আপন দর্পণে আপন ছায়া

আপন দর্পণে আপন ছায়া

[গত ১ মে ছিল স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সাহিত্যিক প্রয়াত সরদার ফজলুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে এই রচনাটি পত্রস্থ হলো।]

 

সরদার ফজলুল করিম। একালের সক্রেটিস হিসেবে সুশীল সমাজের কাছে পরিচিত। বেটে-খাটো এই লোকটি বিভাগোত্তর এই জনপদের এবং বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। মহান দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব সরদার ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালে বরিশালের এক গহিন গ্রামে। তারপরে তাঁর ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ঘটনাই ইতিহাসের হিরন্ময় অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে একদা পাকিস্তান পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন। জেল খেটেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। আবার পার্টির সিদ্ধান্তে সেই চাকরি ছেড়েও দিয়েছেন। আবার চাকরি নিয়েছেন। জেলে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এক সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙেছিল। তারপর নিজের সাধ্যানুযায়ী চলাফেরা করেন একা। সাহায্য-অনুকম্পা না। কোনোমতেই না। বিশ্বাসের বাইরে এক পা ফেলতেন না। বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রজ্ঞাবান দার্শনিককে বার্ধক্য কখনো ছুঁতে পারে নি। যখন-তখন স্রোতের বিরুদ্ধে তিনি একাই হয়ে দাঁড়িয়েছেন এক’শ। একদা প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম নিজের জবানিতে বয়ান করেছিলেন ফেলে আসা অতীত দিনের কথা, তাঁর বিশ্বাসের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন—দীপংকর গৌতম।

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, যে জীবনটা আপনি পার করে দিলেন—এ জীবনটা কেমন লাগল ? ১৯২৫ সাল থেকে আজকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তখন আমি বলব, আমি জীবিত নই, আমি তো মৃত, আমি তো মরহুম। যেমন, আমাকে ফোনে একজন খোঁজ করে, আমি তার পরিচয়টা জানতে চাই—তখন তিনি বলেন, আমি প্রফেসর অমুক বলছি। এই যে নিজেকে নিজেই প্রফেসর বলে পরিচয় দেওয়া, এটা ঠিক না। ‘প্রফেসর’ শব্দটা সম্মানিত একটি শব্দ। এই পেশায় যিনি নিয়োজিত আছেন, তাকে অন্যে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় এটা ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু নিজেই যখন নিজের এই পরিচয়টা সামনে নিয়ে আসে, অর্থাৎ যে নিজের সম্পর্কে এটা বলে—সে আর অত সম্মানিত থাকে না। এই বোধটা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে নাই। বরং একজন পরিচয় দিয়ে বলে, আমি মিস্টার অমুক বলছি। সম্মান এখানে কেউ কাউকে আরোপ করে না, নিজেই নিজের ওপর আরোপ করে। অথচ, এটা বলা কি যায়—আমি সম্মানিত অমুক বলছি!

আমি বলেছি আমি মৃত। কেন বলেছি ? কারণ, জীবিত মানুষ তো পরিবেশকে বদলায়, পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সেই পরিবেশে নিজে একটি পরিবর্তনসূচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি, যদি আমরা চারদিকে তাকাই সেখানে দেখি, আমি এক অসম্ভব ফ্রাংকেনস্টাইন। ফ্রাংকেনস্টাইন শব্দটি নেতিবাচক হলেও এটা ব্যবহারের মধ্যে একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। অর্থাৎ যাকে তৈরি করল—সে-ই আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই নাই। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই আর কি ? আমার জীবনের কথা বলি। ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করলাম। আমার বাবা কৃষক ছিলেন। সাধারণ একজন চাষি। ছোটবেলার কথা বলি। আমার বরিশালের কথা। ছোটবেলায় খেতে বসলে মা ভাত দিল, সঙ্গে পোড়ামরিচ, আর কিছু নাই। আমি বলি, এইডা আমি খামু কী হইরা ? মা বলেন, আমি মাখাইয়া দেই, দেখ কী মজা লাগে! ভালোবাসা। তখন উজিরপুরে আমরা। সেখান থেকেই তো এই আমি। আমার যাত্রা।

এখান থেকে একটা বিকাশের ব্যাপার যে, কীভাবে এই মুসলিম সমাজের মধ্যে একটু-একটু করে ইংরেজি শিক্ষা প্রবেশ করতে লাগল। বলতে পারি, আমার বড়ভাইকে, আমাকে বাবা সেই এলাকার একজন কৃষক হয়েও প্রথম তার ছেলেকে মাদ্রাসায় না দিয়ে, হালচাষে না পাঠিয়ে, স্কুলে পাঠালেন। সেই কথা, স্কুলের কথা সেই ‘সেকাল’-এ লিখেছি। ‘চল্লিশের দশকে ঢাকায়’ও লিখেছি। ‘রুমীর আম্মা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’-এ এসবের কিছু পাওয়া যাবে।

আমার ভাই ১৯০৫-এ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৯-এ ঢাকায় পড়তে আসেন। তারপর তিনি আমাদের হাতে-হাতে মানুষ করে তোলেন। এভাবে ক্রমে একটা মুসলিম পরিবার, প্রথমে গরিব মধ্যবিত্ত, পরে একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠে। তথা ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠে। আমি ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা আসলাম। তখনো মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম রাজনীতি একমাত্র রাজনীতি না। তখন একটু হলেও অমুসলিম রাজনীতি মুসলমানদের মধ্যে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। যেমন, ক্লাসমেট মোজাম্মেল হক তখন জঝচ করে। রেভ্যুলেশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি, এ ব্যাপারে নির্মল সেন ভালো জানেন।

বরিশালে ছিলাম, লেখাপড়াও করেছি। কলকাতা গেলে অনেকেই আমার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কথা বলেন, জানতে চান দেখা হয়েছিল কি-না ? কিন্তু জীবনানন্দকে নিয়ে এখন যে উচ্ছ্বাস, সেটা তো তখন ছিল না। তখন তিনি জীবনানন্দ দাশ হন নি। আমি পেয়েছি শরৎসাহিত্যকে। ক্লাস এইট-নাইনেই শরৎচন্দ্রের সমস্ত বই প্রায় পড়া হয়ে যায়। তখন একেকটা খণ্ডের দাম ছিল ৮ আনা। জীবনটা আমার তখন শারদীয় ব্যাপার ছিল না, কোনো আমোদপ্রমোদ ভরা কাশফুল দোলখাওয়া বিকেল উপভোগের সময় ছিল না। যা কিছু সাহিত্যের স্পর্শ, তখন শরৎচন্দ্রের কাছ থেকেই পেয়েছি। ‘পথের দাবী’ পড়িয়েছিলেন মোজাম্মেল হক, বইটা পরে নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রায় লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল—যাতে কেউ না দেখে। তারপর ঢাকা কলেজে এলাম। যেটা এখন কার্জন হলের উল্টোদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতো দেখতে, তখন সেটা ছিল ঢাকা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। সেখানে দু’বছর পড়ি—১৯৪১ ও ১৯৪২। ১৯৪২-এ আমি আইএ পাস করি।

আমি ছিলাম লাস্ট বেঞ্চের ছেলে। ব্যাপারটা সেই ‘সেকালে’র মধ্যে লিখেছি। তার কারণ, আমাকে ভালোবাসত লাস্ট বেঞ্চের ছেলেরা এবং জোর করে সামনের বেঞ্চ থেকে আমাকে টেনে পেছনের বেঞ্চে নিয়ে যেত। বলত, সামনের বেঞ্চ তোর জন্য না। লাস্ট বেঞ্চ তোর। তুই আমাদের পড়াবি।

তখন ঢাকা শহরে শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো মুসলমান ছেলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয় নি। তেমন ছিলই না—ভালো রেজাল্ট করা তো আরও দূরের কথা। কিন্তু সেই আমলে আমি বোর্ড পরীক্ষায় সেকেন্ড হই—সেই ১৯৪২ সালে। প্রথম হয়েছিলেন যিনি তিনি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের অজিত দে। এইচ.এল.দে—হীরালাল দের ছেলে। সেটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

তো সেকেন্ড হলাম। তাতে আর কী হলো—অনেকেই তো হয়। এই ১৯৪২ থেকে মুসলিম লীগের ছেলেরা আমাদের মারতে আরম্ভ করে। কেননা, আমরা একটা কাউন্টার অবস্থান তৈরি করেছিলাম। আমরা জাতীয়তাবাদী; আমরা কেন মিছিলে গেলাম না—এসব কারণে। আমাদের খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া—ইত্যাদি ইত্যাদি করতে লাগল।

দুই

১৯৪২ সালের খোঁজ করলে দেখা যাবে, ঢাকাতে কেবল মুসলিম লীগের মূলস্রোত ছিল না, আরও একটা বিপরীতমুখী স্রোতও তৈরি হয়েছিল। আমার ভালো রেজাল্ট ছিল। কিন্তু আমি ভালো ছেলে বলেই ভালো রেজাল্ট করেছি—তা কিন্তু না। কবি সানাউল হক বলেছিলেন—সরদার তোমার কলমটা দেও, ওটা দিয়ে লিখলে আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যাব। আমার সামনে এখন নতুন প্রজন্ম—তাদের সামনে আমার সেই সময়টা ফুটিয়ে তোলা মুশকিল। যত বেশি ইতিহাসকে অতীত থেকে জানা যায়, তত এগুনো যায়; কিন্তু একটা কথাও আছে, বলা হয়—‘এভরি হিস্ট্রি ইজ কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি’। এভাবে ইতিহাসকে নির্মাণ করতে হয়। টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখতাম—সেখানে দুই যুবক একটা মেশিনে বাটন টিপে সাঁই করে ১৭৮৯-তে চলে যায়—যেটা ফরাসি বিপ্লবের কাল, সেখানে গিয়ে তারা কথা বলে, বিপ্লবীদের বলে—কামানটা এদিকে না ওদিক দিয়ে বসালে ভালোমতো কাজ হবে। এইভাবেই মানুষ ইতিহাসকে সমকালে নিয়ে বিচার করে।

আমি অনেককে জহরলাল নেহেরুর বইটা নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখি, তারা বইটার নামই জানে না। জহরলাল তো নিজেই একটা ইতিহাস, তার বইটা পৃথিবীর ইতিহাস। এরাই নির্মাতা। ইতিহাসের নির্মাতাকে এভাবে তৈরি হতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসের সাপেক্ষে তৈরি হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেই তো আর বিশ্ববোধ লাভ হয় না। আমবাগানে স্বাধীনতা হারানো থেকে আরেক আমবাগানে স্বাধীনতা ঘোষণা; তো আমবাগান-আমবাগান বললেই সব হয়ে যায় না। এখন অনেকখানে হাসপাতাল হয়েছে, কিন্তু সেখানে আগে নিশ্চয়ই অন্য কিছু ছিল—হাসপাতালটা কেবল হাসপাতাল না।

আমাদের এখানকার যে শিক্ষাপদ্ধতি বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি—দে ডু নট আন্ডারস্ট্যান্ড, দে ডু নট অ্যাপ্রিসিয়েট, দে ডু নট ওয়ান্ট টু অ্যাপ্রিসিয়েট—যে ঐতিহ্য যা তার কাছে—সেই মহৎ ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কেউ মহৎ হতে পারে না। আবার মহৎ ঐতিহ্য সৃষ্টি করার দায়ও আছে।

প্রফেসর রাজ্জাক আমাকে বলেছিলেন; তখন আমি এ কনফারেন্সে যাই তো অন্য কনফারেন্সে ডাকে—সেখানেও যাই; তিনি বলেন, সরদার এসব দিয়া দরকার নাই। ইফ ইয়ু ডু নট লার্ন ইয়োর হেরিটেজ—এভরি হিস্ট্রি ইজ কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি। আমরা ইতিহাসে বাস করছি—উই আর দ্য চাইল্ড অব হিস্ট্রি। ইতিহাস একদিনে শেখানো যায় না। কেউ যদি ইতিহাসের মধ্য দিয়ে না যায়, সে ইতিহাস শেখে না। তার চড়াই-উতরাই আছে। মানুষকে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ১৯১৭'র সেই দশ দিন কাঁপানো বিপ্লব—তার মধ্য দিয়ে কেউ যদি না যায়, তাহলে সেই ইতিহাস জানা হয় না।

বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কার কী ভূমিকা আছে, সেটা আলাদা ব্যাপার, হিন্দুরা মুসলমানদের মানুষ বলে গণ্য করল না যখন এই ঐতিহ্যবাহী একটা অঞ্চল তার জাতি ও ভাষা আছে, আছেন এমন সব প্রতিভাবান ব্যক্তি—তো এই যে একটা শক্তিশালী জাতি এরা—এটা ব্রিটিশ ইন্টিলিজেন্স এবং এই যে এশিয়াটিক সোসাইটি তারা পর্যন্ত বুঝতে পারছিল—এরা একটা নতুন শক্তি হিসেবে জাগতে যাচ্ছে। তারা ঠিক করল—এটাকে নতুন শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। এই জন্য ১৯০৫-এ যখন মুসলিম লীগ তৈরি হয়, পরে ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ হয়; তখনকার লাট, ছোটলাট বড়লাটের কাছে একটা চিঠি দেন, সেখানে উল্লেখ আছে যে—স্যার, আমরা এমন একটা জিনিস করলাম যার মাধ্যমে আমরা একটি শক্তিকে দ্বিধাবিভক্ত করে তাদের শক্তি হরণ করে নিলাম। এরা আর পরে ইউনাইটেড হতে পারবে না—এমন কাজ এখনোই আমরা করে ফেললাম।

এই যে আমেরিকার সিআইএ লাদেনকে তৈরি করল, ওরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙেছে, ওরা ভারতকে ভাগ করেছে। কিন্তু এখনকার নতুন প্রজন্ম ওই প্রকৃত কথাটা জানে না। একজনের কথা ছিল—হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো। যেখানে রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন রায়—এসব লোকেরা এসেছেন। তাঁরা নতুন শিক্ষার, পৃথিবীতে জীবনকে দেখার নতুন আলো নিয়ে এসেছেন। আমার একটা বই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’, সেখানে প্রফেসর রাজ্জাক বলেছেন—তোমরা রামমোহন রায়কে নিয়ে কী উল্টোপাল্টা চিল্লাচিল্লি করো। আরে তাঁর আসল কাজ যে, রাজা রামমোহন রায় একটা ব্যাকরণ লিখেছে। এই যে বিকাশটা, এটা আমরা অনুসরণ করি না। আমরা বাংলাভাষায় বিকাশটাতে পাকিস্তানে পৌঁছে যাই।

তিন

মানুষকে এখন অমানুষ বলছি। কিন্তু মানুষ তো একদিনে এই অবস্থায় আসে নাই। আবার একদিনে মানুষও হয়ে যায় নি। আমরা ক’জন মানুষ! এক রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথই। তিনি তো আর এক’শ রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেন না। তিনি ব্যতিক্রম। বিবেকানন্দ ব্যতিক্রম। আমি এ জন্য বলছি—এঁরা হলেন হাজার কোটি মানুষের ভেতরে ব্যতিক্রম মানুষ। এ জন্যেই তাঁরা ব্যতিক্রম যে, তাঁরা যা করতে চেয়েছেন—তা করতে পেরেছেন। ক’জন পারে এ কাজ ? এ অভিধায় আমি এঁদের দাঁড় করালাম না—মানুষ এঁদের দাঁড় করিয়েছে। মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিব থেকে হযরত মোহাম্মদ (সা.)—এঁরা সবাই ব্যতিক্রম। তো আমি যদি ব্যতিক্রম না হতে পারি, তবে দু’একজন ব্যতিক্রমে কী হবে, আমি যদি ব্যতিক্রম কিছু করতে পারি—একসময় এরকম ভাবতাম।

আমি তো বলি, বাংলাদেশের জন্ম ১৯৫২-তে। ঐতিহ্য ধারণ যাকে বলে, সেই ঐতিহ্যের সূচনাকাল ১৯৫২। হাসান হাফিজুর রহমান, যিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র সম্পাদনা করেছেন, সেখানে আছে—১৯৪৮ সালে যখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ভাষার অধিকারের প্রশ্ন তোলেন, লিয়াকত আলী তাঁকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু অ্যাসেম্বলির একটা মুসলমান মেম্বারও একটা কথা বলল না, তারা বলল না যে, না আমরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করি। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন—একজন কৃষক যদি তার ছেলের কাছে টাকা পাঠাতে চায়, তাহলে মনিঅর্ডারটা লেখা হবে কোন ভাষায় ? বলা হলো, সেটা উর্দুতেই লেখা হবে। অথবা ইংরেজিতে। লিয়াকত আলী এই কথাটা রীতিমতো ধমকের সুরে তাকে বললেন।

তো আমি এক স্থানে পরে লিখেছিলাম, আমার সেই ‘সেকাল’ বইটিতে—ঐতিহাসিকভাবে কেউ যদি কাউকে ভাষা সৈনিক বলতে চায়, তাহলে সেই ব্যক্তিটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু এই কথাটা সবখানে বলা হয় না। এই যে সবখানে একই কথা না বলা, যার যা প্রাপ্য তাকে না দেওয়া—এটাই এখন দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে যারা গৌণ, তাদের মুখ্য করে তোলা—বেশ কিছুদিন আগে—২০০২ সালের ফেব্র“য়ারির শেষ বা মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটা আলোচনা হলো, সেখানে একজন বললেন—আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই সরকারের কাছে। সেখানে আমি ছিলাম। আমি শুনেই চিৎকার করে বললাম—সরকারের কাছে নয়, জনতার কাছে চাই। জনগণ এনে গণআদালত তৈরি করুক এবং প্রকৃত যেটা ঘটছে, সেটা বের করে নিয়ে আসুক।

আর এখানে তো কোনো সিস্টেম দাঁড়ায় নি ‘না-মাড়ানোর’ সিস্টেম ছাড়া। আমি হাজারবার দেখেছি। একটা লোক—এই যে জ্যোতি বসু, মমতা ব্যানার্জী, তাঁরা ক্ষমতাবান হলো—ভিতটা কোথায় ? কিছু একটা মেনে তারপর তৈরি হয়। সেটা খুঁজে দেখতে হবে—ভিতটা কিসের ওপর দাঁড়িয়ে। মুসলমানরা তো পাকিস্তান মুর্দাবাদ বলে নাই। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার কোনো রেজ্যুলেশন নাই। জিন্না বললেন—উর্দু-উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখন নো-নো বলেছে অনেকে, কিন্তু কেউ তো তখনো বলে নি যে, আমরা পাকিস্তানি নই, আমরা বাঙালি। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, এত সহজে সব হয় না।

চার

আমাকে প্রশ্ন করা হয়, জীবন কেমন লাগছে ? যেখানে, আমি অন্য গ্রহ থেকে আগত একটা সরল জীব—যা দেখছি তাতেই অজ্ঞান হচ্ছি। এই যে লোকে কমিউনিস্ট পার্টির একজন বলে আমাকে মনে করে, কিন্তু আমি সব সময় বলে আসছি, আমি কমিউনিস্ট না। অথচ সবাই আমাকে তা-ই বলে। আমি বলেছি, আমি কমিউনিস্ট না। পার্টি করেছি, কিন্তু আগে তো কমিউনিস্ট হতে হবে—তারপর না কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু লোকে তো কমিউনিস্টই হয় না। আমিও হতে পারি নি। কমিউনিস্ট হতে হলে চর্চা লাগে, নিজের তাগিদ লাগে। দল তাকে কোনো একটা লক্ষ্যের দিকে নিয়ে চলে। কিন্তু আমি নিজেই তো কমিউনিস্ট হতে পারি নি। আমি রাজনীতি করি নি। আমি জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছি। মানুষ যেটাকে রাজনীতি বলে, আমি সেটা বলছি জীবন। একে আমি দেখার চেষ্টা করেছি। আমি ক্ষুদিরাম সম্পর্কে গান শুনেছি, ক্ষুদিরামকে আমি দেখি নি। এই যে গান শুনে অনুপ্রাণিত হওয়া, এটাই তো জীবনজিজ্ঞাসা। তাঁকে মরতে দেখি নি বলে তো সব শেষ হয় না। সোমেন চন্দ দাঙ্গার ভেতরে গান গাইছে—‘এই রক্তস্রোত কবে বন্ধ হবে।’ সোমেন চন্দ, ক্ষুদিরামেরা যদি না করত, যদি ইতিহাসে না আসত তাহলে আমি কী করে তাঁদের কথা বলতাম ? কাজেই কেউ যদি বলে, আমি রাজনীতি করেছি, আমি বলি—‘না’। জেলে বসেই আমি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলাম। এ কথা তোমরাও বললে কিন্তু আমি কোথায় নির্বাচিত! আমি তো নির্বাচিতই হই নাই। জেলে থেকে নির্বাচিত হওয়া—এটা কেমন নির্বাচন ? আমি তো বুঝলাম না আমি কীভাবে নির্বাচিত হলাম! আমি তো জেল থেকে পালিয়ে আবার জেলে ঢুকলাম। ন্যাপের মোজাফফর আহমদ এই প্রসঙ্গে ভালো বলতে পারবেন—সে অনেক কিছু জানে, সে বলুক কমিউনিস্ট-আন্দোলনের কথা, কিন্তু সে কথা বলতে চায় না। বুদ্ধিমান লোক। আমি যে কথা বলি, এই কথা-বলাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ না। সে-ই তো জেলের মধ্যে ঢুকে একটা কাগজ দিয়ে বলেছিল—‘সই করো।’ ‘কেন ?’ ‘কেন টেন না, আগে সই করো।’ ওরা অন্য কাউকে নিতে পারত। কিন্তু নিল আমার সই। আর যাই হোক, আমাকে সবাই খুব ভালোবাসত। আমি তো ভোটে ছিলাম না।

কিন্তু সেই পাকিস্তান থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত একটা খবর ছড়িয়ে পড়ল—‘ওয়ান কমিউনিস্ট ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল হ্যাজ বিন ইলেক্টেড টু দ্য কন্সটিটুস্যনাল অ্যাসেম্বলি ইন পাকিস্তান।’—কেমন করে হলো ? এটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। আমি তো ভোটে ছিলাম না। কিন্তু পার্টি মনে করেছিল আমাকে দিলে আমি জিতব এবং জিতলামও। এদিকে জবাবদিহি করতে হলো, ওয়াশিংটনের যে পাকিস্তানের অ্যাম্বাসি আছে, তাকে বলা হলো—এক্সপ্লেইন হাউ সরদার ফজলুল করিম কুড বি ইলেক্টেড টু দ্য ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি? ওরা আর কী করবে! আবু হোসেন সরকার তখন এখানকার চিফ মিনিস্টার, তখন অলরেডি যুক্তফ্রন্ট ভাঙা হয়ে গেছে। তখন ফজলুল হক একদিকে আর আবু হোসেন সরকার আরেকদিকে। করাচি থেকে শোকজ নোটিশ এল। এখানকার আবু হোসেন সরকারের অফিসারেরা বলেছিল, স্যার, আপনি বলে দেন যে, সরদার ফজলুল করিম পালিয়েছে। আমাদের কাছে ফজলুল করিম সরদার নামে একজন আছে। ওই ফজলুল করিম সরদার ছিল যশোর বা রাজশাহী জেলে। আর আমি সরদার ফজলুল করিম ছিলাম ঢাকা জেলে। প্রায় সেই সময়ই আমি আমার ক’জন বন্ধুসহ ঢাকা জেল থেকে রিলিজ হই। যেতে হবে অ্যাসেম্বলিতে কিন্তু তখন একটা অর্ডার এল। এদিকে কাগজপত্র তৈরি করে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি এলাম তেজগাঁও এয়ারপোর্টে। প্লেনে উঠেছি, কিন্তু প্লেন ছাড়ে না। কী ব্যাপার ? তেজগাঁও থানার ওসি প্লেনে উঠে হাঁক দিলেন, ‘হু ইজ সরদার ফজলুল করিম ?’ বললাম, ‘আই অ্যাম সরদার ফজলুল করিম।’ বলল, ‘ইয়ু প্লিজ স্ট্যান্ডআপ। ইয়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ তারপর যা হয়। আমি সরদার ফজলুল করিম ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ইলেক্টেড হয়ে সেখানে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। আমাকে ঢোকানো হলো জেলে। সুতরাং আমি তো অ্যাসেম্বলিতেই যাই নি, তাই আমি তার কোনো মেম্বারও নই। নির্বাচিত হওয়াটা তো আদতে নির্বাচিত হওয়া ছিল না।

১৯৫২ সালে নির্বাচন সেটা—দ্যাট ওয়াজ এ ক্রিয়েশন, ম্যাটার অব কমিউনিস্ট পার্টি। এখন কমিউনিস্ট পার্টি নেই, কিন্তু তখন ছিল। তারাই বাঘ-ছাগল-গরু সবগুলোকে এক জায়গা করে পানি খাওয়াল। এই মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, নেজামে ইসলাম—এসব লোকে ভুলে গেছে।

রাজা আসে রাজা যায়। কত আলেকজান্ডার এল গেল, এগুলোকে বিচ্ছিন্ন না করে জীবনের মধ্যে ফেলে দেখা যাক। জীবন ও রাজনীতি। এটা যে একই ব্যাপার। জীবন রাজনীতি করায়, আবার রাজনীতিই জীবন করায়। এই যে মুসলমানদের মধ্যে একটা লোক তাজউদ্দীন আহমদ—আমার সমান বয়সী। ১৯২৫-এ তাঁর জন্ম—আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছি, তেমন কোনো ইন্টিমিসি ছিল না, উনি মুসলিম লীগ করতেন। এখন এসে বুঝি, তিনি নিজে একটা ইতিহাস। তিনি নিজে ইতিহাস কারণ তিনি নিজেও ইতিহাসকে দেখতে চেয়েছেন। আজ এই সম্পর্কে একেকজনের ঈর্ষাবোধ আছে। আমি যদি বলি—তাজউদ্দীন খুব বড়, লোকে বলে, হ্যাঁ বড়। কিন্তু করছেটা কী!

তাজউদ্দীন অদ্ভুত একটা ব্যাপার। যে কথা তিনি বলেছেন, ‘আমি বাবার মৃত্যুর পরে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেই নি কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যুর পর গত তিন-চার দিন আমি মুখে তা তুলতে পারি নি। অথচ এই গান্ধীজিকে এক সময় যা তা করে গালাগালি করেছি। কারণ তখন আমি মনে করেছি, এই গান্ধীজির জন্যই মুসলিম লীগ বড় হতে পারছে না।’ এই যে ঘটনার মধ্যে নিজেকে দেখা, এই যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ, নিজেকে ট্রান্সসেন্ড করা—এই কথার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে ট্রান্সসেন্ড করেছে এবং শেখ মুজিবকেও আমি সে জায়গা থেকে দেখি। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে নিজেকে ট্রান্সসেন্ড করেছেন।

ধরা যাক, শেখ মুজিব ভাষণ দিয়ে বাসায় গেছেন। তখন যদি ফজিলাতুন নেসা তাঁকে বলেন, তুমি এসব কী বলে এসেছ—শেখ মুজিব যদি কোনো উত্তর দিয়ে থাকেন, তখন দিয়েছিলেন, ‘আমি জানি না আমি কী বলেছি।’ এটাকেই বলে ট্রান্সসেন্ড। কেননা হি ওয়াজ এ ট্রান্সফর্ম মাইন্ড। এটাকেই ইংরেজিতে বলে ট্রান্সসেনডেন্স। এখানে তিনি নিজকে অতিক্রম করে গিয়েছেন। মানুষ অতিক্রান্ত হয়ে যায়। অতিক্রম করে তার ঘটনা, তার লোকজন। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। ম্যাক্সিম গোর্কির। গোর্কি নিজেই বলেছেন, তাঁর আত্মজীবনীর কোনো একটাতে পেলাম। তিনি বলছেন, আমার তো কোনো গঁৎ নাই, তবে একটা গঁৎ আছে, সেই গঁতের নাম—ম্যান। আমি অবাক হয়ে দেখি, একটা ক্ষুদ্র প্রাণী। তিন হাত কি চার হাত। সে কতকাল—কত লাখ বছর আগে থেকে সে হাঁটছে-হাঁটছে, আসছে-যাচ্ছে, পড়ছে মরছে, উঠছে নামছে আবার করে আবার জেগেছে—একটা মৃত্যুহীন মানুষ। এই যে আমরা বলি, ‘ম্যান ইভ মর্টাল’—এটা ঠিক না। আমি এইখানে গোর্কির কাছ থেকে শিখতে পাই। এখানেই গোর্কি আমার ভাগ্য। তিনি ওই কথাটি আমার ভেতরে সঞ্চারিত করেন। মানুষের উত্থান-পতনের পর ফের পুনরুত্থানের কথাটি। তরুণরা আজকে বলে, আর কত বছরে সমাজতন্ত্র আসবে ? আমি বলি, দশ হাজার বছর। আমি আবার বলি, বারো লক্ষ বছর লাগবে। কেন বারো লক্ষ বছর লাগবে ? আমি বলি, তুমি আসছ কোত্থেকে ? তুমি খোঁজ নাও। আমি বিশ্বাস করি, বারো লক্ষ বছর পরও মানুষ নামের প্রাণী থাকবে। তবে আমেরিকা যা শুরু করেছে, তার পক্ষে একটা গ্লোব ধ্বংস করা কোনো কঠিন ব্যাপার না। বাংলাদেশের মতো পাঁচ আঙুল জায়গা, এটাকে ধ্বংস করা আমেরিকার পক্ষে কিছু না। গোটা পাঁচেক বোমা মারলেই এটা ধ্বংস হয়ে যায়। আমি জানি না, অন্য কোনো গ্রহে মানুষ আছে কি-না—মঙ্গলে, বুধে। আমি জানি না। কিন্তু এই পৃথিবী নামে একটা গ্রহ। এখানে থাকা মানুষকে আমাদের দেখতে হবে, বুঝতে হবে।

এখন গাল দিতে গিয়ে বলি, তুই একটা মানুষ না। কিন্তু আমি ক্লাসে আমাদের ছেলেমেয়েদের বলি, এটাকে উল্টে দেই, যে একটা পশু যখন আরেকটা পশুকে গাল দেয়, তখন বলে না যে, ‘তুই একটা পশু না। বলে, তুই একটা মানুষ।’ মানুষ মানুষকে পশু বলে গাল দেয়, আর পশু পশুকে গাল দেয় মানুষ বলে। কেননা, পশু ওই কাজ করে না, যে কাজ মানুষ করে। উই আর নট ম্যান। উই হ্যাভ ইয়েট টু বিকাম ম্যান। আমাদের মানুষ হতে হবে। তবে এই চর্চাটা, এই সংস্কৃতিটা যদি না আমি আনতে পারি—যে তুমি মানুষ না, তোমাদের মানুষ হতে হবে, মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ম্যান হ্যাজ ইয়েট টু বিকাম এ ম্যান; মানুষের এখনো মানুষ হতে বাকি আছে। ধরো, ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকার কথাই বলি। এই তো সেদিন নতুন একটা পত্রিকা বের হলো যার নাম—আজকের কাগজ। এই যে একটা পত্রিকা বের হলো, অথচ গত বছর তার বারো বছর পূর্তি হলো। কিন্তু তারপরও তো কথা থাকে দিন কীভাবে কেটে গেল ? এ সব প্রশ্ন মানুষকে হতাশ করে দেয়। আমি কখনোই হতাশাবাদী নই। যে মানুষ মানুষকে মারে, সে নিজেকে কী করে মানুষ বলে ? কোনো পশু তো পশুকে মারে না। কোনো পশু তো অন্য পশুকে মেরে বলে না, মেরেছি এবং মেরে ভালো করেছি। একটি পশু আরেকটি মৃত পশুর মাংস খেয়ে নিতে পারে না। আর আমরা একটি জীবিত প্রাণীকে, মানুষকে জবাই করছি, করে ছবি তুলছি। ছবিটা তারপর ফ্লাস করাচ্ছে। এসব দিয়ে সংবাদপত্র যেন বাহাদুরির কাজ করছে মনে করছে। সবাই না, অনেকেই। তো সংবাদপত্রের এই সিচুয়েশন একটা আত্মঘাতী সিচুয়েশন। আর আমাদের কী করার আছে! আত্মহত্যা ? পশুদের মধ্যে, প্রাণীদের মধ্যে আছে—তারা দলে-দলে আত্মহত্যা করে। একটা কাককে মেরে দেখুন! হিচককের ছবি আছে ‘বার্ডস’। সেখানে পাখিদের সামাজিকতা আছে।

সমাজ কি রাষ্ট্র আলাদা কি একভাবে মেলাই, কথা হলো—এভরি স্টেট ইজ অ্যান অ্যাসোসিয়েশন অব পার্সনস ফর দি অ্যাচিভমেন্ট অব ম্যান অ্যান্ড হুইচ ইজ কন্সিডার্ড টু বি গুড। অ্যাসোসিয়েশনের একটা পার্টিকুলার মিনিং আছে। এটা একটা সমিতি। তার একটা লক্ষ্য আছে, ‘গোল’ আছে, যে ‘গোল’টা হলো ‘গুড’। এই যে পত্রিকা—এত এত রং, এত টাইপ, আমি তো পত্রিকা পড়ি না—কারণ এত ছোট টাইপ ছাপা আর এত রং, এ সবের মানে কী ? লোকে বলে—বাহ্ সুন্দর, কিন্তু আমি বুঝি না, কোনটা আনন্দ পত্রিকা আর কোনটা কী! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল—অবিভক্ত ভারতে একটা পত্রিকা বের হতো, নাম—‘হিন্দু’! এখনো আছে সেটা। তাদের একটা ধারা ছিল যে, তারা কোনো নিউজকে এক কলামের বেশি করবে না। রিডার পড়ে বের করবে নিউজ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ অথবা গুরুত্বহীন। সেখানে পাঠককে গুরুত্ব দেওয়া হতো। পাঠককে জোর করা হতো না। কিন্তু এখন উল্টোটা হচ্ছে, জোর করা হচ্ছে। খবরের কাগজ তো পড়ি না। পড়া যায় না। একেবারে রং দিয়ে রক্তাক্ত মানুষের ছবি—এ ছবি দেখা যায় না। সাংবাদিকরা যেন এদিকটাও দেখেন। কেননা এরা আছেন বলেই আমরা এখনো কথা বলতে পারি।

(বর্ষ ৮, সংখ্যা ২০, ডিসেম্বর ২০০৩)

Leave a Reply

Your identity will not be published.