[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধÑসব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]
১১) ঊর্মিলা দেবী (দাশ) (১৮৮৬-১৯৫৬) : ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে যে মুষ্টিমেয় নারী সমস্ত দেশ জুড়ে প্রবল আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন, ঊর্মিলা দেবী নিঃসন্দেহে তাদের নেতৃস্থানীয়া একজন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহোদরা এবং ‘নারী কর্ম মন্দির’ নামে এক নারী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চরকা ও খদ্দরকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে ঘাড়ে করে স্বদেশি কাপড়ের ব্যাগে খদ্দর ও মোটা সুতোর কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বেড়াতেন। সেইসঙ্গে মানুষকে বিলাতি খাদ্যদ্রব্য ও পোশাক পরিহার করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। এই অপরাধে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। তিনি সুলেখিকা ছিলেন। দেশবন্ধুর ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম ‘পুষ্পহার’ প্রকাশ করেন। ১৯৩০ সালে নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তাঁর সভানেত্রী হন। এই সময় আইন অমান্য করার অপরাধে তাঁর আবার কারাদণ্ড হয়।
১২) কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৪-২০০০) : বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। আদি নাম মোহর। কণিকা নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। কণিকার পিতার নাম সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম অনিলা দেবী। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা দুটোই শান্তিনিকেতনে। সেখানকার বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বামী। রবীন্দ্রনাথের কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তাঁর প্রথম দুটি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড, ‘ডাকবো না, ডাকবো না’ এবং ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে’। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়িকা কণিকা দেশে-বিদেশে বহু ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর অগুনতি অনুরাগী পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছেন। শুদ্ধ উচ্চারণে ও যথার্থ সুরে রবীন্দ্রসংগীতকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা তিনি করেছেন। জীবনে বহু বড় বড় পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তাঁর ভেতর, সংগীত-নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার, পদ্মশ্রী খেতাব, শিরোমনি পুরস্কার, আলাউদ্দীন পুরস্কার, রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য্য ও দেশিকোত্তম উপাধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেকের কছে সংগীতের তালিম নিলেও শৈলজানন্দ মজুমদার ছিলেন তাঁর প্রকৃত শিক্ষক। এছাড়া দ্বিজেন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শান্তি দেবঘোষ এবং রমা করের কাছেও গানের শিক্ষা লাভ করেন।
১৩) কবিতা সিংহ (১৯৩১-১৯৯৮) : মহাশ্বেতা দেবীকে উৎসর্গীকৃত এবং তার উদ্দেশেই রচিত কবিতায় (‘মহাশ্বেতা’, হরিণা বৈরী) কবিতা সিংহ মহাশ্বেতাকে তার সময়ের বহু আগে পৃথিবীতে এসেছেন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন :
তুমি কেন তিন শ’ বছর আগে
এই ভুল পৃথিবীতে এলে ?
অথচ তিনি নিজে যে সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলেন, সময়ের অনেক আগেই যে পৃথিবীতে এসেছিলেন কবিতা, সেটা হয়তো তিনিও ভালো করেই জানতেন। কবিতা সিংহকে সম্প্রতি নতুন করে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রমিতী ভৌমিক কালি ও কলমে (নভেম্বর ২০১৫) লিখেছেন, “তাঁর চিন্তা-ভাবনা, সাহিত্য রচনা—সবকিছুই সমসময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল। এক অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় ছিল তাঁর স্বরে। সমাজের এক পার্শ্বিকতাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি। কল্পনা করেছিলেন এক নতুন ভবিষ্যতের। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে ব্যক্তিসত্তার জাগরণ তিনি আকাক্সক্ষা করেছিলেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি জুড়ে চলতে থাকে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের পালা। বোধের জগতে, চেতনার জগতে তৈরি হয় এক টানাপড়েন; যেখানে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে নতুন করে, নতুনভাবে।”
‘মহিলা কবি’ হতে চান নি কবিতা, কবি হতে চেয়েছিলেন। তবু এটা সত্যি, কবিতা সিংহের হাত ধরেই বাংলা কবিতা প্রথম নারীবাদের ছোঁয়া পেয়েছিল। তিনি মূলত কবি হলেও শক্তিশালী গল্পকার ও ঔপন্যাসিকও বটে। একই সঙ্গে তিনি এই উপমহাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ নারী-সাংবাদিকতায়। গদ্যে এবং পদ্যে, সেই সঙ্গে জীবিকার অন্বেষণে কর্মজীবনে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে ও জীবন-বিশ্বাসে তিনি এই সমাজে নারীর দুরবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। পরবর্তীকালে নারী লেখকরা তাঁদের সাহিত্য রচনায় সমাজে মেয়েদের বঞ্চনা, অবহেলা, অসহায়তার প্রসঙ্গকে জোর গলায় এবং সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন কবিতা সিংহের উত্তরসূরি হিসেবেই। এ-প্রসঙ্গে নবনীতা দেব সেনের একটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে :
“কফি হাউসের দরজায় দীপশিখার মতো উজ্জ্বল এবং সহজ সুন্দরী কবিতা সিংহকে সেই প্রথম দেখা মুহূর্ত থেকেই যে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলুম সে চোখ কখনো বদলায় নি। অবাক হয়ে শুনেছিলুম, বিমল রায় চৌধুরীর স্ত্রীর নাম কবিতা সিংহ।” সেই পঞ্চাশের দশকে এমনটি হতো না। কিন্তু কবিতা সিংহ যে সকল দিক থেকেই একমেবাদ্বিতীয়ম্, বাংলা সাহিত্যে তাঁর কোনো তুলনা নেই। আজকের নারীবাদিনীদের চেয়ে অনেক ক্রোশ বেশি পথ হাঁটতে হয়েছিল তাঁকে। আর এগিয়ে ছিলেন যোজন-যোজন বেশি। জীবন তাঁর সরল ছিল না। না ঘরে, না কর্মক্ষেত্রে। হবে কী করে, কবিতা যে ছিলেন রণরঙ্গিনী!
“রণক্ষেত্রে দেখা হবে সম্মুখ সমরে তীব্র
ইস্পাতের অচিত্র-অঙ্গদে। অমনি তো শিখি নি
মাতা রমণীয় পশ্চাৎপসরণ।”
কবিতা সিংহের জন্ম কলকাতায় ভবানীপুরে, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। তাঁর থেকে মাত্র পনেরো বছরের বড়, তাঁর মা অন্নপূর্ণা সিংহ। মাকে দেখেই তাঁর কবিতা লেখা আর ছবি আঁকতে শেখা। ১৯৪৬ সালে পনেরো বছর বয়সে নেশন পত্রিকায় প্রথম কবিতা সিংহের কবিতা প্রকাশিত হয়। সেটি ‘সম্ভবত একটি ইংরেজি কবিতা।’ ষোলো বছর বয়সে আনন্দবাজার পত্রিকায় কবিতা সিংহ লেখেন ‘আর্ট ও নারী’। বিজ্ঞাপনে নারী শরীরের ব্যবহার নিয়ে তিনি লিখেছিলেন এই লেখাটি। এর বেশ কয়েক বছর পরে তেইশ থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত এক বিখ্যাত ইংরেজি চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক সিনে অ্যাডভান্সের মেয়েদের পাতা সম্পাদনা করতেন তিনি। তখন তাঁর কাজ ছিল উঠতি চিত্রতারকাদের গ্ল্যামারাস ফটোগ্রাফ সমেত প্রতি সপ্তাহে একটি করে চটকদার রচনা লেখা। তাঁর ‘পাপপুণ্য পেরিয়ে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। পরিবারের সকলের অমতে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সহপাঠী বিমল রায় চৌধুরীকে বিয়ে করেন। বিমল পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও গল্প লিখতেন, কিন্তু অর্থাভাবে কবিতা বিভিন্ন রকম পেশা (খবরের কাগজ ও রেডিওতে সাংবাদিকতা, মাস্টারি, কেরানিগিরি) গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। কবিতা সিংহের সাহিত্যরচনার পেছনে স্বামীর বিশেষ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল। তাঁদের দুই কন্যা। কন্যার বর্তমান বাসস্থান বোস্টনেই। ১৯৯৮ সালে কবিতা সিংহের মৃত্যু হয়। বাংলার প্রথম দিকের নারী সাংবাদিক তিনি। খবরের কাগজের অফিসে দীর্ঘ দিন-রাত পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে করতে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় কত যে অসুবিধা হতো, তা আজ অফিসে বা কাগজে কাজ করা মেয়েরা কল্পনাও করতে পারবেন না। কিন্তু কবিতারা সেই নারী-অবান্ধব পরিবেশেই মুখ বুজে কাজ করে গেছেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্মে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
পাঁচের দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি কবিতা সিংহ। তাঁর কবিতার বিষয়, ভাষা, প্রকাশভঙ্গি একেবারে আলাদা, অন্য কারও মতো নয়। কবিতার বইয়ের সংখ্যা তিনটি। ১. সহজ সুন্দরী (১৯৬৫), ২. কবিতা পরমেশ্বরী (১৯৭৬), ৩. হরিণা বৈরী (১৯৮৩)। আর কবিতায় ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরী আছেন। কবিতা সৃষ্টিকে তিনি মেয়েদের গর্ভসঞ্চারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবিতা সিংহের কবিতায় নারী আপোস করে না সামাজিক প্রথার সঙ্গে। পুরুষ নারীর শরীরকে ভোগের সামগ্রী বলে ভেবে এসেছে যুগ-যুগ ধরে। আবার তাকে নিয়ে কাব্য, সাহিত্য, শিল্প রচনা করেছে সেই পুরুষই। কবিতা সিংহ তাই সেইসব পুরুষের কাছে জানতে চান :
তুমি কি জানবে কোন রসায়নে নারীর শরীর
দুধ জল চিরে যায়, পরমহংসীর শুদ্ধতায়!
তুমি কি জানবে নারী কীভাবে নিষ্ফলা প্রেম
রাখে তার ধমনীতে
লুকায় প্রসব ব্যথা বস্তির মায়াবী হাড়ে, ক্রমবিস্ফারিত ?
কবিতার মতো তাঁর গল্প ও উপন্যাসেরও মূল প্রেরণা সামাজিক অবিচার পর্যবেক্ষণ ও ক্রোধ এবং আপোষহীনতা। নারীর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, ওঠা-পড়া, ভালোবাসা, যৌন-আকাক্সক্ষা, প্রতিশোধস্পৃহা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সংযম—এই সবকিছু অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক কবিতা সিংহ। কবিতা সিংহের উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—সোনা রূপোর কাঠি (১৯৬২), পাপ পুণ্য পেরিয়ে (১৯৬৪), মরমা (১৯৬৭), খুনের সংখ্যা এক (১৯৭০), চারজন রাগী যুবতী (১৯৭৩), পতনের বিরুদ্ধে (১৯৭৮), নায়িকা প্রতিনায়িকা (১৯৭৯), বাঁচার জন্য নির্বাচিত (১৯৮৩), পৌরুষ (১৯৮৪), মোমের তাজমহল (১৯৮৯), রক্তাক্ত গম্বুজ (১৯৯৪) ইত্যাদি। কবিতা সিংহের গল্পগ্রন্থের সংখ্যা দুই। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এরপর ১৯৮৮-তে বেরোয় আরও একটি সংকলন ‘একদিন আশালতা’। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবিতা সিংহের পঞ্চাশটি গল্প (জানুয়ারি, ২০১৩), কবিতা সিংহের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (জানুয়ারি ২০১৩)। প্রমিতী ভৌমিকের মতে, ‘একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন তাঁকে, খুঁজে দেখা প্রয়োজন তাঁর সাহিত্য-ভুবনকে। তাঁর মতো প্রতিবাদী, প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত দুর্লভ।’
১৪) কমলা দাসগুপ্ত (১৯০৭-২০০০) : বাংলার সংগ্রামী দুঃসাহসী নারী যাঁরা ব্রিটিশদের সঙ্গে সরাসরি লড়েছেন স্বাধীনতার জন্য, কমলা দাসগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। ১৯০৭ সালে বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম। পিতা বিক্রমপুরের বিশিষ্ট সাংবাদিক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত। ১৯২৪ সালে ঢাকার ব্রাহ্ম শিক্ষালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। এর পর তাঁর পরিবার কলকাতা চলে যায়। সেখানে কমলা বেথুন কলেজে পড়াশোনা করেন। স্নাতকোত্তর পড়াকালে তিনি দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হন। ক্রমে ক্রমে তিনি দীনেশ মজুমদারের মতো বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী বিনয়, বাদল, দীনেশ তিনজন-ই বিক্রমপুরের। কমলা যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে ডালহৌসী বোমা মামলায় এবং ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা করার জন্যে বিপ্লবী বীণা দাসকে অস্ত্র সরবরাহ করার সন্দেহে কমলাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৩ ও ১৯৩৬ সালে তাঁকে দুইবার কারাবরণ করতে হয়। অবশেষে ১৯৩৮ সালে তিনি গান্ধীবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং নানারকম সমাজ গঠনের কার্যাবলীতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী’ ও ‘রক্তের অক্ষরে’ গ্রন্থ দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘মন্দিরা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও সম্পাদন করেছেন কয়েক বছর। ১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেন। ‘রক্তের অক্ষরে’ কমলা দাসগুপ্তের আত্মজীবনী আর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী’ তাঁর বিপ্লবী জীবনের সঙ্গীদের কথা।
১৫) কমলা ঝরিয়া (১৯০৬-১৯৭৯) : কমলা ঝরিয়া জন্মেছিলেন বাংলার বাইরে। বিহারের কয়লাখনির অঞ্চল ঝরিয়ায়। আগে বিহার রাজ্যের মধ্যে থাকলেও এখন ঝরিয়া ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত। ধানবাদ জেলার একটি মহকুমা। ১৯০৬ সালে জন্ম কমলার। তাদের পারিবারিক পদবি ‘সিং’। পিতা ঠিকাদারি ব্যবসাদার। রাজবাড়ির খুব কাছেই থাকতেন কমলারা। ঝরিয়ার রাজারাও ‘সিং’ পদবিধারী—দূর-আত্মীয়তার একটি সম্পর্কও নাকি ছিল। এই কারণেই রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁদের এত সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। অবশ্য তাঁর পারিবারিক পরিচয় সম্পর্কে ভিন্ন কথাও শোনা যায়। কথিত আছে কমলার মা ও মাসি প্রকৃতপক্ষে বারবনিতা ছিলেন। তাঁরাও গান করতেন, আর সেকালে সংগীত পেশায় নিয়োজিত মেয়েরা প্রায়ই চিরাচরিত গৃহবধূ ছিলেন না।
ঝরিয়ার রাজা গানবাজনার অনুরাগী ছিলেন। তাঁর দরবারে গানের কদর ছিল। সেকালের নামি শিল্পী কে. মল্লিক অনেক বছর ঝরিয়ার রাজার সভা-গায়ক ছিলেন। এই কে. মল্লিকই কমলা ঝরিয়ার প্রথম গানের গুরু। তাঁর হাতেই কমলার গানের ভিত রচিত হয়। এরপর তিনি ঝরিয়ার রাজদরবারের আরেক সংগীত গুণী শ্রীনাথ দাস নন্দীর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখতে শুরু করেন। গানের প্রতি কমলার নিষ্ঠা ও অনুরাগ দেখে এবং তাঁর সংগীত-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তা আরও বিকশিত করার লক্ষ্যে কে. মল্লিক তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেতার ও গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কমলার জীবনের মোড় ঘুরে যায় এই ঘটনায়। তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন হিজ মাস্টার্স ভয়েসে। প্রণব রায়ের লেখা ও তুলসী লাহিড়ীর সুরে ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না’ ও ‘নিঠুর নয়ন-বাণ কেন হানো’ এই গান দুটি নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় সেপ্টেম্বর ১৯৩০-এ। কলের গানের ভুবনে তাঁর আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। যাকে বলে শুরুতেই একেবারে গানের বাজার মাত করে দেন কমলা।
গ্রামোফোন রেকর্ডে তাঁর নামের পদবি নিয়ে মজার এক গল্প চালু আছে। শোনা যায় : প্রথম রেকর্ড প্রকাশের সময় কর্তৃপক্ষ তাঁর পদবি জানতেন না। তাই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত কাজী নজরুল ইসলাম, তুলসী লাহিড়ী এবং ধীরেন দাসের সিদ্ধান্ত অনুসারে রেকর্ডের লেবেলে তাঁর নামের পাশে পদবিস্থলে বাসস্থানের নাম (ঝরিয়া) যুক্ত করে দেন। সেই থেকেই তিনি ‘মিস্ কমলা ঝরিয়া’ (দেশ, ৫ জানুয়ারি ১৯৮০)। গল্পটির সত্যতা যাচাই করা হয় নি।
কমলা ঝরিয়ার গানের জীবনে বেশ কয়েকজন গুণী সংগীতজ্ঞের বড় ভূমিকা আছে। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে নাম করতে হয় কে. মল্লিক, ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম ও তুলসী লাহিড়ীর। ঝরিয়ার রাজদরবারের সভা-গায়ক শ্রীনাথ দাসনন্দীর কাছে কমলার উচ্চাঙ্গসংগীতে যে হাতেখড়ি, তা পূর্ণতা পায় ওস্তাদ উজির খাঁ ও ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁর কল্যাণে। নজরুলের সান্নিধ্য ও শিক্ষাও কমলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেসব কথা তিনি কখনো-সখনো স্বীকারও করেছেন। আব্বাস উদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, “কাজিদা তখন গ্রামোফোন কোম্পানীর জন্য গান লিখে চলেছেন। আঙুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতি, কানন দেবী, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন দাস, কমল দাশগুপ্ত, মৃণালকান্তি ঘোষ সবাই তাঁর গানের জন্য ‘কিউ’ লাগিয়ে বসে থাকে” (‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’; পৃ. ৪৯)। আঙুরবালাও উল্লেখ করেছেন, ‘ওনার [নজরুল] রচিত ও সুরারোপিত গান উনি নিজেই শেখাতেন। পরিচয়ের পর আমি নিয়মিত ওনার কাছে শিখতে লাগলাম। আমাদের সঙ্গে ইন্দুবালা ও কমলা ঝরিয়াও শিখত। প্রত্যেকের জন্যে পৃথক সময় নির্দিষ্ট ছিল’।
ঝরিয়া থেকে কলকাতায় আসার দু-এক বছরের মধ্যেই কমলার জীবনে আসেন তুলসী লাহিড়ী। তিনি হয়ে ওঠেন কমলার অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক। এর ফল শুভই হয়েছিল কমলার জন্যে। বেতার, গ্রামোফোন, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে তিনি যে যুক্ত হতে পেরেছিলেন তার মূলেও ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। তুলসীর সঙ্গে কমলার পরিচয় ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতার এমন একপর্যায়ে পৌঁছায় যে তুলসী লাহিড়ী দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তিলতা এবং চার পুত্র ও দুই কন্যাকে ছেড়ে কমলার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তুলসী লাহিড়ী ও কমলা ঝরিয়া সমাজ-সম্পর্কের বাইরে এক ‘কীর্তিময় শিল্পের সংসার’ গড়ে তুলেছিলেন। তিরিশের যুগের প্রায় গোড়া থেকেই যে সম্পর্কের সূচনা তা তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত (১৯৫৯) অবিচ্ছিন্ন ছিল। পরস্পরের প্রতি তাঁদের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা। কমলা ঝরিয়ার রাসবিহারী এভিনিউয়ের বাড়িতেই তুলসী লাহিড়ী মারা যান। দীর্ঘকালের সঙ্গী ও অভিভাবককে হারিয়ে কমলা শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। গানের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে শেষ বড় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন যখন গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘গোল্ডেন ডিস্ক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
সারা জীবন ধরে কমলা বিচিত্র ধরনের গান গেয়েছেন। বাংলা ঠুমরি গানে তাঁর কণ্ঠ ছিল সাবলীল, রাগাশ্রিত। বাংলা গানেও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। গজল, ঢপকীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, নজরুলসংগীত সবক্ষেত্রেই তাঁর কণ্ঠ ছিল অনবদ্য। বাংলা গানের বহু শাখায় বিচরণ করেও শেষ পর্যন্ত কমলা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গীতাঞ্জলি নিবেদন করেছেন শ্রীকৃষ্ণের পদতলে। পদাবলি কীর্তনেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক।
আবুল হোসেন চৌধুরীর মতে, কমলা তারিফ পেয়েছেন বাঙালি সংগীত রসিক শ্রোতার। বাংলা মুলুকের বাইরেও কিন্তু কোনো রাষ্ট্রীয় খেতাব পুরস্কার তাঁর ভাগ্যে জোটে নি। অবশ্য এসব নিয়ে তাঁর কোনো খেদ তেমন ছিল না। অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি শান্ত ও শালীন আচরণে সকলকেই মুগ্ধ করেছেন। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ছিল প্রচুর কিন্তু তিনি আত্মসচেতন ছিলেন না।
১৬) করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-১৯২২) : রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম। বেগম রোকেয়ার সহোদরা করিমুন্নেসা খানম একজন কবি ও সমাজসেবী হিসেবে তৎকালীন সমাজে পরিচিত ছিলেন। উর্দুভাষী পরিবারে লালিত-পালিত হলেও নিজের চেষ্টায় বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন করেন। শিক্ষানুরাগী ও সাহিত্যমনা করিমুন্নেসার পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থানুকূল্যেই প্রকাশিত হতো আব্দুল হামিদ খান ইউসুফজায়ী সম্পাদিত ‘আহমদী’ (১৯২৩)। তাঁর স্বামী ছিলেন টাঙ্গাইলের জমিদার। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’র (১৮৮৫) প্রথম সংস্করণটি করিমুন্নেসা খানমের নামে উৎসর্গ করেন। বেগম রোকেয়াও তাঁর ‘মতিচূর’ (১৯২১) গ্রন্থখানি তাঁকে উৎসর্গ করেন। বেগম রোকেয়ার প্রবন্ধে জানা যায় যে, করিমুন্নেসা কবিতা লিখতেন। ‘দুঃখতরঙ্গিনী’ ও ‘মানস বিকাশ’ নামে দু’খানি গ্রন্থ রচনা করেন। আব্দুল হালিম গজনবী ও আব্দুল করিম গজনবী হলেন তার দুই সুযোগ্য পুত্র।
বড় ছেলে আবদুল করিম আবু আহমদ গজনবী বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। ছোট ছেলে আবদুল হালিম হুসাইন খান গজনবী বিশ বছর ধরে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন।
ছোটবেলায় করিমুন্নেসা ভাইদের বাংলা পড়া শুনে বাংলা শেখেন এবং রোকেয়াকে পড়াশোনা করায় উৎসাহিত করেন। করিমুন্নেসা রচিত একটি নারীবাদী কবিতার অংশবিশেষ :
“ধনী কি দরিদ্র কিবা মধ্যবর্তীগণ
পুরুষ নয়গো কভু বিশ্বাসভাজন
ভুলো না ভুলো না বোন এদের কথায়
নিজ স্বার্থ হেতু জারজ অবলা মজায়।”
১৭) কল্পনা দত্ত (১৯১৩) : চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল কল্পনা দত্তের। তাঁর পরিবার ইংরেজ সরকারের অনুগৃহীত হলেও কৈশোর থেকেই কল্পনার স্বদেশ সেবার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। প্রীতিলতার অন্যতম সাথি ছিলেন কল্পনা দত্ত। তারা দুজনেই একইসঙ্গে ঢাকায় পড়তে এসে দীপালী সংঘে যুক্ত হয়ে লাঠি ও তলোয়ার চালানো শিখেছিলেন। চট্টগ্রাম দলের পূর্ণ সভ্যা কল্পনা মাস্টারদার প্রতিটি দুর্জয় পরিকল্পনায় অংশ নেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় ১৯৩৩ সালে কল্পনা দত্ত বন্দি হলেন। জেলে বসেই মাস্টারদার ফাঁসির খবর জানতে পেলেন। ছয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গান্ধীজির জোর প্রচেষ্টায় ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান এবং পরবর্তীকালে আত্মরক্ষা সমিতিতে যোগ দিয়ে মেয়েদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সৈন্যদের দ্বারা মেয়েদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় কাহারপাড়া বলে পুরো একটি গ্রামকে সৈন্যরা পুড়িয়ে দেয়। কল্পনা দত্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে এর প্রতিবাদে বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৮) কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-’৮৪) : জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বৌঠান’। রবীন্দ্র-মানস গঠনে এই অসামান্য নারীর অবদান স্মরণীয়। অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের কবি হয়ে ওঠার মূলে ছিল কাদম্বরীর প্রেরণা। কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারণ সাহিত্যপ্রেমিক ও সাহিত্যরসিক ছিলেন। ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনা ও মুদ্রণের ব্যাপারে তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং কাগজটির উন্নতির জন্যে তিনি সবসময় ভাবতেন। কিন্তু ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপার হরফে তাঁর নাম ছিল না। তবু সত্য এটাই যে তিনিই ছিলেন ওই পত্রিকার প্রাণ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন। কাদম্বরী প্রতিদিন স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে যেতেন। কাদম্বরী একদিকে যেমন গৃহস্থালি কাজকর্ম—যেমন সুপুরি কাটা, তরকারি কাটা, বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতেন, তেমনি তিনতলার ছাদে নন্দনকানন গড়ে তুলেছিলেন কাদম্বরী, যেখানে বসত নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা। সেই সাহিত্য আড্ডায় একেক সময় একেকজন এলেও রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী নিয়মিত সদস্য ছিলেন। সাহিত্যচর্চা করা ছাড়াও তিনি গানের খুব ভক্ত ছিলেন। সেই ঊনবিংশ শতকের সত্তরের-আশির দশকে যখন সবে বিনোদিনী, এলোকেশী, গোলাপসুন্দরীরা গণিকালয় থেকে উঠে এসে প্রথমবারের মতো পেশাদার অভিনেত্রী হিসেবে মঞ্চে নারী চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেছেন, তার আগে থেকেই এই ঠাকুর বাড়িতে পুরুষ ও নারী একসঙ্গে একই মঞ্চে নাটক করেছেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়মিত এই যে নাটক মঞ্চায়ন হতো, তাতে প্রধান নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে কাদম্বরী খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি অনুশীলন করেছিলেন সঙ্গীতচর্চার।
রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাস পরেই কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। আগেও তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর আত্মহত্যার কারণ সঠিকভাবে জানা যায় নি। ধারণা করা হয়, নিঃসন্তান স্ত্রীর সঙ্গহীন শূন্যতা ভরিয়ে তোলার জন্যে স্বামীর যতটা মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ততটা ছিলেন না। খ্যাতিমান নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নতুন সৃষ্টির আনন্দে বিভোর থাকতেন। খেয়ালি ও আড্ডাবাজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হঠাৎ একরাতে হয়তো আড্ডাতেই সারারাত কাটিয়ে দিতেন। আরও শোনা যায়, রঙ্গমঞ্চের কোনো বিখ্যাত অভিনেত্রীর প্রতি তিনি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সেই অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গ চিঠিপত্র কাদম্বরীর হাতে এলে অভিমানী কাদম্বরী ব্যথিত হন। অপরদিকে একান্নবর্তী বৃহৎ সংসারে বন্ধ্যা নারী কাদম্বরী, যাঁর বাপের বাড়ির অবস্থাও অন্য বউদের তুলনায় ছিল সাধারণ, ছিলেন একরকম উপেক্ষিতা ও করুণার পাত্রী। সব মিলিয়ে মনে করা হয় কাদম্বরী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরীর পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে একটি সন্দেহ অনেকের মনেই বিঁধেছিল রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কাদম্বরীর আত্মহননকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠমহল থেকে যতদূর জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে তাদের সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধার এবং স্নেহের। কিছুটা বন্ধুতার। রবীন্দ্রনাথের দিদি শরৎকুমারীর ভাষায় কাদম্বরী ছিলেন ‘ফুলের তোড়ার বাঁধন’। ১৮৮৪ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে সেই বাঁধন ছিঁড়ে ফেললেন কাদম্বরী নিজেই। তবে রবীন্দ্র মানস-গঠনে, তাঁর সৃজনশীলতার উন্মেষে কাদম্বিনীর সাহচর্য ও স্নেহ নিঃসন্দেহে এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নতুন বৌঠানের কথা কোনোদিন ভুলতে পারেন নি। ঘুরে ফিরে তিনি এসেছেন তাঁর সাহিত্যের সকল আঙিনাতেই।
১৯) কাদম্বিনী বসু (গঙ্গোপাধ্যায়) (১৮৬১-১৯২৩) : প্রথম নারী, যিনি ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৮৮০ সালে তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু প্রথম দুই নারী ঋ.অ. পরীক্ষায় পাস করেন। তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮২ সালে ভারতীয় নারীদের মধ্যে (ব্রিটিশ অধিকৃত সকল দেশের মধ্যেও) প্রথম বি.এ. পাস করেন। কাদম্বিনী বসুই ১৮৮৪ সালে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এম.এ. পাস করেন। ১৮৮৭ সালে প্রথম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রাকটিস করার বিশেষ সার্টিফিকেট পান। সেই হিসেবে তিনি বাংলার প্রথম এম.ডি. না হলেও প্রথম ডাক্তার। ভারত উপমহাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম (১৮৯৬ সালে) নারী যিনি বিদেশ থেকে মেডিকেল ডিগ্রি (এডিনবরা থেকে LRCP, LRCS, LFPS ডিগ্রি) অর্জন করেন। কাদম্বিনী জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্যদের অন্যতমা। ১৮৮৯ সালে বোম্বাই কংগ্রেসে প্রথম দুই নারী প্রতিনিধি দলের অন্যতমা সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের কোনো অধিবেশনে প্রথম নারী বক্তা। ১৮৯০ সালে কলকাতার অধিবেশনে তাঁর ইংরেজি ভাষণ ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। রাজনীতি ও নারী আন্দোলনের নেত্রী অ্যানি বেসান্তের মতে, ‘The first woman who spoke from the Congress platform, is a symbol that IndiaÕs freedom would uplift IndiaÕs womanhood.Õ
বাংলার প্রথম চারজন নারী ডাক্তারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্র্যাকটিস করেছেন প্রথম ডাক্তার কাদম্বিনী। তাঁর জীবনের সাধ ছিল নিজের টাকায় যেন নিজে চলতে পারেন। শারীরিক বা অর্থনৈতিকভাবে কারও ওপর যেন ভরসা করতে না হয়। ঘটেছেও তাই। জীবনের শেষ দিনটাতেও তিনি রোগীর বাড়ি গেছেন। একটি জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন। ঘরে এসে পরিতৃপ্ত কাদম্বিনী পুত্রবধূকে বলেছেন, একটা সার্থক ও সুন্দর দিন ছিল সেটা। এত ভালো লাগছিল তার তিনি শূন্যে উড়ে বেড়াতে চাইছিলেন। আর কী আশ্চর্য, এর পরেই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা কাদম্বিনী সবসময় বলতেন কারও, এমন কি নিজ পুত্রেরও গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। কর্মাবস্থায় তাই মরতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হাতব্যাগে কড়কড়ে পঞ্চাশটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল—সেদিনকার রোজগার।
২০) কানন দেবী (১৯১৫-১৯৯২) : বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক। বিখ্যাত ছায়াছবি পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যসহ প্রচুর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজ মেধা ও পরিশ্রমের জোরে এমন জায়গায় উঠে আসতে পেরেছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ প্রথম অভিনয় করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই ছবির জন্য তিনি পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পান। এরপর ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে বিভিন্ন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। তখন, চলচ্চিত্রে ঢোকার দুই দশক পরে অশোক কুমারের বিপরীতে ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে অভিনয় করে তখনকার দিনের জন্যে অকল্পনীয় অঙ্কের অর্থ পান পারিশ্রমিক হিসেবে। আর সেটা হলো এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেই সময়ে এই টাকার মূল্য অনেক। শুধু অভিনয়ে নয়, সংগীতেও অপূর্ব কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর অনেক ছবিতে তিনি নিজেই গান গেয়েছেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় হাত দেন। শ্রীমতি পিকচার্স তাঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম। শ্রীমতি শরৎচন্দ্রের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের চিত্ররূপ দিয়েছে। রবীন্দ্রসংগীত তিনি শেখেন অনাদি দস্তীদার, ভীষ্মনাথ চট্টোপাধ্যায় ও পঙ্কজ মল্লিকের কাছে। নজরুলগীতির জন্যে প্রশিক্ষণ নেন ধীরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাছে, আর ধ্রুপদি সংগীতের তালিম নেন আল্লারাখার কাছে। হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি ও মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি তাঁর অনেক গান রেকর্ড করেন, যার বেশিরভাগই খুব জনপ্রিয় হয়। সুন্দরী গায়িকা তরুণী কানন পুরুষ শাসিত অভিনয় জগতে এসে বহু সহ-অভিনেতা, পরিচালক ও কুশলীদের দ্বারা যৌন-নির্যাতিত হন। সেসব কথা বলতে গিয়ে কষ্টে, গ্লানিতে, ক্ষোভে ফেটে পড়েন। মঞ্চে বা সিনেমায় অভিনয় করতে আসা প্রায় সকল মেয়েদের পারিবারিক পরিচয়, তাদের সামাজিক অবস্থান এবং অর্থের প্রয়োজনীয়তা কাননবালার মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীকেও চরম অসহায় ও উপায়হীন করে তোলে, বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রামকালে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.