প্রেক্ষাগৃহে আসছে ‘অন্যদিন’ : দেশ ও সময়ের গল্পগাথা

প্রেক্ষাগৃহে আসছে ‘অন্যদিন’ : দেশ ও সময়ের গল্পগাথা

১. একটি জাহাজের ইঞ্জিনঘর। সারেংসহ তার সহকারীরা খোশগল্প করছে। বলা হচ্ছে, দেশের ধনী ও গরিব মানুষের অবস্থার কথা। যেমন, কারাগার। সেখানে ধনী ব্যক্তিরা রাজার হালে থাকে। তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু গরিব মানুষেরা অনেক দুঃখ-কষ্টে বন্দিজীবন কাটায়।

২. জাহাজের একটি আরামদায়ক কেবিন। আওয়ামী লীগের দুজন নেতার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থী। দেশ থেকে টাকা পাচার, ঋণ খেলাপিদের সাজা প্রসঙ্গে এক নেতা জানান, পুরো বিষয়টিই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে এবং তা চলমান থাকবে। ...উন্নয়নের ছোঁয়া দেশের মানুষের মধ্যে পড়ে নি বলে এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করলে এক নেতা বলেন, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির কথা। ... এক সরকার যায়, আরেক সরকার আসে কিন্তু দেশের কোনো পরিবর্তন হয় না-আরেক শিক্ষার্থীর অভিমত। তখন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা জানান, পরিবর্তন তো দৃশ্যমান। যেমন, শিক্ষার্থীরা এখন তাদের ইন্টারভিউ নিতে পারছে। আগে হলে পারত না।

বাংলাদেশের এমনই নানা তথ্য এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা একটি জাহাজের যাত্রীসহ বিভিন্ন মানুষের কার্যকলাপ ও কথার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘অন্যদিন’ চলচ্চিত্রে।

বহুল কাক্সিক্ষত এই চলচ্চিত্রটিকে দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহে দেখতে পাবেন এই মাসেই। গতকাল রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সের সীমান্ত সম্ভার শাখায় ছবিটির একটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এটি আমন্ত্রিত দর্শকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের মে মাসে সেন্সর বোর্ড ‘অন্যদিন’-কে আটকে দেয়। কেননা ছবিটিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনী পরিবেশ, রাজনীতিসহ নানা কিছু নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, ‘অন্যদিন’-কে মুক্তির ছাড়পত্র দিয়েছে নবগঠিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’।

‘অন্যদিন’ মূলত ২০১৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল সিলেকশন সিনফন্দেশিওনের ছবি। এই  ছবির জন্যই ২০১৬ সালে লোকার্নোর পিয়াতজা গ্রান্দায় বাংলাদেশের প্রথম কোনো নির্মাতা হিসাবে ‘ফিচারড ডিরেক্টর’-এর সম্মাননা পেয়েছিলেন কামার আহমাদ সাইমন, সেইসাথে ফ্রান্স থেকে আর্তে ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ। এছাড়াও ২০১৪’তে সানড্যান্স থেকে গ্রান্ট এওয়ার্ড জয় করে ‘অন্যদিন’।

পরবর্তী সময়ে, ২০২১ সালে, বিশ্বের প্রথম সারির উৎসবগুলার অন্যতম প্রধান ইডফা'র মূল প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর সুন্দরতম আমস্টারডামের তুসান্সকি থিয়েটারে 'ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার’ বা অভিষেক হয়েছিল সিনেমাটির। ইডফা'র ওয়েবসাইটে ‘অন্যদিন’কে লেখা হয়েছিল ‘ক্যালাইডোস্কোপিক ও ফিলসফিক্যাল’।

এরপর ২০২২ সালে উত্তর আমেরিকার অন্যতম উৎসব ক্যামডেন থেকে শ্রেষ্ঠ ফিচার ছবির জন্য ‘হ্যারেল এওয়ার্ড’, (উত্তর আমেরিকার ‘ক্যামডেন’ চলচ্চিত্র উৎসবে মেইনের রকল্যান্ডে অবস্থিত জার্নি’স অ্যান্ড থিয়েটারে ‘অন্যদিন’ এর প্রদর্শনী হয়। এরপর আসে পুরস্কার জেতার খবর। বাংলাদেশে নদী কীভাবে দর্শনগত ঐকতান সৃষ্টি করছে, সাইমনের এই সিনেমায় তা ফুটে উঠেছে বলে জুরিদের ভাষ্য ছিল। চলচ্চিত্র সমালোচক এরিক হাইনস জুরিদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, “এই ছবিকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে আমরা জুরিরা সবাই একমত ছিলাম। একটা গোটা সমাজের শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ চমৎকার এই হাইব্রিড ছবি।”) নিউ-ইয়র্কের মমি’তে সেই বছরের মাত্র ১৮টা নির্বাচিত মাস্টারপিসে সিলেকশন, জুরিখে ‘গোল্ডেন আই’ নমিনেশন, নন্তের ফেস্টিভ্যাল অফ থ্রি কন্টিনেন্টসের প্রতিযোগিতায়, সিডনীতে অফিশিয়াল সিলেকশন। মমি'র ওয়েবসাইটে ‘অন্যদিন...’-এর সেগমেন্টকে বর্ণনা করা হয়েছিল ‘আর্টিস্টিক মাস্টারপিস’ হিসেবে। অস্ট্রেলিয়ার লিডিং ফিল্ম ম্যাগাজিন ‘ফিল্ম-ইংক’ তখন ‘অন্যদিন’ নিয়ে লিখেছিল, ‘ছবিটা সবচাইতে বড়পর্দায় দেখানো উচিত’। স্ক্রিন ডেইলি ‘অন্যদিন...’-এর রিভিউতে লিখেছে ‘সিডাকটিভ’ আর ভ্যারাইটি লিখেছে ‘কৌতুকপূর্ণ কিন্তু বিবেক নাড়া দেয়’।

‘অন্যদিন’ কামার আহমাদ সাইমন নির্মিতব্য জলত্রয়ীর দ্বিতীয় সিনেমা।  মূলত জলত্রয়ীর প্রথম সিনেমা ‘শুনতে কি পাও!’ দিয়ে আলোচনায় আসেন কামার। ছবিটির জন্য  প্যারিসের জর্জ পম্পিদ্যু সেন্টারে সিনেমা দ্যু রিলে শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য গ্রাপ্রি এবং মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণশঙ্খ জয় করেন আরও অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননা। এছাড়াও ছবিটি পেয়েছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

Leave a Reply

Your identity will not be published.