্ম তৈরি করে পথশিশুরা সেইসব শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীরও উদ্বোধন হয় গতকাল এবং তা সপ্তাহব্যাপী চলবে

অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল একটি আলোচনা অনুষ্ঠান এখানে স্বনামধন্য অভিনেত্রী নির্দেশক ত্রপা মজুমদারের উপস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং সদস্য সচিব মফিদুল হক, লীডো প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, পিস হোমের ব্যবস্থাপক সোহেল রানা মাদার জেসমীন আক্তার, ভাস্কর রূপকল্প চৌধুরী এবং পিস হোমের সদস্য সাথি

ফরহাদ হোসেন বলেন, বেশ কিছুদিন আগে যখন লীডো পিস হোমে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং সদস্য সচিব মফিদুল হক তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় যৌথভাবে কিছু করার তারই ফসল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনেরসুলতানা ড্রিম দ্বারা অনুপ্রাণিত পথশিশুদের সৃজনশীল প্রজেক্টটি, যেটি অবয়ব দান করেছেন তরুণ ভাস্কর রূপকল্প চৌধুরী আমি আশা করব বেগম রোকেয়ার যে স্বপ্ন ছিল, এদেশের অনেক মেয়েরা তা ধারণ করে এগিয়ে যাবে এবং নিজেদের সুন্দর ভবিষ্য রচনা করবে

পিস হোমের ব্যবস্থাপক সোহেল রানা মাদার জেসমীন আক্তার স্লাইডের মাধ্যমে তুলে ধরেন যে, ২০০০ সালে লীডো প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে ২০১০ সালে মূলত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সমস্যা জর্জরিত পথশিশুদের সংগ্রহ করে একটি সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে তাদের ছয় সপ্তাহ রাখা হয় কাউন্সিলিং করা হয় যোগাযোগ করা হয় তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থানার মাধ্যমে তাদের কাছে শিশুদের হস্তান্তরও করা হয় আর যাদের কেউ নেই তাদের পিস হোমে রাখা হয় দীর্ঘমেয়াদে সেখানে তাদের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি বিনোদন, খেলা, শরীরচর্চা, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখানোসহ নানা কিছুর সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করা হয় ঢাকায় ওয়াটার সেনিটেশন কার্যক্রমের পাশাপাশি ভ্রাম্যমান টয়লেট পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি এছাড়া ঢাকা শহরের নানা জায়গায় লীডো মোবাইল স্কুলও রয়েছে এই বছর পর্যন্ত পাঁচশ জন শিশুকে উদ্ধার করেছে লীডো আশি শতাংশ শিশুকে পরিবারের কাছে হাস্তান্তর করা হয়েছে, ১০-২০ শতাংশ শিশুদের সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রসহ পিস হোমে রাখা হয়েছে পঁচিশটি পরিবারের শিশুকেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে লীডো জরুরি খাবার সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি লীডো সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরা হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডন, কাতারের রাজধানী দোহা এবং ভারতের চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছে লীডো শিশুরা আগামী ২০২৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটেও অংশগ্রহণ করবে

ভাস্কর রূপকল্প চৌধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার পর পথশিশুদের সৃজনশীলতার প্রকল্পটির আইডিয়া তার মাথায় আসে বিষয়ে তিনি মফিদুল হকের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁর কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে কার্যক্রমে হাত দেন তিনি আরও জানান, শ্যামলীর ওভার ব্রিজে দিনের পর দিন এক মহিলার সঙ্গে একটি শিশুকে দেখতেন তিনি দেখতেন পথের মাঝে বসে শিশুটি নিবিষ্ট মনে পড়াশোনা করছে তখন থেকেই পথশিশুদের নিয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছা তার মনে জাগে এছাড়া অরনি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় শিশুদের গান, গল্পবলা, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, ব্যায়ামসহ নানা কিছু শিখিয়েছেন সেই কার্যক্রমের অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে বর্তমান প্রকল্পে বর্তমান প্রকল্পেও তিনি নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনি সেদিন শিউলী নামের একটি মেয়ে গল্প শোনার পর বলার সময় সুন্দর করে তা ব্যক্ত করতে পেরেছে গল্পটি যে সে মনে রেখেছে, এটি তার কাজের সার্থকতা বলে মনে করেন রূপকল্প চৌধুরী তিনি বলেন, প্রকল্পে অংশ নেওয়া শিশুদের তিনি তিনটি ভিন্ন মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, নানা শিল্পকর্ম তৈরি করতে শিখিয়েছেন মাধ্যমগুলো হলোÑতার, মাটি এবং কাগজ একেবারে শেষের দিন বেগম রোকেয়ারসুলতান ড্রিম-এর কোন বিষয়গুলো তাদের ভালো লেগেছে, সেটি জানতে চেয়েছেন এবং জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অনুপ্রাণিত করেছেন পড়াশোনার প্রতি শিশুদের গুরুত্ব দিতে বলেছেন তিনি কেননা শিক্ষাই শক্তি অবশ্য শুধু পাঠবইয়ের পড়াশোনা নয়, এর বাইরেও পড়াশোনা করতে হবে; নানা ধরনের কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে হবে

পিস হোমের সদস্য সাথি নিজেরসহ কয়েকজন শিশুর লিখিত বক্তব্য তুলে ধরে যেমন রাব্বি নামের এক শিশুর ভালো লেগেছেসুলতানা ড্রিমে উড়ন্ত গাড়িটি তার প্রত্যাশা আগামীতে বাংলাদেশেও এমন একটি গাড়ি দেখতে পাওয়া যাবে

আলোচনা অনুষ্ঠানের পরে প্রদর্শিত হয় ‘Where the kids have no name’ নামের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র জামিলাহ ভ্যান ডের হুলস্ট পরিচালিত পুরস্কারপ্রাপ্ত বায়ান্ন মিনিটের এই চলচ্চিত্রে লীডো ঢাকা শহরভিত্তিক পথশিশুদের কার্যক্রম ফুটে উঠেছে সবশেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা একটি প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করেন, যেখানে রূপকল্প চৌধুরীর পরিচালনায় কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা বিভিন্ন পথশিশুদের শিল্পকর্ম ঠাঁই পেয়েছে মাধ্যম তার, মাটি এবং কাগজ

Leave a Reply

Your identity will not be published.