নাজমা জেসমিন চৌধুরী / প্রতিকূল স্রোতের যাত্রী

নাজমা জেসমিন চৌধুরী / প্রতিকূল স্রোতের যাত্রী

গবেষক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত নাজমা জেসমিন চৌধুরী। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় তাঁর লেখা সমৃদ্ধ। বাংলা উপন্যাসের রাজনৈতিক ধারাকে মার্কসীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। ঢাকার শিশু-কিশোর নাট্য-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাজমা জেসমিন চৌধুরী। ১৯৭৮ সালে ঢাকা লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই সংখ্যায় তুলে ধরা হলো প্রয়াত এই লেখক ও গবেষকের পৈতৃক ভিটাকে। লিখেছেন মোমিন রহমান।

পথ শুয়ে থাকে পথের মাঝে। সত্যিই তাই, পথে নামলে পথই পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। যদিও গন্তব্য পথে থাকে নানা বাধা-বিঘ্ন, গুল্ম-কাঁটা। এইসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ঠিকই আমরা পৌঁছে যাই কাক্সিক্ষত ঠিকানায়, এদেশের প্রয়াত লেখকদের পূর্বপুরুষদের ভিটায়।

এই গ্রামের এক নারী নাজমা জেসমিন চৌধুরী। আলোকিত এই মানুষটি, লেখক-গবেষক-নাট্যকারটি ছিলেন ঋজু চরিত্রের অধিকারী। প্রতিকূল স্রোতের মাঝেও জীবন-তরী চালনা করেছেন সব সময়। তাঁর স্বামী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, “একটি মেয়ে এগুতে চেয়েছিল। পরিবেশের সব বৈরিতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল তার। কাদা, কাঁটা, খাল, লেভেল ক্রসিং সব পার হয়ে অনেকটা এগুলো সে। আরও তার যাবার ছিল। কিন্তু পারল না। ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ল। প্রাকৃতিক নয়, মানবিক। নাজমা, এই তোমার কাহিনি।”

আমরা যাচ্ছি লড়াকু মানসিকতার অধিকারিণী প্রয়াত লেখক-গবেষক-নাট্যকার নাজমা জেসমিন চৌধুরীর পৈতৃক ভিটায়। পথই এক সময় আমাদের পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। আমরা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত নাজমা জেসমিন চৌধুরীর পৈতৃক ভিটায় পা রাখি। দেখতে পাই আশেপাশের খালি জমির মাঝে টিনের একটি দোতলা ঘর দণ্ডায়মান।

দোতলা ঘরটিই নাজমা জেসমিন চৌধুরীদের পরিবারের স্মৃতি বহন করছে। তবে এখানে, এই টুঙ্গিপাড়ায়, নাজমা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন নি। তাঁর জন্ম কলকাতায়, ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর।

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর ডাক নাম ছিল মেরী। তাঁরা ছিলেন পাঁচ বোন দুই ভাই—রানী, মণি, পুতুল, মেরী, ছবি, বাবলু ও লাবলু। মা সুলতানা রাজিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। বাবা গোলাম সারোয়ার ছিলেন পুলিশের গোয়েন্দা। বিএসসি পাস করার পরেই তাঁর এই কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কলকাতায়। সেখানে তাঁর বাড়িও ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। গেণ্ডারিয়াতে বাড়ি পান। তবে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারেন নি। চাকরিসূত্রে নানা জায়গায় যেতে হয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে গোলাম সারোয়ার, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর বাবা, গেণ্ডারিয়ার বাড়িটি বিক্রি করে দেন এবং ধানমণ্ডির সরকারি বরাদ্দের প্লটে তৈরি নতুন বাড়িতে সপরিবার উঠে আসেন।

কলকাতার টালিগঞ্জের এক স্কুলে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। পরে সপরিবার ঢাকায় এলে কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। কিন্তু ঢাকায় বেশিদিন থাকা হয় নি তাঁর। বাবার সঙ্গে তাঁদেরও ময়মনসিংহ, বরিশাল, রাজশাহী করতে হয়েছে। ফলে ঘনঘন স্কুলও বদলেছে। ১৯৫৫ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন রাজশাহীর পিএন বালিকা বিদ্যালয় থেকে। আইএ পাস করেন তিনি রাজশাহীর সরকারি কলেজ থেকে, ১৯৫৭ সালে। তারপর ঢাকায় এসে ভর্তি হন সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে। এখান থেকেই ১৯৫৯ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন নাজমা। তারপর বেশ কয়েক বছর পরে, ১৯৭৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল : বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি।

টুঙ্গিপাড়ায় নাজমা জেসমিন চৌধুরীর পৈতৃক ভিটায় দাঁড়িয়ে আমরা। আমি চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি। অন্যদিন-এর ফটোগ্রাফার বিশ্বজিৎ সরকার ক্যামেরা-বন্দি করছে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত ঘরটিকে—নানাভাবে, ক্যামেরার নানা দৃষ্টিকোণে।

ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় খুব একটা থাকেন নি নাজমা জেসমিন চৌধুরী। তবে গ্রাম তাঁকে টানত। মাটির কাছাকাছি থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। মনে পড়ে, মুস্তফা মজিদ স্মৃতিচারণ করেছেন—কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার পরিচালক দাদাভাইয়ের নেতৃত্বে শুভেচ্ছা সফরে একবার এই ফরিদপুরেরই পাংশায় এসেছিলেন নাজমা জেসমিন চৌধুরী। সেবারের সেই দীর্ঘ যাত্রায় গোয়ালন্দ ঘাটে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন লেটের কারণে সবাই ক্লান্তি অনুভব করলেও নাজমা ক্লান্ত হন নি। উৎফুল্ল ছিলেন। তিন দিন পাংশায় কাটিয়ে ঢাকায় ফেরার পরে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। বারবার বলেছিলেন, “দীর্ঘদিন গ্রামে যাই নি। গ্রামে যাবার এই অভিজ্ঞতা আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে।” সেলিম ওমরাও খানের স্মৃতিকথাও মনে পড়ে, যা থেকে আমরা জানতে পারি যে, টুঙ্গিপাড়ার প্রতি তাঁর অন্তরের টান ছিল। তাই তো শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এলাকার ছেলেদের অনুরোধে একটি লেখা দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। এলাকার কথাও জানতে চান। সেলিম ওমরাও খান লিখেছেন, “সেদিন আমি লক্ষ করেছিলাম, তা হলো আলাপের ফাঁকে ফাঁকে উনি যেন কেমন নীরব হয়ে যাচ্ছিলেন। পরে বুঝতে পেরেছিলাম হয়তো নিজের আদিপুরুষের ভিটে গ্রাম এবং তার স্মৃতিতে তিনি ডুবে গেছেন।”

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর ভাবনায় মগ্ন আমি সচকিত হই একদল ছেলেমেয়ের কলকাকলীতে। তারা বয়স্ক এক লোককে ঘিরে নানা কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল যে, বয়স্ক লোকটি হচ্ছে তাদের স্কুলের শিক্ষক। সামনে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এই বিষয়ে তাদের নানা কৌতূহল। তাদের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন শিক্ষক ভদ্রলোক এবং তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়—সেটি তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বলে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আবার মনে পড়ে যায় নাজমা জেসমিন চৌধুরীকে। তিনিও ছাত্র-ছাত্রী মহলে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আর এই জনপ্রিয়তা তিনি অর্জন করেছিলেন হৃদয় উৎসারিত ভালোবাসার কারণে। তিনি শিক্ষাদানকে একটি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করার পরেই ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন, অধ্যাপিকা হিসেবে। ইংল্যান্ডে গমন এবং গবেষণার কারণে কয়েক বছর ছাড়া তিনি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একটানা এই কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে, বাংলার প্রভাষক হিসেবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। যদিও তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার—কিন্তু ঈর্ষাকাতর কিছু মানুষের কারণে সেটি সম্ভব হয় নি। কিন্তু বিদেশি ছেলেমেয়েদের ভাষা শেখানোর কাজটিও তিনি অবহেলা করেন নি। প্রতিদানে পেয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা এবং তা মৃত্যুর পরেও। মনের মাঝে ভিড় করল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা কথাগুলো—“তোমার বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই বন্ধু ছিল তোমার, সে যে দেশেরই হোক না কেন। চীনা ছেলেমেয়েরা প্রথম যখন অপারেশন হয় তোমার, তখন দলবেঁধে হাসপাতালে গেছে সবাই। ফুল, খাবার ও শুভেচ্ছা নিয়ে। মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া মাত্র চলে এসেছে সকলে। ছায়ার মতো অনুসরণ করল তোমার শব-শোভাযাত্রা। জানাজার সময় ছিল। গোরস্তানে গেছে, কবরের ওপর পরিষ্কার বাংলায় শ্রদ্ধা জানানোর কথা লেখা ফুলের মালাটি রেখে তবে ফিরেছে।”

টুঙ্গিপাড়ায়, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর পৈতৃক ভিটায়, দাঁড়িয়ে আমি। লক্ষ করি, বিশ্বজিৎ দোতলা ঘরটিকে বাইরে থেকে নানাভাবে ক্যামেরাবন্দি করে এবারে ঘরে ঢুকছে। আমিও ওকে অনুসরণ করি। আগেই জেনেছিলাম যে, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর ভাইবোনদের কেউই আর গ্রামে আসেন না। ঘরটিকে পরিত্যক্তই বলা যায়। ভেতরের অবস্থা এই কথা আরও ভালোভাবে জানান দিল। দেখলাম পুরো ঘরটিই প্রায় ফাঁকা। কয়েকটি মাত্র আসবাবপত্র রয়েছে—একটি ড্রেসিং টেবিল, একটি আয়না, একটি চেয়ার, আলমিরা...। লক্ষ করি, দোতলায় যাওয়ার একটি কাঠের মইও একপাশে দণ্ডায়মান। বলাই বাহুল্য, এইসব আসবাবপত্রের সঙ্গে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত, যেন এগুলোকে স্পর্শ করলেই নাজমা জেসমিন চৌধুরীর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে। স্পর্শ করলাম। কই না, কোথায় নাজমা জেসমিন চৌধুরী ? অথচ তাঁর লেখা যখন পড়ি, তখন তিনি যেন মূর্ত হয়ে ওঠেন লেখার মাঝে। তাঁর অনুভব, তাঁর ভাবনা, এমনকি তাঁর ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত টের পাই চেতনায়।

নাতিদীর্ঘ জীবনে নাজমা জেসমিন চৌধুরী উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক—সবই লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—সামনে সময় (১৯৮১), ঘরের ছায়া (১৯৮৪); গল্পগ্রন্থ—অন্য নায়ক (১৯৮৫); মেঘ কেটে গেলে (১৯৮৮); গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ—বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি (১৯৮০), সাহিত্যের সামাজিকতা (১৯৮৫), নাটক—ঘুম নেই (১৯৭৯), অন্যরকম অভিযান (১৯৮১), ওরা ছিল বাগানে (১৯৮৯), যেমন খুশি সাজো (১৯৯১); ছোটদের গল্পগ্রন্থ—বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৮৭); রূপান্তর গ্রন্থ—কিশোর সংশপ্তক (১৯৮৬); সম্পাদিত গ্রন্থ : মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলী (১ম খণ্ড, ১৯৮৫)। অগ্রন্থিত লেখার মধ্যে রয়েছে—উপন্যাস : শেষ ঠিকানা, লোকে বলে, আমার খোকা যায়, ভোর হয় রাত হয়; গল্প : জিতলো কারা; ছোটদের গল্প : ভয়ের আড়ালে; নাটক : আলোয় ফেরা; রূপান্তরিত নাটক : তাসের দেশ; টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক : খেলা, ছাড়পত্র, পালাবদলের পালা, প্রথম অঙ্গীকার, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রিয়জন, ঘরের ছায়া; রেডিওতে প্রচারিত নাটক : শেষ পরিচয়, হিংসুটে দৈত্য।

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সবচেয়ে বড় কীর্তি—‘বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি’। এই বইটি সম্পর্কে প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন; “বাংলাদেশে সমালোচকের অভাব, নারীরা তো সমালোচনাকে ভয়ই পায়। আমাদের নারীরা যখন সমালোচনা জাতীয় কিছু লেখেন, তখন তাতে সমালোচককে ঢেকে ফেলে বড় হয়ে ওঠে নারীটি; কিন্তু ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী এই বইটি লিখেছেন গবেষক-সমালোচক রূপে, নারীরূপে নয়। তিনি এমন একটি বই লিখে গেছেন, যা তাঁকে জীবিতদের সঙ্গী করে রাখবে অন্তত আরও পাঁচ দশক। এটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, কিন্তু এটি পেরিয়ে গেছে আমাদের অঞ্চলের সন্দর্ভের মলিন সীমাবদ্ধতা।”

গল্প, উপন্যাস, নাটক—নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সৃষ্টিশীলতার এই তিনটি ক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন ইত্যাদি তাঁর গল্পের পটভূমিতে এসেছে। তবে দুটি গল্পগ্রন্থে নাজমা জেসমিন চৌধুরী প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনকে নানাভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, তাঁর গল্পগুলি জীবনচিত্রের উদ্ভাসন শুধু নয়, এগুলো বক্তব্যধর্মীও। তাই নাজমা জেসমিন চৌধুরীকে সমাজমনস্ক ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কথাসাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় অনায়াসে। তাঁর দুটি উপন্যাস—‘সামনে সময়’ এবং ‘ঘরের ছায়া’-য় নারীর সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে সামাজিক সমস্যাকে যে নাজমা শুধু হৃদয় দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়েও অনুভব করেছেন—উপন্যাস দুটি পড়লে তা বোঝা যায়।

নাটকেও নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সমাজবোধ লক্ষ করা যায়। এমনকি ছোটদের জন্য রচিত নাটকেও রূপকথার আশ্রয়ে তিনি সামাজিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং শিশুদের দেখেছেন ভবিষ্যৎ হিসেবে।

একজন সংগঠক হিসেবেও নাজমা জেসমিন চৌধুরী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি শিশু-কিশোর নাট্যদল ‘ঢাকা লিটল থিয়েটার’ গঠন করেন। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অভিযাত্রিক কিশোর নাট্যগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা এবং ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘মনন’-এর। তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ বার্ষিকীর সম্পাদিকা (দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে) এবং ব্রিটেনের লেস্টারে ইস্ট পাকিস্তান সোসাইটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৬-৬৭ সালে।

নাজমা জেসমিন চৌধুরীর যে-কোনো মজলিস জমিয়ে রাখার অনন্য গুণ ছিল। মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। অতিথিপরায়ণ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। আর জানা-অজানা কত মানুষকে কতভাবে যে তিনি সাহায্য করেছেন! বিপদে-সংকটে অনেকেই তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিত। পরিচিতদের অনেকেরই অসুখের সময় তিনি সাহায্য করেছেন; নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, তিনি যখন দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী তখন পরিচিতজনদের কাছে দেখা দিতে চান নি। কেন ? অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু আসলে হয়েছিল কী, নাজমা জেসমিন চৌধুরী করুণার পাত্র হতে চান নি। তিনি হাসতে হাসতে একবার স্বামী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে বড় কষ্ট কি জানো, করুণার পাত্র হওয়া।’

না করুণার পাত্র তাঁকে হতে হয় নি, হতে হয় নি কারও গলগ্রহ, অবেলায় অসময় ফুলের মতোই তিনি নিঃশব্দে ঝরে গেলেন। সেদিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯।

টুঙ্গিবাড়ি থেকে ফিরছি। অসমান পথে গাড়ি চলতে গিয়ে দুলছে, দুলছি আমরাও। বিশ্বজিৎ জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে চেয়ে আছে। আমি কিন্তু প্রকৃতিতে নিমগ্ন নই। আমার চেতনা আর ভাবনায় তখন নাজমা জেসমিন চৌধুরী—যিনি প্রয়াত হয়েও আশ্চর্য রকম জীবন্ত। মনে পড়ে গেল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘বন্ধুর মুখচ্ছবি’র কয়েকটি লাইন : “জীবন ও মৃত্যুর রহস্য ভেদ করবে কে! জীবিতরা সবাই জীবিত নয়, মৃতরাও মৃত নয়—সবাই। এই জ্ঞানও কোনোই সান্ত্বনা নয়, কিন্তু এ যে সত্য সে দেখছি তোমার ক্ষেত্রে এসে। আমাদের, জীবিতদের জীবিত থাকার একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে ওই জ্ঞান যে মৃতরা মৃত নয়। নইলে ওই শূন্যতা ভরতাম কী দিয়ে ?’

আসলেই তাই, এই বিকেলে টুঙ্গিপাড়ার নির্মেঘ আকাশে যেন নাজমা জেসমিন চৌধুরীর মুখচ্ছবি বড় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে।

 

[অন্যদিন, মে ২০০৫-এ প্রথম প্রকাশিত]

Leave a Reply

Your identity will not be published.