ধারাবাহিক রচনা নায়করাজ রাজ্জাক (পর্ব-৯)

ধারাবাহিক রচনা  নায়করাজ রাজ্জাক  (পর্ব-৯)

[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে

এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা... থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা তাঁর নায়িকা পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে

এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের লিপে জনপ্রিয় কয়েকটি গানের কথা]

 

বাংলা চলচ্চিত্রের একটি প্রধান দিক হচ্ছেগান এই গান ছবিতে ব্যবহৃত হয় দর্শককে আনন্দ দেওয়ার জন্য অথবা কোনো দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্য সংগীত প্রধান চলচ্চিত্রে গান কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এমনকি সংলাপের কাজও করে কিন্তু গানের এই ব্যবহার যদি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ব্যবহার না হয়, তাহলে গান চলাকালীন কাহিনি থেমে থাকে, চলচ্চিত্র তার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সবাক যুগে, ত্রিশের দশকে, প্রথমে গানের এমন অবাঞ্ছিত ব্যবহার দেখা গেছে বহু চলচ্চিত্রে চল্লিশ দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের গান, অন্তত কিছু ছবিতে গান তখন গানের জন্যই গাওয়া হয় নি, ছবির অঙ্গ হিসেবে সেটি রাখা হতো পঞ্চাশের দশকে চলচ্চিত্রের গানকে গতানুগতিকায় গ্রাস করে অবশ্য হঠা আলোর ঝলকানির মতো কিছু গান সুরের বৈচিত্র্য গানের কথায় মনে দাগ কেটেছিল দর্শকদের  যা হোক, মোদ্দা কথা হলোবাংলা চলচ্চিত্রে গান অপরিহার্য মনের মতো গান পেলে দর্শক সেই ছবির কিছু ত্রুটিও মাফ করে দিতে পারে ছবি ব্যবসা সফলও হয় রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রেও এমন অনেক গান রয়েছে

পর্দায় নায়করাজের অনেক গানই পেয়েছে জনপ্রিয়তা যেসব গান কিংবদন্তি হয়ে আছে, তার বেশির ভাগ সার্থকতা পেয়েছে রাজ্জাকের কারণে সিনেমার গানের দৃশ্যে তার আবেগ চরিত্রানুগ অভিনয়ের গুণে সেইসব গানগুলোও হয়েছে সমান জনপ্রিয় সিনেমার প্রেক্ষিত অনুযায়ী অনেক রোমান্টিক, স্যাড রোমান্টিক গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সুচন্দা, শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাবাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সব নায়িকাকেই দেখা গেছে তার বিপরীতে জনপ্রিয় সব সিনেমায় ধীরে ধীরে পঞ্চাশটা বছর পেরোলেও সেইসব গান এখনো চিরসবুজ মানুষের মনে তার অভিনীত ছবির গান আজও বেজে ওঠে শ্রোতাদের হৃদয়ে

 

আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো

অভিনেত্রী সুচন্দার বিপরীতে যে টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, তার মধ্যে ১৯৬৯ সালেরমনের মতো বউ উল্লেখযোগ্য সিনেমাটিতে অভিমানী রাজ্জাকের নায়িকার প্রতি আবেগতাড়িত কণ্ঠে গাওয়াআমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো গানটি খুবই জনপ্রিয় হয় রহিম নেওয়াজ পরিচালিত, জহির রায়হান প্রযোজিত ছবিতে দেখা যায় স্টুডিওতে গানটি গাইছেন রাজ্জাক বাসায় দাঁড়িয়ে রেডিওতে সেটি শুনছেন সুচন্দা অত্যন্ত শ্রোতাপ্রিয় এই গানটির শিল্পী বশীর আহমেদ গীতিকার সুরকার খান আতাউর রহমান

 

নীল আকাশের নীচে

নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তায় চলেছি একা/নীল সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা’—১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়ানীল আকাশের নীচে ছবির টাইটেল গান এটি নায়করাজ আরনীল আকাশের নীচে যেন একে অন্যের সমার্থক প্রচণ্ড জনপ্রিয় হওয়া এই সিনেমার এই গানটি এখনো স্বপ্নালু তারুণ্যের প্রতীক এখানে হাতে একটি ডায়েরি নিয়ে রাস্তায় চলতে চলতে গানটির দৃশ্যে অভিনয় করেন নায়করাজ ছবিতে রাজ্জাকের নায়িকা ছিলেন কবরী গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় সুর করেন সত্য সাহা কণ্ঠ দিয়েছেন মাহমুদুন্নবী

 

প্রেমেরই নাম বেদনা

নীল আকাশের নীচে ছবির আরেকটি গানপ্রেমেরই নাম বেদনা ছবির একটি বেদনাবিধুর দৃশ্যে রমনা পাার্কে বসে এই গানটি করেন রাজ্জাক এই গানেও রাজ্জাকের বিপরীতে ছিল কবরীর উপস্থিতি গাজী মাজহারুল আনোয়ার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথায় গানটির সুর করেন সত্য সাহা কণ্ঠ দিয়েছেন মাহমুদুন্নবী

 

অনেক সাধের ময়না আমার

১৯৬৯ সালে নির্মিত কাজী জহির পরিচালিত রাজ্জাক-কবরী জুটির আরেকটি জনপ্রিয় ছবিময়নামতি ছবিরঅনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায় জনপ্রিয় হওয়া এই গান  এখনো জনপ্রিয় গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বশীর আহমেদ এখানে দেখা যায়, কবরীর বিয়ে হয়ে গেছে অন্যের সঙ্গে পালকিতে চড়ে কবরী যাচ্ছেন স্বামীর বাড়ি তখন পেছন পেছন যাচ্ছেন রাজ্জাক আর গাইছেন এই গানটি

 

তুমি যে আমার কবিতা

নজরুল ইসলাম পরিচালিতদর্পচূর্ণ ছবির গান ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে পর্দায় দেখা যায় বাড়ির ভেতর গানটির সঙ্গে অভিনয় করছেন রাজ্জাক-কবরী জুটি রাজ্জাক-কবরী তখন জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গেদর্পচূর্ণ ছবিটি মুক্তির পরপরই গানটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টিভি লাইভে, বেতারে আজও সমান জনপ্রিয় মিষ্টি প্রেমের এই গানটি গেয়েছেন মাহমুদুন্নবী সাবিনা ইয়াসমিন কথা লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল সুর করেছেন সুবল দাস এখনো রাজ্জাক-কবরী জুটি বলতে অনেকের মনেই ভেসে ওঠে মিষ্টি প্রেমের এই গানটি

 

দূর দূর-দূরান্তে

১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়াদীপ নেভে নাই ছবির গান পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা আজও গানটি সমান জনপ্রিয় একদিকে বন্ধুদের নিয়ে গিটার হাতে ঘরের মধ্যে গানটিতে পারফরম করেন রাজ্জাক, ওদিকে বান্ধবীদের নিয়ে গানটির সুরে মেতে ওঠেন কবরী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গাওয়া এই গানটির সুরকার সত্য সাহা লিখেছেন . মো. মনিরুজ্জামান মনির

 

আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন

হ্যালো কাকে চাই আপনি, আপনি কে ?’ নায়কের ফোন পেয়ে নায়িকার প্রশ্ন উত্তরে নায়ক বলেন, ‘সেই আমি এরপর শুরু হয় গান রাজ্জাক অভিনীত অন্যতম জনপ্রিয় গানটি ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়ানাচের পুতুল ছবির পরিচালক অশোক ঘোষ এতে রাজ্জাকের বিপরীতে অভিনয় করেন শবনম ফোনেই পুরো গানটির দৃশ্যায়ন শেষ হয় মাহমুদুন্নবীর গাওয়া গানটির সুরকার রবিন ঘোষ, গীতিকার কে জি মোস্তফা

 

মাগো মা, ওগো মা

মাগো মা ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা/আমি দুনিয়া ছাড়ি যেতে পারি, তোকে আমি ছাড়ব না’—বাংলা চলচ্চিত্রে মাকে নিয়ে করা অন্যতম জনপ্রিয় এই গানটি দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রসমাধি মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে ছবিতে মাকে নিয়ে নেচে নেচে গানটিতে পারফরম করেন রাজ্জাক মো. খুরশীদ আলমের গাওয়া সেরা গানগুলোর একটি এটি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার সত্য সাহা

 

আমি কার জন্যে পথ চেয়ে রবো

আমি কার জন্যে পথ চেয়ে রবো, আমার কি দায় পড়েছে ?’ নায়িকার এমন কথার জবাবে নায়কের উত্তর, ‘আমার অনেক কাজ ছিল তাই তো আসতে দেরি হয়েছে, কিছু মনে কোরো না আজিজুর রহমানের পরিচালনায় ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়াঅমর প্রেম ছবির গান ছবির মতো গানটিও স্মরণীয় হয়ে আছে রাজ্জাক-শাবানা জুটির কথা এলেই চলে আসে এই গানের প্রসঙ্গ কণ্ঠ দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান খন্দকার ফারুক আহমেদ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় গানটিতে সুর দেন সত্য সাহা

 

এমনও তো প্রেম হয়

১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়াদুই পয়সার আলতা ছবির গানটি লাখো ভক্তের মন ছুঁয়ে আছে পরিচালক আমজাদ হোসেন ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে নায়িকার বিরহের একটি দৃশ্যে গানটি ব্যবহৃত হয় দৃশ্যায়ন করা হয় রাতে রাজ্জাকের পাশাপাশি শাবানাকেও দেখা যায় গানটিতে চলচ্চিত্রে সৈয়দ আবদুল হাদীর গাওয়া সেরা গানগুলোর একটি এটি কথা সুর করেন আলাউদ্দিন আলী চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ছবিটি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে ছবিটির দুটি কপি এখনো জমা আছে

 

হয় যদি বদনাম হোক আরো

১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়াবদনাম ছবির এই গানটিতে নায়করাজকে ভিন্ন এক রূপে দেখা গেছে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে অলিগলি ঘুরে ঘুরে গানটিতে অভিনয় করেন তিনি মজার বিষয় হচ্ছে, গানটি গেয়েছিলেন আরেক নায়ক প্রয়াত জাফর ইকবাল গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় গানটিতে সুর দেন আনোয়ার পারভেজ ছবিটি পরিচালনা করেন রাজ্জাক নিজেই

 

হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস

গ্রামের দরবেশ আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাজ্জাক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ট্রাক দুর্ঘটনায় বাবার অকাল মৃত্যুতে গ্রামে আসেন রাজ্জাক আধ্যাত্মিক শক্তিকে স্বীকার না করলেও তার মধ্যে সেটির প্রকাশ দেখা যায় এবং মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্তবড় ভালো লোক ছিল ছবিটিরহায় রে মানুষ রঙিন ফানুস, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগ রঙিলা গানগুলো লোকের মুখে মুখে ফেরে

 

তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে

চাষী নজরুল ইসলামেরশুভদা সিনেমার গান এটি সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া গানটি সিনেমায় রাজ্জাককে গাইতে দেখা যায় ঢোল বাজাতে বাজাতে ভক্তিমূলক এই গান সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেয়

 

আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন

১৯৯৭ সালে রাজ্জাক পরিচালিতবাবা কেন চাকর ছবির গান এটি রাজ্জাক তার পরিবারে সুখী মানুষ অবসরপ্রাপ্ত লোকের জীবনে বড় ছেলে, বড় বউ, তাদের তাচ্ছিল্য, ছোট ছেলের দায়িত্বশীলতা, স্ত্রীর মৃত্যু এভাবে বাস্তবসম্মত দিকগুলো স্থান পেয়েছে গানটিতে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বিখ্যাত শিল্পী খালিদ হাসান মিলু

ছাড়াদীপ নেভে নাই ছবিতেবড় একা লাগে, ‘অনন্ত প্রেম ছবিতে চোখে চোখ পড়েছে যখনি, অবুঝ মন ছবিরশুধু গান গেয়ে পরিচয়, রংবাজ ছবিতেএই পথে পথে আমি একা চলি, অশিক্ষিত ছবিতেমাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই, ‘আমি এক পাহারাদার, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে, ‘মাটির ঘর ছবিতেআমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোলোআনা, বন্ধু ছবিতেবন্ধু তোর বারাত নিয়ে আমি যাব, ‘আলো তুমি আলেয়া ছবিরতোমাদের সুখের এই নীড়ে, ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে গানগুলো এখনো ব্যাপক জনপ্রিয় যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.