[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।
এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের অজানা কিছু বিষয়। আর এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটল নায়রাজ রাজ্জাকের জীবন ও ক্যারিয়ারের উপাখ্যানের।]
নায়করাজের নানা বিষয়ের ওপর আলো দেখা হয়েছে আগের অধ্যায়গুলোতে। আমরা জেনেছি, তার শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলির বিভিন্ন দিক, এদেশে তার আগমন, কঠিন জীবন সংগ্রাম, জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প। তার সেরা ছবি, কয়েকজন নায়িকার সঙ্গে তার জুটির কথাও জেনেছি। তার চলচ্চিত্রে সেরা গান, কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর কথা এবং উল্লেখযোগ্য পরিচালকের বিষয়ে হয়েছি অবগত। পরিচালক রাজ্জাকের কথাও কম-বেশি জানা গেছে । এমনকি টালিগঞ্জে তার দ্বিতীয় ইনিংসের বিষয়েও।
এবার আমরা জানব অন্য রাজ্জাক সম্পর্কে, যিনি ভিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত। এই রাজ্জাক সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। চেনা রাজ্জাকের অজানা সেইসব বিষয়ই উন্মোচিত হবে এখানে।
রাজ্জাক কখনোই তার অতীতকে ভোলেন নি। নিজের শিকড়কে ভোলেন নি। তাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বারবার ছুটে গেছেন কলকাতায়, ছুটে গেছেন টালিগঞ্জের নাকতলাতে। কখনো কখনো স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েও গেছেন। পাড়ার যে চায়ের দোকানে চা খেতেন, সেই নড়ার চায়ের দোকানের সামনেও দাঁড়াতেন সবসময়।
রাজ্জাক যখন উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এদেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকার স্টেডিয়াম এলাকায় লাইটপোস্টের নিচে বসেছিলেন স্ত্রী লক্ষ্মী ও ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে। সেই বিষয়টি তিনি ভোলেন নি। তাই ১৯৭২ সালে যখন তিনি নিজের প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্স গড়ে তোলেন, তখন সংস্থাটির লোগো হিসেবে ডিজাইনার সুভাষ দত্তকে যে আইডিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে সেই অতীতের ছায়া রয়েছে। লোগোতে দেখা যায়Ñ পথের মাঝে একটি লাইটপোস্টের নিচে বসে আছে একলোক, পাশে একটি ডাস্টবিন। ... ঢাকায় আসার পরে শুরুতে ইকবাল ফিল্মসে কাজ পান সহকারী পরিচালকের। কাজ করেন কামাল আহমেদের দুটি ছবিতে ‘উজালা’ এবং ‘পরওয়ানা’-তে। কাজ অবশ্য বিশেষ কিছু নয়। টুকিটাকি কাজ। ক্লাপস্টিক দেওয়া, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চা খাওয়ানো ইত্যাদি। ১৯৮৬ সালে তারকালোক ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘রাজ্জাকের জানা-অজানা যত কথা’। সেখানে মুদ্রিত একটি ছবিতে দেখা যায়Ñ ‘পরওয়ানা’ ছবির সহকারী পরিচালক রাজ্জাক নূপুর বেঁধে দিচ্ছেন অভিনেত্রী মর্জিনার পায়ে। তখন বাসে যাতায়াত করতেন রাজ্জাক। কখনো কখনো পয়সার অভাবে হেঁটে যেতেন টিভি অফিসে, কমলাপুরের ভাড়া বাসায়। সেই বাসার ভাড়াও বাকি থাকত মাঝে মাঝে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উপোসও করেছেন কোনো কোনো দিন। রাজ্জাক কিন্তু এইসব কথা কখনো লুকান নি, অকপটে বলেছেন সবাইকে।
একজন বৈষয়িক মানুষ ছিলেন রাজ্জাক। অত্যন্ত দূরদর্শী মানুষও বটে। যখন গুলশানে মানুষজন তেমন কেউ থাকত না, তখন সেখানে বাড়ি করেছেন রাজ্জাক। সেই বাড়িতে সুইমিংপুলও ছিল। আবার প্রথমবার হজ থেকে ফিরে সেই সুইমিংপুল ভেঙে ফেলেন তিনি। ব্যাংকের চার কোটি টাকার ঋণ শোধ করার জন্য বাড়ির কিছু জমি বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করেছেন।...গুলশানের যে জমিতে রাজ্জাকের বাড়ি সেই জমি কেনারও গল্প আছে। মোহাম্মদ আলী নামের এক দালালের মাধ্যমে ওই জমি কিনেছিলেন রাজ্জাক। শুরুতে দালাল অবশ্য ইন্দিরা রোডে জমি দেখিয়েছিল তাকে। কিন্তু ঘিঞ্জি এলাকা বলে পছন্দ হয় নি। গুলশানের ওই জমিটা পছন্দ হয়েছিল। এক বিঘা পাঁচ কাঠার জমি। ওই জমির দাম তখন অনেক। ষাট হাজার টাকা। কিন্তু রাজ্জাকের এক ভক্ত, সালেজী, তিনি সাহায্য করেছিলেন। সালেজীর পরিচিত ছিলেন জমির মালিক। তিনি জমির দাম নিয়েছিলেন পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। শুরুতে পঁচিশ হাজার, পরে কয়েক কিস্তিতে বিশ হাজার। বলা যায়, ভাগ্য রাজ্জাকের সহায় হয়েছিল। মানুষের ভালোবাসাও মিশেছিল রাজ্জাকের জমি কেনার ক্ষেত্রে।
আবার উত্তরায় যখন কোনো মার্কেট ছিল না, তখন রাজ্জাক সেখানে রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স করেছেন; খুলেছেন ‘আলী বাবা’ নামে একটি মিষ্টির দোকান। এ ধরনের দোকানও তখন উত্তরায় ছিল না। উল্লেখ্য, একটি গুঞ্জন ছিল রাজ্জাক সিনেমা হলের নাম করে উত্তরায় মার্কেট করেছেন। না, এটি সত্যি নয়। মার্কেটের কথা বলেই রাজউক থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন রাজ্জাক। পরে সিনেমা হল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রাজউক অনুমতি দেয় নি।
রাজ্জাককে নিয়ে মিথ্যে রটনা বা তাকে ভুল বোঝাÑএ অবশ্য অনেক আগেই দেখা গেছে। যেমন ইলিয়াস কাঞ্চন যখন দুর্ঘটনায় আহত হলেন, রাজ্জাক তখন তার দেখভালের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, যেন তিনি অতিরিক্ত পরিশ্রমে আবার অসুস্থ হয়ে না পড়েন। এ নিয়েও তখন নিন্দুকেরা কথা বলতে ছাড়ে নি। বলেছে—ইলিয়াস কাঞ্চনের জনপ্রিয়তা রাজ্জাকের সহ্য হচ্ছে না। তিনি তার সিডিউল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্রশিল্পের সব ব্যাপারেই এগিয়ে যেতেন রাজ্জাক। কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, কেউ আর্থিক সংকটে পড়লে তাকে সাহায্য করা—এমন নানা ব্যাপারেই তাকে দেখা গেছে। তখন বলা হতো, রাজ্জাক কি চলচ্চিত্র জগতের গার্জেন সাজতে চান ? আবার লক্ষ্মীকুঞ্জে তথা নিজের বাড়িতে রাজ্জাক তখন প্রায়ই পার্টি দিতেন। এইসব পার্টিতে শুধু চলচ্চিত্র জগতের মানুষরা নয়, অন্যসব ক্ষেত্রের মানুষরাও থাকতেন। রাজ্জাক সব শ্রেণির অতিথি আপ্যায়নেই দিল দরিয়া ছিলেন এবং মেজাজও ছিল রাজকীয়। কিন্তু রাজ্জাকের এই পার্টির বিষয়টিকেও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতেন কেউ কেউ। তাদের ভাষ্য ছিল, রাজ্জাক নিজের প্রভাব বলয় ঠিক রাখার জন্যই পার্টির আয়োজন করেন। এটা তার এক ধরনের কৌশল। তিনি যা করেন সবই উদ্দেশ্যমূলক। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তখন রাজ্জাক বলেছিলেন: ‘আমাকে নিয়ে নানা কথা ওঠে। এ ধরনের কথা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না আমার মধ্যে। সব ব্যাপারেই থাকি—একথা ঠিক। আগ বাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে বিদ্যমান। আমার পাড়াতেও কোনো ঘটনা ঘটলে সামনে এগিয়ে যেতাম। কিন্তু নেতা হওয়ার কোনো খায়েশ ছিল না কখনো। আজও নেই। যা করি মনের তাগিদেই করি। এই যেমন মরহুম কাজী খালেকের প্রসঙ্গ তুলেই বলতে পারি। খালেক ভাইয়ের ইন্তেকালের খবর শুনে আমরা সবাই তাঁর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি প্রস্তাব রাখলাম তাঁর মরদেহ এফডিসি প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁর স্ত্রীকে রাজি করালাম। এফডিসিতে নিয়ে এলাম খালেক ভাইয়ের মরদেহ। জানাযা হলো। এখান থেকেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আজিমপুর গোরস্থানে। আমরা খালি পায়ে লাশের সঙ্গে সঙ্গে চললাম।...আমার কাছে চিত্রজগতের অনেকেই আসেন, আগেও এসেছেন। আমার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য করেছি। এবং এখনো করছি। আর ওরাই আমাকে সামনে টেনে এনেছেন। লক্ষ করেছি, সবাই দায়িত্বটা আমার কাঁধে চেপে দিতে চেয়েছেন।...এইসব কাজ করে যদি কোনো সুযোগ নিতাম, তাহলেই না হয় কথা ওঠা স্বাভাবিক ছিল। তা তো নিই না। কাজ শেষ এবং আমার দায়িত্ব শেষ। গার্জেনি ফলাবার জন্য বাড়তি কিছুই করি নি। আমার বাড়িতে পার্টি দেওয়া নিয়েও বলা হয়। আসলে ফিল্মের লোকজন একটু হইচই পছন্দ করেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও হইচই ভালোবাসি। আর এ কারণেই পার্টি দেওয়ার মাধ্যমে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করি। যারা এ নিয়ে পলিটিক্স খোঁজার চেষ্টা করে, তাদেরকে আমার বলার কিছুই নেই।’ (ঈদসংখ্যা পূর্বাণী, ১৯৮১, পৃ. ৩৭) উল্লেখ্য, প্রথমবার হজ করে আসার পরে বাড়িতে পার্টি দেওয়া বন্ধ করেন রাজ্জাক।
রাজ্জাক অতিথি চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। যেমন মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে একটি গানের দৃশ্যে তাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।...বন্ধু ও সহকর্মীদের ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অভিনয় করেছেন। যেমন গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সমাধি’-তে অভিনয় করে রাজ্জাক কোনো সম্মানী নেন নি। শোনা যায় কবরী প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘গুণ্ডা’-তে কোনো পারিশ্রমিক নেন নি রাজ্জাক (অবশ্য কবরীও নাকি ‘রংবাজ’-এ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। ছবিটি ছিল রাজ্জাক প্রযোজিত প্রথম ছবি)।
রাজ্জাক খেয়ালি মানুষ ছিলেন। যখন যা মন চাইত, তখন তা-ই করতেন। এ প্রসঙ্গে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভাষ্য হলো: “একবার সিলেটে গিয়েছি শুটিং করতে। সঙ্গে রাজ্জাকসহ পুরো দল। হঠাৎ রাজ্জাক বললেন, ‘আজ শুটিং করব না, আজ পাখি মারব।’ তখন সিলেটের একটি বিলে পাখি মারলেন পুরো বিকেল। আমরা পুরো ইউনিট বসা। কিন্তু পরের দিন খুব ভোরে উঠে আমার রুমের দরজায় নক করছেন আর বলছেন, ‘চা গরম, এই চা গরম।’ দরজা খুলে দেখি রাজ্জাক। তারপর বললেন, ‘চা খাইতে হবে না! শুটিং আছে তো।’ তারপর বললেন, ‘কালকের বাকি শুটিংটা করব বলেই তো এত ভোরে উঠলাম।’ এই হলেন রাজ্জাক।”
১৯৭৮ সালে রাজ্জাক ‘অগ্নিশিখা’ ছবিতে প্লেব্যাক করেন। ছবিতে নিজের গাওয়া গানের সঙ্গেই ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তিনি।
রাজ্জাকের মৃত্যুর পর বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ জানিয়েছেন একটি নতুন তথ্য। রাজ্জাক নাকি জাদুকর ছিলেন। জুয়েল আইচের ভাষ্য হলো: ‘রাজ্জাক ভাই ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। ক’জন জানেন ? টালিগঞ্জের নাকতলা থেকে ঢাকা এলেন। দুঃসহ জীবন সংগ্রাম। ম্যাজিক শিকেয় উঠল। কিন্তু জাদুর প্রতি পাগলামিটা রয়ে গেল। যে-কোনো আড্ডায় ম্যাজিকের গল্পে আসর মাতিয়ে তুলতেন।’
রাজ্জাক অভিনয় ছাড়া ছবি পরিচালনা করেছেন—আমরা জানি। তবে চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন নি কখনো। অবশ্য মাঝে মাঝে অনুরোধের ঢেঁকি গেলার মতো কয়েকটি ছবির শেষ দৃশ্যের স্ক্রিপ্ট ও সংলাপ মুখে মুখে বলতেন এবং অন্যরা তা লিখত। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাক বলছেন: “আমার নিজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে নাক গলাই নি। তবে আমি একটুখানি সহযোগিতা করেছি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে। স্ক্রিপ্ট রাইটার বা ডায়লগ রাইটার যখন এসে বলেন, ‘এই জায়গাটায় ফেঁসে গেছি, আপনার সাহায্য দরকার।’ তখন আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। বলেছি, ‘দেখেন, এভাবে হয় কিনা।’ উদাহরণ দেই, ‘সৎভাই’ ছবি করার সময়, ওটা ছিল শরৎচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে। রফিকুজ্জামান সাহেব স্ক্রিপ্ট রাইটার। লাস্ট সিনের সময় তিনি বললেন যে, এটা তো আমার মাথায় নেই, শরৎচন্দ্রও স্পষ্ট করে কিছু লিখেন নি। বলেছেন ‘অন্তর্যামী জানেন’। রফিকুজ্জামান মজা করে বললেন, অন্তর্যামী না, ওটা রাজ্জাক সাহেব জানেন। দুদিন পর সকালে আমার ছেলে এসে বলছে, ‘সিন তো রেডি, দেখো কী করা যায়।’ আমি বললাম, ‘টেপ রেকর্ডার আনো।’ সবাই বসে আছে, কার কী ডায়লগ হবে মুখে মুখে বললাম, বুঝিয়ে দিলাম সবাইকে। তারপর লেখা হলো কাগজে, শুটিং হলো।” আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘মাটির ঘর’ ছবির শেষ দৃশ্যটিও এভাবে রাজ্জাক মুখে মুখে বলেছিলেন এবং অন্যরা তা লিখে নিয়েছিল। পরিচালক জহিরুল হকের বিভিন্ন ছবির শেষ দৃশ্যও রাজ্জাকের পরিকল্পনা মতো ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। এটিএম শামসুজ্জামানের লেখা কয়েকটি ছবির শেষ দৃশ্যও রাজ্জাকের ধারণা অনুযায়ী রূপায়িত হয়েছে।
সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবেও রাজ্জাক কাজ করেছেন। তিনি নোট নিতেন না ঠিকই তবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ছবি দেখতেন। সবই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র। তিনি তেমন খুঁত ধরতেন না। তবে কোনোকিছু আপত্তিকর মনে হলে তা জানাতেন। বাণিজ্যিক ধারার একজন হলেও তিনি অনৈতিক কোনো কিছুতে ছাড় দিতেন না।...সেন্সর বোর্ডের উন্নয়নেও রাজ্জাক অবদান রেখেছেন। মান্ধাতা আমলের আইন দ্বারা সেন্সর বোর্ড পরিচালিত হতো, তা কিছুটা হাল নাগাদ ও পরিমার্জনা করার জন্য ২০১০ সালে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন রাজ্জাক। তিনি কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন।
রাজ্জাক জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত মনোনীত হয়েছিলেন ২০০১ সালে। এই সূত্রে তিনি অনন্য আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি অর্জন করেন। দেশের নানা জায়গায় তখন তিনি ছুটে গেছেন জাতিসংঘের দূত হিসেবে। এই বিষয়টি চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য এফডিসির শিল্পী সমিতির সামনে রাজ্জাকের নামে নামফলক স্থাপন করা হয়—বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের পক্ষে।
রাজনীতির সঙ্গে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না রাজ্জাক। তিনি যখন বাড়িতে পার্টি দিতেন, সেখানে মন্ত্রীরা আসত, সচিবরা আসত। তারা তাকে রাজনীতিতে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করত। একদা তাকে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অফার দেওয়া হয়েছিল; মেয়র করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্জাক কিছুতেই রাজি হন নি। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘আমার জগৎ, ধ্যানজ্ঞান—সবই ছিল চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়কে কেন্দ্র করে। অভিনয়টাই ছিল রক্তের ভেতর। হ্যাঁ, হয়তো রাজনীতি করতে পারতাম, এমপি-মিনিস্টার হতে পারতাম। কিন্তু এটা তো আমার স্বপ্ন বা পেশা নয়। আমি স্বপ্ন দেখেছি নায়ক হব, ভালো অভিনেতা হব। কিন্তু নিজের অন্তরে যা বসাতে পারব না, সেটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করব কেন ? আমার পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমি কেন রাজনীতি করব ?’
রাজ্জাক চলচ্চিত্রে কয়েকজন নতুন মুখ উপহার দিয়েছেন। নিজের মেয়ে ময়নাকে তিনি অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছেন। পাগলা রাজা, জোকার এবং মৌচোর ছবিতে। কিন্তু ময়না চলচ্চিত্রে থিতু হতে চায় নি। পরে নায়িকা হিসেবে কাজরীকে ব্রেক দেন ‘জোকার’ ছবিতে। কাজরী নামটিও তার দেওয়া। পরে ‘সৎভাই’ ছবিতে আলীরাজকে ব্রেক দেন। আলীরাজ নামটিও রাজ্জাক প্রদত্ত।...১৯৮৬ সালে ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ ছবিতে নিজের ছেলে বাপ্পাকে নায়ক হিসেবে সুযোগ দেন। বাপ্পার নতুন নাম হয় বাপ্পারাজ। ২০০৭ সালে ‘আমি বাঁচতে চাই’ ছবিটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন রাজ্জাক। এখানে নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় রাজ্জাকের ছোট ছেলে সম্রাটের।...কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলমের প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনেও রাজ্জাকের অবদান রয়েছে। ‘রংবাজ’ ছবিতে জসিমকে সুযোগ দিয়েছিলেন অ্যাকশন ডিরেক্টর ও অভিনেতা হিসেবে। পরবর্তী সময়ে জসিম শুধু অ্যাকশন ডিরেক্টরই নয়—নায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
রাজ্জাক একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। স্রষ্টার ওপর অটল বিশ্বাস ছিল তার। কয়েকবার হজ করেছেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন (প্রথমবার হজ করে আসার পরে তিনি ধর্মের দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়েছিলেন)। তার গুলশানের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আজাদ মসজিদ। এই মসজিদটির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এর সঙ্গে রাজ্জাকের সম্পর্ক ছিল। এই মসজিদের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে রাজ্জাকের সেজদার স্পর্শ পড়ে নি (শেষদিকে অবশ্য তিনি বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন)। ফজর নামাজের সময় তিনি কোনো কোনো দিন ইমাম আসার আগে মসজিদে চলে আসতেন।
রাজ্জাকের মৃত্যুর আগেই কয়েকবার গুজব রটে যে তিনি মারা গেছেন। একথা শুনে সংগত কারণেই তিনি ব্যথিত হয়েছেন। বলেছেন, ‘এরকম সংবাদ রটানো ঠিক নয়। আল্লাহ যেদিন চাইবেন সেদিনই আমি চলে যাব। আমি প্রস্তুত হয়েই আছি।’ হ্যাঁ, প্রস্তুত রাজ্জাক স্রষ্টার ডাকে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। কয়েকবার অত্যন্ত গুরুতর অবস্থায় রাজ্জাক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না। সেদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজ্জাক মারা যান।
আবদুর রাজ্জাক নামক মানুষটির মৃত্যু ঘটেছে। নায়করাজ রাজ্জাক কিন্তু বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন সেলুলয়েডে, বেঁচে আছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। বেঁচে আছেন অগণিত চলচ্চিত্র অনুরাগীর হৃদয়ে।
ধারাবাহিক রচনা
নায়করাজ রাজ্জাক
(পর্ব-১৩)
মোমিন রহমান
[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।
এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের অজানা কিছু বিষয়। আর এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটল নায়রাজ রাজ্জাকের জীবন ও ক্যারিয়ারের উপাখ্যানের।]
নায়করাজের নানা বিষয়ের ওপর আলো দেখা হয়েছে আগের অধ্যায়গুলোতে। আমরা জেনেছি, তার শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলির বিভিন্ন দিক, এদেশে তার আগমন, কঠিন জীবন সংগ্রাম, জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প। তার সেরা ছবি, কয়েকজন নায়িকার সঙ্গে তার জুটির কথাও জেনেছি। তার চলচ্চিত্রে সেরা গান, কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর কথা এবং উল্লেখযোগ্য পরিচালকের বিষয়ে হয়েছি অবগত। পরিচালক রাজ্জাকের কথাও কম-বেশি জানা গেছে । এমনকি টালিগঞ্জে তার দ্বিতীয় ইনিংসের বিষয়েও।
এবার আমরা জানব অন্য রাজ্জাক সম্পর্কে, যিনি ভিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত। এই রাজ্জাক সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। চেনা রাজ্জাকের অজানা সেইসব বিষয়ই উন্মোচিত হবে এখানে।
রাজ্জাক কখনোই তার অতীতকে ভোলেন নি। নিজের শিকড়কে ভোলেন নি। তাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বারবার ছুটে গেছেন কলকাতায়, ছুটে গেছেন টালিগঞ্জের নাকতলাতে। কখনো কখনো স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েও গেছেন। পাড়ার যে চায়ের দোকানে চা খেতেন, সেই নড়ার চায়ের দোকানের সামনেও দাঁড়াতেন সবসময়।
রাজ্জাক যখন উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এদেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকার স্টেডিয়াম এলাকায় লাইটপোস্টের নিচে বসেছিলেন স্ত্রী লক্ষ্মী ও ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে। সেই বিষয়টি তিনি ভোলেন নি। তাই ১৯৭২ সালে যখন তিনি নিজের প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্স গড়ে তোলেন, তখন সংস্থাটির লোগো হিসেবে ডিজাইনার সুভাষ দত্তকে যে আইডিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে সেই অতীতের ছায়া রয়েছে। লোগোতে দেখা যায়Ñ পথের মাঝে একটি লাইটপোস্টের নিচে বসে আছে একলোক, পাশে একটি ডাস্টবিন। ... ঢাকায় আসার পরে শুরুতে ইকবাল ফিল্মসে কাজ পান সহকারী পরিচালকের। কাজ করেন কামাল আহমেদের দুটি ছবিতে ‘উজালা’ এবং ‘পরওয়ানা’-তে। কাজ অবশ্য বিশেষ কিছু নয়। টুকিটাকি কাজ। ক্লাপস্টিক দেওয়া, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চা খাওয়ানো ইত্যাদি। ১৯৮৬ সালে তারকালোক ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘রাজ্জাকের জানা-অজানা যত কথা’। সেখানে মুদ্রিত একটি ছবিতে দেখা যায়Ñ ‘পরওয়ানা’ ছবির সহকারী পরিচালক রাজ্জাক নূপুর বেঁধে দিচ্ছেন অভিনেত্রী মর্জিনার পায়ে। তখন বাসে যাতায়াত করতেন রাজ্জাক। কখনো কখনো পয়সার অভাবে হেঁটে যেতেন টিভি অফিসে, কমলাপুরের ভাড়া বাসায়। সেই বাসার ভাড়াও বাকি থাকত মাঝে মাঝে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উপোসও করেছেন কোনো কোনো দিন। রাজ্জাক কিন্তু এইসব কথা কখনো লুকান নি, অকপটে বলেছেন সবাইকে।
একজন বৈষয়িক মানুষ ছিলেন রাজ্জাক। অত্যন্ত দূরদর্শী মানুষও বটে। যখন গুলশানে মানুষজন তেমন কেউ থাকত না, তখন সেখানে বাড়ি করেছেন রাজ্জাক। সেই বাড়িতে সুইমিংপুলও ছিল। আবার প্রথমবার হজ থেকে ফিরে সেই সুইমিংপুল ভেঙে ফেলেন তিনি। ব্যাংকের চার কোটি টাকার ঋণ শোধ করার জন্য বাড়ির কিছু জমি বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করেছেন।...গুলশানের যে জমিতে রাজ্জাকের বাড়ি সেই জমি কেনারও গল্প আছে। মোহাম্মদ আলী নামের এক দালালের মাধ্যমে ওই জমি কিনেছিলেন রাজ্জাক। শুরুতে দালাল অবশ্য ইন্দিরা রোডে জমি দেখিয়েছিল তাকে। কিন্তু ঘিঞ্জি এলাকা বলে পছন্দ হয় নি। গুলশানের ওই জমিটা পছন্দ হয়েছিল। এক বিঘা পাঁচ কাঠার জমি। ওই জমির দাম তখন অনেক। ষাট হাজার টাকা। কিন্তু রাজ্জাকের এক ভক্ত, সালেজী, তিনি সাহায্য করেছিলেন। সালেজীর পরিচিত ছিলেন জমির মালিক। তিনি জমির দাম নিয়েছিলেন পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। শুরুতে পঁচিশ হাজার, পরে কয়েক কিস্তিতে বিশ হাজার। বলা যায়, ভাগ্য রাজ্জাকের সহায় হয়েছিল। মানুষের ভালোবাসাও মিশেছিল রাজ্জাকের জমি কেনার ক্ষেত্রে।
আবার উত্তরায় যখন কোনো মার্কেট ছিল না, তখন রাজ্জাক সেখানে রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স করেছেন; খুলেছেন ‘আলী বাবা’ নামে একটি মিষ্টির দোকান। এ ধরনের দোকানও তখন উত্তরায় ছিল না। উল্লেখ্য, একটি গুঞ্জন ছিল রাজ্জাক সিনেমা হলের নাম করে উত্তরায় মার্কেট করেছেন। না, এটি সত্যি নয়। মার্কেটের কথা বলেই রাজউক থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন রাজ্জাক। পরে সিনেমা হল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রাজউক অনুমতি দেয় নি।
রাজ্জাককে নিয়ে মিথ্যে রটনা বা তাকে ভুল বোঝাÑএ অবশ্য অনেক আগেই দেখা গেছে। যেমন ইলিয়াস কাঞ্চন যখন দুর্ঘটনায় আহত হলেন, রাজ্জাক তখন তার দেখভালের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, যেন তিনি অতিরিক্ত পরিশ্রমে আবার অসুস্থ হয়ে না পড়েন। এ নিয়েও তখন নিন্দুকেরা কথা বলতে ছাড়ে নি। বলেছে—ইলিয়াস কাঞ্চনের জনপ্রিয়তা রাজ্জাকের সহ্য হচ্ছে না। তিনি তার সিডিউল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্রশিল্পের সব ব্যাপারেই এগিয়ে যেতেন রাজ্জাক। কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, কেউ আর্থিক সংকটে পড়লে তাকে সাহায্য করা—এমন নানা ব্যাপারেই তাকে দেখা গেছে। তখন বলা হতো, রাজ্জাক কি চলচ্চিত্র জগতের গার্জেন সাজতে চান ? আবার লক্ষ্মীকুঞ্জে তথা নিজের বাড়িতে রাজ্জাক তখন প্রায়ই পার্টি দিতেন। এইসব পার্টিতে শুধু চলচ্চিত্র জগতের মানুষরা নয়, অন্যসব ক্ষেত্রের মানুষরাও থাকতেন। রাজ্জাক সব শ্রেণির অতিথি আপ্যায়নেই দিল দরিয়া ছিলেন এবং মেজাজও ছিল রাজকীয়। কিন্তু রাজ্জাকের এই পার্টির বিষয়টিকেও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতেন কেউ কেউ। তাদের ভাষ্য ছিল, রাজ্জাক নিজের প্রভাব বলয় ঠিক রাখার জন্যই পার্টির আয়োজন করেন। এটা তার এক ধরনের কৌশল। তিনি যা করেন সবই উদ্দেশ্যমূলক। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তখন রাজ্জাক বলেছিলেন: ‘আমাকে নিয়ে নানা কথা ওঠে। এ ধরনের কথা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না আমার মধ্যে। সব ব্যাপারেই থাকি—একথা ঠিক। আগ বাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে বিদ্যমান। আমার পাড়াতেও কোনো ঘটনা ঘটলে সামনে এগিয়ে যেতাম। কিন্তু নেতা হওয়ার কোনো খায়েশ ছিল না কখনো। আজও নেই। যা করি মনের তাগিদেই করি। এই যেমন মরহুম কাজী খালেকের প্রসঙ্গ তুলেই বলতে পারি। খালেক ভাইয়ের ইন্তেকালের খবর শুনে আমরা সবাই তাঁর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি প্রস্তাব রাখলাম তাঁর মরদেহ এফডিসি প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁর স্ত্রীকে রাজি করালাম। এফডিসিতে নিয়ে এলাম খালেক ভাইয়ের মরদেহ। জানাযা হলো। এখান থেকেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আজিমপুর গোরস্থানে। আমরা খালি পায়ে লাশের সঙ্গে সঙ্গে চললাম।...আমার কাছে চিত্রজগতের অনেকেই আসেন, আগেও এসেছেন। আমার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য করেছি। এবং এখনো করছি। আর ওরাই আমাকে সামনে টেনে এনেছেন। লক্ষ করেছি, সবাই দায়িত্বটা আমার কাঁধে চেপে দিতে চেয়েছেন।...এইসব কাজ করে যদি কোনো সুযোগ নিতাম, তাহলেই না হয় কথা ওঠা স্বাভাবিক ছিল। তা তো নিই না। কাজ শেষ এবং আমার দায়িত্ব শেষ। গার্জেনি ফলাবার জন্য বাড়তি কিছুই করি নি। আমার বাড়িতে পার্টি দেওয়া নিয়েও বলা হয়। আসলে ফিল্মের লোকজন একটু হইচই পছন্দ করেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও হইচই ভালোবাসি। আর এ কারণেই পার্টি দেওয়ার মাধ্যমে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করি। যারা এ নিয়ে পলিটিক্স খোঁজার চেষ্টা করে, তাদেরকে আমার বলার কিছুই নেই।’ (ঈদসংখ্যা পূর্বাণী, ১৯৮১, পৃ. ৩৭) উল্লেখ্য, প্রথমবার হজ করে আসার পরে বাড়িতে পার্টি দেওয়া বন্ধ করেন রাজ্জাক।
রাজ্জাক অতিথি চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। যেমন মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে একটি গানের দৃশ্যে তাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।...বন্ধু ও সহকর্মীদের ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অভিনয় করেছেন। যেমন গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সমাধি’-তে অভিনয় করে রাজ্জাক কোনো সম্মানী নেন নি। শোনা যায় কবরী প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘গুণ্ডা’-তে কোনো পারিশ্রমিক নেন নি রাজ্জাক (অবশ্য কবরীও নাকি ‘রংবাজ’-এ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। ছবিটি ছিল রাজ্জাক প্রযোজিত প্রথম ছবি)।
রাজ্জাক খেয়ালি মানুষ ছিলেন। যখন যা মন চাইত, তখন তা-ই করতেন। এ প্রসঙ্গে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভাষ্য হলো: “একবার সিলেটে গিয়েছি শুটিং করতে। সঙ্গে রাজ্জাকসহ পুরো দল। হঠাৎ রাজ্জাক বললেন, ‘আজ শুটিং করব না, আজ পাখি মারব।’ তখন সিলেটের একটি বিলে পাখি মারলেন পুরো বিকেল। আমরা পুরো ইউনিট বসা। কিন্তু পরের দিন খুব ভোরে উঠে আমার রুমের দরজায় নক করছেন আর বলছেন, ‘চা গরম, এই চা গরম।’ দরজা খুলে দেখি রাজ্জাক। তারপর বললেন, ‘চা খাইতে হবে না! শুটিং আছে তো।’ তারপর বললেন, ‘কালকের বাকি শুটিংটা করব বলেই তো এত ভোরে উঠলাম।’ এই হলেন রাজ্জাক।”
১৯৭৮ সালে রাজ্জাক ‘অগ্নিশিখা’ ছবিতে প্লেব্যাক করেন। ছবিতে নিজের গাওয়া গানের সঙ্গেই ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তিনি।
রাজ্জাকের মৃত্যুর পর বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ জানিয়েছেন একটি নতুন তথ্য। রাজ্জাক নাকি জাদুকর ছিলেন। জুয়েল আইচের ভাষ্য হলো: ‘রাজ্জাক ভাই ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। ক’জন জানেন ? টালিগঞ্জের নাকতলা থেকে ঢাকা এলেন। দুঃসহ জীবন সংগ্রাম। ম্যাজিক শিকেয় উঠল। কিন্তু জাদুর প্রতি পাগলামিটা রয়ে গেল। যে-কোনো আড্ডায় ম্যাজিকের গল্পে আসর মাতিয়ে তুলতেন।’
রাজ্জাক অভিনয় ছাড়া ছবি পরিচালনা করেছেন—আমরা জানি। তবে চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন নি কখনো। অবশ্য মাঝে মাঝে অনুরোধের ঢেঁকি গেলার মতো কয়েকটি ছবির শেষ দৃশ্যের স্ক্রিপ্ট ও সংলাপ মুখে মুখে বলতেন এবং অন্যরা তা লিখত। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাক বলছেন: “আমার নিজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে নাক গলাই নি। তবে আমি একটুখানি সহযোগিতা করেছি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে। স্ক্রিপ্ট রাইটার বা ডায়লগ রাইটার যখন এসে বলেন, ‘এই জায়গাটায় ফেঁসে গেছি, আপনার সাহায্য দরকার।’ তখন আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। বলেছি, ‘দেখেন, এভাবে হয় কিনা।’ উদাহরণ দেই, ‘সৎভাই’ ছবি করার সময়, ওটা ছিল শরৎচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে। রফিকুজ্জামান সাহেব স্ক্রিপ্ট রাইটার। লাস্ট সিনের সময় তিনি বললেন যে, এটা তো আমার মাথায় নেই, শরৎচন্দ্রও স্পষ্ট করে কিছু লিখেন নি। বলেছেন ‘অন্তর্যামী জানেন’। রফিকুজ্জামান মজা করে বললেন, অন্তর্যামী না, ওটা রাজ্জাক সাহেব জানেন। দুদিন পর সকালে আমার ছেলে এসে বলছে, ‘সিন তো রেডি, দেখো কী করা যায়।’ আমি বললাম, ‘টেপ রেকর্ডার আনো।’ সবাই বসে আছে, কার কী ডায়লগ হবে মুখে মুখে বললাম, বুঝিয়ে দিলাম সবাইকে। তারপর লেখা হলো কাগজে, শুটিং হলো।” আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘মাটির ঘর’ ছবির শেষ দৃশ্যটিও এভাবে রাজ্জাক মুখে মুখে বলেছিলেন এবং অন্যরা তা লিখে নিয়েছিল। পরিচালক জহিরুল হকের বিভিন্ন ছবির শেষ দৃশ্যও রাজ্জাকের পরিকল্পনা মতো ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। এটিএম শামসুজ্জামানের লেখা কয়েকটি ছবির শেষ দৃশ্যও রাজ্জাকের ধারণা অনুযায়ী রূপায়িত হয়েছে।
সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবেও রাজ্জাক কাজ করেছেন। তিনি নোট নিতেন না ঠিকই তবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ছবি দেখতেন। সবই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র। তিনি তেমন খুঁত ধরতেন না। তবে কোনোকিছু আপত্তিকর মনে হলে তা জানাতেন। বাণিজ্যিক ধারার একজন হলেও তিনি অনৈতিক কোনো কিছুতে ছাড় দিতেন না।...সেন্সর বোর্ডের উন্নয়নেও রাজ্জাক অবদান রেখেছেন। মান্ধাতা আমলের আইন দ্বারা সেন্সর বোর্ড পরিচালিত হতো, তা কিছুটা হাল নাগাদ ও পরিমার্জনা করার জন্য ২০১০ সালে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন রাজ্জাক। তিনি কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন।
রাজ্জাক জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত মনোনীত হয়েছিলেন ২০০১ সালে। এই সূত্রে তিনি অনন্য আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি অর্জন করেন। দেশের নানা জায়গায় তখন তিনি ছুটে গেছেন জাতিসংঘের দূত হিসেবে। এই বিষয়টি চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য এফডিসির শিল্পী সমিতির সামনে রাজ্জাকের নামে নামফলক স্থাপন করা হয়—বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের পক্ষে।
রাজনীতির সঙ্গে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না রাজ্জাক। তিনি যখন বাড়িতে পার্টি দিতেন, সেখানে মন্ত্রীরা আসত, সচিবরা আসত। তারা তাকে রাজনীতিতে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করত। একদা তাকে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অফার দেওয়া হয়েছিল; মেয়র করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্জাক কিছুতেই রাজি হন নি। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: ‘আমার জগৎ, ধ্যানজ্ঞান—সবই ছিল চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়কে কেন্দ্র করে। অভিনয়টাই ছিল রক্তের ভেতর। হ্যাঁ, হয়তো রাজনীতি করতে পারতাম, এমপি-মিনিস্টার হতে পারতাম। কিন্তু এটা তো আমার স্বপ্ন বা পেশা নয়। আমি স্বপ্ন দেখেছি নায়ক হব, ভালো অভিনেতা হব। কিন্তু নিজের অন্তরে যা বসাতে পারব না, সেটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করব কেন ? আমার পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমি কেন রাজনীতি করব ?’
রাজ্জাক চলচ্চিত্রে কয়েকজন নতুন মুখ উপহার দিয়েছেন। নিজের মেয়ে ময়নাকে তিনি অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছেন। পাগলা রাজা, জোকার এবং মৌচোর ছবিতে। কিন্তু ময়না চলচ্চিত্রে থিতু হতে চায় নি। পরে নায়িকা হিসেবে কাজরীকে ব্রেক দেন ‘জোকার’ ছবিতে। কাজরী নামটিও তার দেওয়া। পরে ‘সৎভাই’ ছবিতে আলীরাজকে ব্রেক দেন। আলীরাজ নামটিও রাজ্জাক প্রদত্ত।...১৯৮৬ সালে ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ ছবিতে নিজের ছেলে বাপ্পাকে নায়ক হিসেবে সুযোগ দেন। বাপ্পার নতুন নাম হয় বাপ্পারাজ। ২০০৭ সালে ‘আমি বাঁচতে চাই’ ছবিটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন রাজ্জাক। এখানে নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় রাজ্জাকের ছোট ছেলে সম্রাটের।...কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলমের প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনেও রাজ্জাকের অবদান রয়েছে। ‘রংবাজ’ ছবিতে জসিমকে সুযোগ দিয়েছিলেন অ্যাকশন ডিরেক্টর ও অভিনেতা হিসেবে। পরবর্তী সময়ে জসিম শুধু অ্যাকশন ডিরেক্টরই নয়—নায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
রাজ্জাক একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। স্রষ্টার ওপর অটল বিশ্বাস ছিল তার। কয়েকবার হজ করেছেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন (প্রথমবার হজ করে আসার পরে তিনি ধর্মের দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়েছিলেন)। তার গুলশানের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আজাদ মসজিদ। এই মসজিদটির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এর সঙ্গে রাজ্জাকের সম্পর্ক ছিল। এই মসজিদের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে রাজ্জাকের সেজদার স্পর্শ পড়ে নি (শেষদিকে অবশ্য তিনি বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন)। ফজর নামাজের সময় তিনি কোনো কোনো দিন ইমাম আসার আগে মসজিদে চলে আসতেন।
রাজ্জাকের মৃত্যুর আগেই কয়েকবার গুজব রটে যে তিনি মারা গেছেন। একথা শুনে সংগত কারণেই তিনি ব্যথিত হয়েছেন। বলেছেন, ‘এরকম সংবাদ রটানো ঠিক নয়। আল্লাহ যেদিন চাইবেন সেদিনই আমি চলে যাব। আমি প্রস্তুত হয়েই আছি।’ হ্যাঁ, প্রস্তুত রাজ্জাক স্রষ্টার ডাকে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। কয়েকবার অত্যন্ত গুরুতর অবস্থায় রাজ্জাক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না। সেদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজ্জাক মারা যান।
আবদুর রাজ্জাক নামক মানুষটির মৃত্যু ঘটেছে। নায়করাজ রাজ্জাক কিন্তু বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন সেলুলয়েডে, বেঁচে আছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। বেঁচে আছেন অগণিত চলচ্চিত্র অনুরাগীর হৃদয়ে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.