বাংলাদেশের সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ এ দেশের পাখিরা। ভৌগোলিকভাবে এ দেশ জীববৈচিত্র্য তথা বন্যপ্রাণীতে এতটাই সমৃদ্ধ, যা পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকার থেকে অনেক বেশি। এ দেশের মানুষ পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে আবার পাখির ডাকে ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এদেশের জলাশয়, খাল-বিলের ওপর কিংবা ভাসমান কচুরিপানার ওপরে মাছ শিকারের আশায় দলবেঁধে বসে থাকা ধবল বক, ডাহুক, পানকৌড়ি বিলের মধ্যে গেড়ে রাখা উঁচু বাঁশের কঞ্চির ওপর বসে থাকা মাছরাঙা পাখি কিংবা শঙ্খচিল, নীল আকাশে চিল ও ঈগল পাখির উড়ে বেড়ানো, গৃহস্থের বাড়ির উঠোনে কিংবা গাছে দোয়েল, শালিক, কাক, চড়ুই পাখির অবাধ বিচরণ, নির্জন বনাঞ্চল, সবুজ গাছপালা, তরুলতা, বাঁশঝাড়, ঝোপঝাড়ে বসে থাকা ঘুঘুর ও কোকিলের ডাক, অসংখ্য পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ আমাদের গ্রামবাংলার এক চিরপরিচিত রূপ। বলা যায়, এদেশের প্রকৃতির সাথে পাখির রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক।
কিছুদিন আগেও মাঠে-ঘাটে, ক্ষেতে-খামারে বিচিত্র ধরনের পাখিদের বিচরণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে জলাশয়ে এসে তৃষ্ণা মেটাতো আর খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। ফসলের মাঠে পাখি বসার দৃশ্য সচরাচর দেখা গেলেও এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। অতীতে গ্রাম এলাকায় ব্যাপকহারে বক, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, বাবুই, টুনটুনি, চিল, পানকৌড়ি, ডাহুক, বালিহাঁস, কোকিল, কাকসহ বিভিন্ন পাখিদের দেখা যেত। বিশেষ করে জাতীয় পাখি দোয়েল, ঘুঘু, বাওয়াই, শালিক, টুনটুনি, কাঠঠোকরা, কোকিল, ডাহুক, ক্যাসমেচি, বাবুই, মাছরাঙা, বটর, টেইটেরা, গোমড়া ও প্যাঁচাসহ অনেক পাখিকে আর তেমন দেখা যায় না। শোনা যায় না এইসব পাখির ডাক। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত বসন্তে যে পাখি ‘বউ কথা কও’ বলে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে মাতিয়ে তুলত, সেই পাখির দেখা আর পাওয়া যায় না। বর্তমান প্রজম্ম চেনে না এসব পাখিদের। এসব পাখির ডাকও শোনে নি কোনোদিন। ফলে শিশু কিশোরদের কাছে দিন দিন হয়ে যাচ্ছে এসব পাখি অজানা।
পাখি কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই দায়ী। কৃষকরা এখন বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে সব সময় কীটনাশক প্রয়োগ করে। এতে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালীসহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ মরে যায় বা আক্রান্ত হয়। পাখিরাও দিনের পর দিন এসব খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে। তা ছাড়া পাখিশিকারিদের নিষ্ঠুরতা তো রয়েছেই। কখনো কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড়ে পাখির বাসা ভেঙে পাখির ছানার মৃত্যু ঘটে ও ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পাখির বিলুপ্তি ঘটায় যেমন জীববৈচিত্র্যের সংকট বাড়ছে, তেমনি আমরা হারিয়ে ফেলছি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরিবেশ রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাখির পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৩০টি বর্তমানে বিলুপ্ত। ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে কালেভদ্রে দেখা যায়। বাকি ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়। এই ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি। স্থায়ীভাবে এ দেশে বাস করে। বাকি ১৭৫টি বাংলাদেশের ‘পরিযায়ী’ পাখি। খণ্ডকালের জন্য নিয়মিতভাবে এ দেশে থাকে। এই ১৭৫ প্রজাতির মধ্যে ১৬০টি শীতে এবং ৬টি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে থাকে। বাকি ১০টি বসন্তে এ দেশে থাকে। যাদের ‘পরিযায়ী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। উল্লেখ্য, আমাদের বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিকে অতিথি পাখি নামে ডাকা হয়।
ছোটবেলার আমার পাখি পোষার দারুণ শখ ছিল। ভ্রম্যমান পাখিবিক্রেতাদের কাছ থেকে টিয়া, ময়না, কিনে বাড়িতে খাঁচায় পোষার অভিজ্ঞতা আছে। আমার পালা ময়না পাখিটা কথা বলতে শিখেছিলো। এরজন্য আমাকে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। খাঁচায় পাখি পোষা আমার এক পর্যায়ে অমানবিক মনে হয়েছে। বন্দি জীবন কোনো মানুষ কিংবা প্রাণীকুলের কাছে ভালো লাগে না।” বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃকোলে " এই চরম সত্যি কথাটি উপলব্ধি করে একদিন আমার পোষা পাখিগুলো প্রকৃতিতে অবমুক্ত করে দেই। পাখিদের প্রতি আমার ভালোবাসা সবসময়ই ছিলো। পাখিরা হচ্ছে প্রকৃতির অলংকার। গ্রামের নির্জন উঁচু গাছে বসে থাকা ঘুঘুর ডাক, বসন্তে কোকিলের ডাক শুনতে কীযে ভালো লাগে তা ঠিক বলে বুঝানো যাবে না।
গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে নির্বিচারে পাখিদের আবাসস্থল গাছপালা কেটে সেখানে বাড়িঘর, দালানকোঠাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, দ্রুত নগরায়ন, সড়ক, মহাসড়ক প্রশস্থকরণের সময়ে নির্বিচারে পুরোনো বৃক্ষ নিধনের, মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে ক্ষতিকারক উচ্চ মাত্রার বিকিরণ এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে নানা প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে, বাবুই, ঘুঘু, টুনটুনি, কাঠঠোকরা, কাক, শকুন, ময়ুর, পেঁচা, পরিযায়ী পাখিসহ অসংখ্য পরিচিত পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে প্রকৃতি থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শকুনের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে ৫০ হাজারের বেশি শকুন ছিল। বনবিভাগ ও আইইউসিএনের ২০২৩ সালের শুমারিতে ২৬৭টি শকুনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হবিগঞ্জ কার্যালয়ের রেঞ্জ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী জানান, “বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২১০টি শকুন বেঁচে আছে।” গবেষকদের মতে, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৯০% শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় অবস্থিত ঘোনাপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মাঝেমধ্যে দেখেছি নদী পাড় ঘেঁষে মৃত বেওয়ারিশ মানুষের পচাগলা লাশ ভেসে যেতে। আমি দেখেছি এইসব লাশের সন্ধান পেয়ে শকুনের দল কোত্থেকে উড়ে এসে মরা মানুষের লাশ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলছে। একইভাবে আমি মরা গবাদিপশু কিংবা শিয়াল, কুকুর, বিড়ালের মৃতদেহ খেয়ে ফেলতে দেখেছি বহুবার। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আকাশে শকুনের ঝাঁক কোনো জায়গায় ঘুরতে দেখলে সহজেই বুঝতে পারতাম, সেখানে উড়ন্ত শকুনগুলো মৃত কোনো জন্তু-জানোয়ারের দেহের সন্ধান পেয়েছে। আগেকার সেই দিনগুলোতে নিরিবিলি স্থানে বড় বড় গাছের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন রাতের বেলা আশ্রয় নিতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমার চোখে কোথাও শকুনের দেখা মিলে নি।
আইইউসিএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪২৪ প্রজাতির পাখি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন সমস্যা দেখা যায় নি। তবে মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে ১০টি প্রজাতি, বিপন্ন অবস্থায় আছে আরও ১২টি ও সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে ১৭টি প্রজাতি। এ ছাড়া শঙ্কাগ্রস্ত বা অচিরেই ঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন অবস্থায় আছে ২৯টি প্রজাতি। ৫৫ প্রজাতির পাখির ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় নি।
এ ছাড়া চিল, বাজপাখি ও শকুন কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি পাখি হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলো বন্ধ ও পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা না যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক পাখির কণ্ঠ চিরতরে থেমে যাবে।
কাকের শহর হিসেবে খ্যাত আমাদের রাজধানী ঢাকা শহর। এই শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে আমাদের চিরপরিচিত পাখি কাক। প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে কাকের পরিচিতি রয়েছে। তবুও কাক কমে যাওয়া নিয়ে শহরে তেমন শোরগোল নেই। কাকের স্বভাব হলো, ওরা ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পচা জিনিস খায়, গায়ের রং কালো কুচকুচে, কর্কশ স্বর হয়তোবা মানুষের অপছন্দের কারণ। কেবল প্রকৃতি দরদী কবি জীবনানন্দ দাশকেই দেখি ভোরের কাক হয়ে আবার এই বাংলায় ফিরে আসার আগ্রহ রাখেন। আর ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, যিনি কবি শামসুর রাহমানের ‘কাক’ কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে দৃঢ় ও তীর্যক কাক এঁকেছিলেন।
গ্রামে মোরগের ডাকে গাঁয়ের মানুষের ঘুম ভাঙে আর ঢাকাবাসীর ঘুম ভাঙায় কাক। ঢাকা কাকেরই শহর। কাক ছাড়া ঢাকার কথা যে চিন্তা করা যায় না, শিল্পী রফিকুন নবী'র টোকাই কার্টুনে তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কাকের আড্ডাও ঢাকাবাসীর আলোচনার বিষয়। ওরা সামাজিক প্রাণী। একজনের বিপদে অন্য কাকদের এগিয়ে আসার দৃশ্য আমাদের চিরপরিচিত। কারো মৃত্যুতে ওরা শোকসভা করে। স্ত্রী ও পুরুষ কাক কাছাকাছি থাকে, পরস্পরকে আগলে রাখে। একলা একটা কাক দেখা যায় কদাচিৎ। ঢাকার প্রতীক হিসেবে কাককে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি ঠিকই, কিন্তু কাক ছাড়া যে ঢাকা শূন্য লাগে তা বুঝি আজ অনেকেই টের পেতে শুরু করেছেন। ঢাকা শহরে কাকের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো বাসস্থান ও খাদ্যের অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবেশ দূষণ। এছাড়া মোবাইল টাওয়ারের ক্ষতিকারক বিকিরণ, কাকের আবাসস্থল এবং জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়নের ফলে কাকের স্বাভাবিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যা তাদের সংখ্যা হ্রাসের একটি প্রধান কারণ। এছাড়াও, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে, মাটিতে এবং পানিতে মিশে যাওয়ায় খাদ্য চক্রের মাধ্যমে কাকের শরীরে প্রবেশ করে তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পুরান ঢাকার বাসিন্দারাও কাকের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ করেছেন এবং তারা মনে করেন, মানুষের আবাসস্থল বৃদ্ধি এবং খাবারের অভাবের কারণে কাকেরা শহর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় কাকের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাই কাকের সংখ্যা কমে যাওয়া পরিবেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
আমার মরহুম পিতার ঢাকার বাড়ির গেইটে পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটা বড় আমগাছ রয়েছে। আমাদের আশেপাশের অধিকাংশ বাড়িতে বর্তমানে তেমন বড় কোনো গাছপালা না থাকার কারণে এলাকাবাসীরা আমাদের বাড়িটিকে ‘আমগাছ বাড়ি’ বলে একবাক্যে চিনে। এই গাছটিতে গত দুই বছর আগেও বেশ কয়েকটি কাকের বাসা ছিলো। আমের মৌসুমে কেউ গাছে আম পাড়তে উঠলে কাক আক্রমণ করতো। একই গাছে নাম না-জানা অন্য পাখির বাসা ছিলো বহু বছর। রাতের শেষ ভাগে পাখিগুলোর কিচিরমিচির ডাক শোনা যেতো। এই বছর কেন জানি না সেই পাখিদের ডাক শোনা যায় না। অজ্ঞাত কারণে গাছটিতে বর্তমানে কোনো পাখির বাসা নেই। আগে দিনের বেলায় গাছটিতে শালিক, কাঠঠোকরা, দোয়েল, চড়ুই ও কাকের দেখা মিলতো। অবাক করা বিষয় আমাদের এতো বড় গাছে কোনো পাখির দেখা নেই বিগত বছর দুই যাবৎ। এমনকি আমাদের বাড়ির ছাদে কিংবা আশেপাশের বাড়িতে কাক, চড়ুই কিংবা শালিক পর্যন্ত চোখে পড়ে না। সম্প্রতি দূরের কোথাও থেকে ভোরের সময় কাকের ডাক শুনে মনে মনে খুশি হয়েছি। ঢাকা শহর থেকে কাক হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আর দশজনের মতো আমাকেও ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। ঢাকা শহরের এতো কাক ও অন্যান্য পাখি তাহলে কোথায় গেলো ? সেই প্রশ্ন আজ পরিবেশ সচেতন মহলের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে।
রাজধানী ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের আয়তন ৬,২১৪ একর (প্রায় ২৫.১৪ বর্গ কিলোমিটার)। এই বিশাল প্রকল্প স্থানটিতে নব্বই দশক পর্যন্ত মানুষের তেমন বসতি ছিল না। এলাকাটি তখন সবুজ অরণ্যে ঘেরা গাছপালা, তরুলতা, বাঁশঝাড়, গজারি বন, উঁচুনিচু টিলা ও কৃষি জমি ছিলো। আমার দেশের বাড়ি কালীগঞ্জে হওয়ার সুবাদে প্রকল্প এলাকাটিতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। সেখানকার গাছপালা, ঝোপঝড়ে বাস করতো অসংখ্য প্রজাতির পাখপাখালি। এসবকিছুই আমার নিজ চোখে দেখা। প্রকল্প এলাকা বাস্তবায়নে প্লট ও রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে এখানকার অসংখ্য গাছপালা কেটে ফেলতে হয়েছে। এতে নীড় হারিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে অসংখ্য পাখিসহ এই বিশাল প্রকল্প এলাকার সকল জীববৈচিত্র্যকে। ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের কারণে অসংখ্য পাখির ছানার মৃত্যু হয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে এই বিশাল প্রকল্প এলাকার পরিবেশের ভারসাম্যের বিষয়টি।
বাংলার প্রকৃতির এক অপার বিস্ময় হচ্ছে বাবুই পাখির বাসা। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে আজ সেই বাবুই পাখিই প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাবুই পাখি সাধারণত তালগাছ কিংবা খেজুর গাছের ডালে বাসা বাঁধে।
তাল গাছের কাঠ দিয়ে ঘরের চালার চৌকাঠ ও গোড়ার অংশ দিয়ে কোনডা নৌকা তৈরি করা হয়। খেজুর গাছের গুড়ি ইটের ভাটায় জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় টাকার লোভে মানুষ এই গাছগুলো চড়া দামে দালালদের নিকটে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে প্রকৃতি থেকে দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এই গাছগুলো। বাবুই পাখিরা তাদের আবাসস্থলের অভাবে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই দেশ থেকে। অথচ আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগেও আমাদের গ্রামে তাল গাছে দেখা মিলতো বাবুই পাখির বাসা। তালের পাতায় নিপুণ কারুকার্য করে বাবুই পাখি তার অপরূপ সৌন্দর্যের বাসা তৈরি করে। শুধুই বাবুই পাখি না, প্রতিকুল পরিবেশ ও আবাসস্থলের অভাবে জাতীয় পাখি দোয়েল, চড়ুই, শালিক, চিল,, কোকিলসহ অসংখ্য পাখি আজ চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এখনই যদি এ সব পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এসব পাখি প্রকৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। বাবুই পাখিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখন আমাদের সকলের উচিত বেশি করে তাল ও খেজুর গাছ লাগানো। বন্ধ করতে হবে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। এদেশে যে পাখিগুলো আছে তার বড় একটি অংশ পরিযায়ী পাখি। এদের মধ্যে ২২৫ প্রজাতি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২টি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪টি পান্থ পরিযায়ী, ১২০টি ভবঘুরে এবং বাকিরা আবাসিক। আর এ শীতকালীন পরিযায়ী পাখিদের বড় একটি অংশ জলচর পরিযায়ী পাখি। জলাশয়, হাওর ছাড়াও বাঁওড়ও পাখিদের অন্যতম আশ্রয়কেন্দ্র। দেশে ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর এলাকা এই বাঁওড়ের অন্তর্ভুক্ত। তবুও বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই উপেক্ষিত। বাঁওড় গুলোতে টিকে আছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি, যার মধ্যে ৭০ প্রজাতি পরিযায়ী। বাঁওড় শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা শুকিয়ে যায়। বর্ষাকালে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলাসহ নানা ধরনের ভাসমান উদ্ভিদে পরিপূর্ণ থাকে বাঁওড়। ভাসমান পাতার ফাঁকে জলময়ূর, জলপিপি, ডাহুক, কোড়ার ছোটাছুটি এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার মতো।
শীতে পানি কমে গেলে জলজ উদ্ভিদগুলোর নিচে তৈরি হয় পাখিদের খাদ্যের এক অপূর্ব ভান্ডার। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পাখি। বাঁওড়ের পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী বুনোহাঁস। সরালি, বালিহাঁসের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে শীতে যখন পাখি কমে যায়, তখন সরালি আর বালিহাঁস দুটোই বাড়ে। তখন আসে পরিযায়ী বুনোহাঁস যেমন; মৌলবি হাঁস, পিয়াং হাঁস, তিলি হাঁস, ভূতি হাঁসসহ আরও অনেক পাখি। বাঁওড়ের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ পাখি ডুবুরি। বড় পানকৌড়ি, ডাহুক, ঝিল্লি, গুড়গুড়িসহ বিভিন্ন পাখিদের জলজ উদ্ভিদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ দেখা যায় এ সময়। শিকারি পাখিদের মধ্যে হ্যারিয়ার ঈগল, বাজ, মধুবাজ, চিল, পেঁচাসহ আরও নানান প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। আমাদের দেশে হাওর, বাওড়, জলাশয়গুলোতে শীতের মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। এই পাখিগুলোর অধিকাংশই আসে মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া, তিব্বত কিংবা হিমালয় অঞ্চল থেকে। পরিযায়ী পাখির কলকাকলীতে শীত মৌসুমে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে এদেশের হাওড়, বাওড়, জলাশয়গুলো।
আমাদের ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে বিশাল জলাশয়গুলোতে দেখা পাওয়া যায় ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পরিযায়ী পাখি। এই পাখিগুলোর জলক্রীড়া দেখতে ছুটির দিনে অসংখ্য মানুষ পরিবারপরিজন নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে এসে ভিড় করে। বিগত দুই বছর আগে শীতের অতিথি পাখি দেখতে সপরিবার আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি লক্ষ করেছি, ক্যাম্পাসের ভিতরের রাস্তায় চলাচলকারি বেটারী চালিত রিকশার উচ্চ শব্দের হর্নের আওয়াজ পাখিগুলোর মনে ভীতির সঞ্চার করছিল। শব্দদূষণ অতিমাত্রায় হলে পাখিগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আইন করে দকল প্রকার যানবাহনে হর্ন বাজানো ব্যাটারিচালিত নিষিদ্ধ করা একান্ত জরুরি। অতিথি পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হাজার হাজার কিলোমিটার আকাশপথ ডানায় ভর করে আমাদের বাংলাদেশে চলে আসে, আবার গ্রীষ্ম মৌসুম আসার আগে ওরা নিজভূমে ফিরে যায়। পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আশ্রয়, পরিবেশ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে আমাদের দেশে পাখি শিকার দন্ডণ্ডীয় অপরাধ। নব্বইয়ের দশকে রাজধানী ঢাকা শহরের এলিফ্যান্ট রোডে চোরাই পাখিশিকারিদের বহুদিন প্রকাশ্য দিবালোকে অতিথি পাখি বিক্রি করতে দেখেছি। পুলিশের ধরপাকড় শুরু হলে প্রকাশ্যে পাখি বিক্রি বন্ধ হয় কিন্তু চোরা শিকারিরা থেমে থাকে নি। সিলেট অঞ্চলে রাস্তার পাশে কিংবা বাজার এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে অসংখ্য অতিথি পাখি বেচাকেনা হচ্ছে। পুলিশ টের পেলে চোরা শিকারীরা গা-ঢাকা দেয়। মাত্রারিক্ত চোরাইভাবে পাখি শিকারের কারণে এইদেশ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখিগুলো। আমাদের যে-কোনো মূল্যে পরিযায়ী পাখিদের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা ওরা শীত মৌসুমে আমাদের দেশে না এসে অন্যসব প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যাবে।
প্রাণী জগতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাখিরা। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বিগত দুই দশকে অসংখ্য পাখির বিলুপ্তি ঘটায় যেমন জীববৈচিত্র্যের সংকট বাড়ছে, তেমন আমরা হারিয়ে ফেলছি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রকৃতিতে পরিবেশ রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই মানবজাতির জীবের প্রতি দয়া, সহনশীলতা এবং সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে পাখির স্বাভাবিক বেঁচে থাকা, বংশবিস্তারের মাধ্যমে তাদের সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ।
Leave a Reply
Your identity will not be published.