১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন নতুন রূপ পেতে থেকে। বাংলা এবং ভারতবর্ষের এই বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ল জার্মানি এবং রাশিয়া। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব-প্রয়াসের প্রায় সমান্তরালে চলতে থাকল বাংলা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবের প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে রুশ বিপ্লবী এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেম এবং বিপ্লবের কাহিনি এবং এই দুই ভূখণ্ডের বিপ্লবীদের আন্তঃসম্পর্ক। লেখাটির প্রথম খণ্ডের কাহিনি শেষ হয়েছে ১৯১৪-১৫ সালে। এবং এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘অন্যদিন’-এ। এই খণ্ডের গল্প আরম্ভ হয়েছে ১৯১৪ সালের রাশিয়ায় আর শেষ হয়েছে ১৯২১-২২ সালে গিয়ে।
২
ইউরোপে যুদ্ধের ছায়া ঘনিয়ে আসছে। সবাই জানে যুদ্ধ হবেই, এখন শুধু মৌচাকে ঢিল ছোড়ার অপেক্ষা। যেই ছুড়ুক, ঢিল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।
ইনেসা মাত্রই বাচ্চাদের নিয়ে ইতালির ত্রিয়েস্তে থেকে লন্ডন শহরে বেড়াতে এসেছে। ওর প্রাক্তন স্বামী আলেকজান্ডার আরমান্ডের নতুন মেয়েবন্ধু হয়েছে। মেয়েটার নাম আনা আরবেল। আলেকজান্ডারের বন্ধুর বিধবা স্ত্রী। ইনেসা এটা জেনে খুশি হয়েছে। আলেকজান্ডারের জীবনে ওর চেয়ে ভালো কেউ আসুক, আলেকজান্ডার ইনেসার দেওয়া দুঃখ ভুলে যাক—সেটা সে নিজেও সব সময় চেয়েছে। এবার ওরা দুজনও লন্ডনে এসে ইনেসার সাথে যোগ দেবে। তা ছাড়া আলেকজান্ডারের বোন আনাও আসতে পারে। আনা এখনো ইনেসার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাই ইনেসা সবকিছু মিলিয়ে যেমন খুশি, তেমন উত্তেজিত। কিন্তু এই সময় লেনিন ওর ঘাড়ে আবার কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। ব্রাসেলসে ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট ব্যুরোর কনফারেন্স হবে। ওরা কনফারেন্সের নাম দিয়েছে ঐক্যসম্মেলন। লেনিনের ঐক্যে কোনো আপত্তি নেই, তবে তালগাছ তার ভাগে পড়তেই হবে। লেনিন ইনেসাকে চিঠি লিখে বলেছে—
আমি ব্রাসেলস গেলে মেনশেভিকরা আমার পেছনে লাগবে। আমি সেই সুযোগ ওদের দিতে চাচ্ছি না। জিনভিয়েভ যেতে পারত কিন্তু ওর স্ত্রী খুব অসুস্থ। ওদিকে কামেনেভ রাশিয়ায় পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। এই অবস্থায় তুমিই একমাত্র ভরসা, ইনেসা। তোমাকে কনফারেন্সে যেতেই হবে।
লেনিনের এরকম নাছোড়বান্দা অনুরোধ নতুন না। কিন্তু ইনেসা এবার ভীষণ বিরক্ত হলো। বাচ্চাদের নিয়ে মাত্রই সে লন্ডন বেড়াতে এসেছে। সবাইকে রেখে কীভাবে এখন সে ব্রাসেলস কনফারেন্সে যাবে ? ইনেসা মুখের উপর ‘না’ বলতে পারল না, আবার ‘হ্যাঁ’ও বলল না। ব্যাপারটাকে ইনেসা আপাতত ঝুলিয়ে রাখল।
ইদানীং সমাজতান্ত্রিক মহলে লেনিনের প্রভাব কিছুটা হলেও বেড়েছে। রাশিয়ায় ডুমা নির্বাচনে বলশেভিকরা ভালো করেছে। ‘প্রাভদা’ পত্রিকার কাটতি দিনদিন বাড়ছে। লেনিনকে একেবারে গোনার বাইরে ফেলে রাখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে লেনিন আগস্ট মাসে আরেকটা পার্টি কনফারেন্সের কথা ভাবছে। এর আগে প্রাগে লেনিন একটা চালাকির কনফারেন্স করেছিল। পরে বেশি কাউকে আসার সুযোগ না দিয়ে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু লেনিন এবার একটা স্বাভাবিক সর্বসম্মতির কনফারেন্স করতে চাচ্ছে। লেনিনের ক্ষমতা আগের থেকে বাড়লেও বেশ কয়েকটা ব্যাপারে সে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। রাশিয়ায় বলশেভিক দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মালিনোভিস্কিকে লেনিন সব সময় সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সে জারের গোয়েন্দা এজেন্সি ওখরানার চর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ গত বছর যখন সবাই এই একই সন্দেহ করছিল, লেনিন তখন মালিনো ভস্কির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
এদিকে পার্টির ফান্ডিং-এর অনেক টাকা কারা জেটকিন্সের হাতে আটকে আছে। যেহেতু এই টাকার উপার্জনের পন্থা নিয়ে কিছু কেলেংকারি আছে, কারা সেই টাকা থেকে বলশেভিক দলকে এখন পর্যন্ত এক পয়সাও দেয় নি। এটা নিয়ে লেনিন মামলা করার হুমকি দিয়েছে। লেনিন সোশালিস্ট বুরোর সেক্রেটারির সঙ্গেও বাজে ঝগড়া করেছে। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কারণেই লেনিন ব্রাসেলসের কনফারেন্সে নিজে না গিয়ে ইনেসাকে পাঠাতে চাচ্ছে।
ইনেসা যখন ব্রাসেলসে যাওয়ার ব্যাপের হ্যাঁ-না কিছুই বলল না, লেনিনের মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু লেনিন ঠিকই জানে ইনেসার দোদুল্যমানতার কারণ কী। ইনেসা তার জীবনকে সমান দুভাগে ভাগ করেছে। একদিকে ওর ছেলেমেয়ে, অন্যদিকে লেনিন আর বিপ্লব। এই মুহূর্তে ইনেসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পারিবারিক সময় কাটাচ্ছে, লেনিন বললেই কি হুট করে সব ছেড়েছুড়ে সে ব্রাসেলসে ছুট দেবে ?
লেনিন ঠিকই বুঝে যে ওর উপর ইনেসার সুতীব্র অভিমান আছে। ইনেসার অভিমান নিয়ে লেনিন বেশি ভাবতে চায় না। বেশি ভাবলে ওর নিজের মনও নরম হয়ে যাবে। কিন্তু যে করেই হোক ইনেসাকে এখন লাগবেই লাগবে। ইনেসার মতো করে ব্রাসেলসে ঝামেলা সামলানোর কাজটি আর কেউ করতে পারবে না। লেনিন আবার ইনেসাকে ইনিয়েবিনিয়ে চিঠি লিখল—
ইনেসা, প্লিজ দেখো না ছেলেমেয়েদের ছয়-সাত দিন সময় দিয়ে কনফারেন্সে চলে আসা যায় কি না ? তুমি ছাড়া আমি কার উপর নির্ভর করব বলো তো ? তোমার মতো ফ্রেঞ্চ আর কেউ বলতে পারে না। তুমি নিয়মিত ‘প্রাভদা’ পড়ছ, চারদিকে কী হচ্ছে তা সবিস্তারে জানো। তা ছাড়া তুমি যত কৌশলী আমি ঠিক তত না। একমাত্র তুমিই নিখুঁতভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে অন্যদের সাথে তর্ক করতে পারবে। প্লিজ হ্যাঁ বলো।
একটা চিঠি পাঠিয়েই লেনিন ক্ষান্ত হলো না । এক ঘণ্টা পর আরেকটা চিঠি লিখল—
ইনেসা, আমার খুব ভয় হচ্ছে তুমি না বলবে। প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করো ইনেসা, আমি গত টানা আট দিন ধরে কষ্ট করে আমাদের রিপোর্ট লিখেছি। আমাদের রিপোর্ট ঠিকমতো করে, সাবলীল ফরাসি ভাষায় পড়াটা খুবই জরুরি। আমার এমন একজনকে দরকার যে আমাদের আদর্শগত অবস্থা ভালোমতো বুঝতে পারে। তুমি ছাড়া আমি আর কারও কথা ভাবতেই পারছি না।
ওই চিঠির পরও লেনিন ক্ষান্ত হলো না, পাগলের মতো একটার পর একটা চিঠি আর অসংখ্য টেলিগ্রাম ইনেসাকে পাঠিয়ে চলল। লেনিন ভাবছে ইনেসা শেষ পর্যন্ত তার কথা ফেলতে পারবে না। এ জন্য ইনেসার সঙ্গে কাকে পাঠানো হবে সেটাও লেনিন ঠিক করে ফেলেছে। ইভান পপভ আর গিওরগি সাফারভকে ওর সঙ্গে পাঠানোই ভালো হবে। শেষ পর্যন্ত লেনিনের কাকুতিমিনতি কাজে দিল। ইনেসা ব্রাসেলস যেতে রাজি হলো। লেনিন খুশি হয়ে লিখল—
ইনেসা, আমার প্রিয়তমা, মনে হচ্ছে তোমাকে এক হাজারটা চুমি দিই। এখন আর আমার কোনো ভয় নেই। আমি জানি তুমি জিতে আসবে। তুমি একা কোনো কাজের দায়িত্ব নিলে সেটা আরও ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।
বহুদিন পর ইনেসাকে লেনিন এমন অন্তরঙ্গ ভাষায় কিছু লিখল। কিন্তু ইনেসা জানে লেনিন ওকে দিয়ে কাজ করানোর জন্যই এত মিষ্টি করে কথা বলেছে। লেনিন ওকে নয়, আজীবন বিপ্লবকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। ইনেসা লেনিনের আদরমাখা চিঠির কোনো উত্তর দিল না।
বারবার এত চিঠ পাঠাবার পর হঠাৎ একটা কথা ভেবে লেনিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। ইনেসাকে ও আগে অনেক প্রেমপত্র লিখেছে, আবার কাজের চিঠিও লিখেছে। হঠাৎ যদি লেনিনের লেখা প্রেমপত্রগুলো বিপক্ষ দলের হাতে পড়ে, তাহলে মহা মুশকিল হয়ে যাবে। এই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে লেনিনের নেতৃত্ব, নৈতিক অবস্থান, সবকিছু নিয়ে ওরা প্রশ্নের ঝড় তুলবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ বিপ্লব। এমন ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কিছুদিন বাদে লেনিন ইনেসাকে আরেকটা চিঠি পাঠাল—
ইনেসা, তুমি এক কাজ করো। ব্রাসেলস যাওয়ার আগে পরোনিন চলে এসো। আমাদের সব প্রেমপত্র সঙ্গে নিয়ে আসবে। ডাকে পাঠাবে না প্লিজ, এমনকি রেজিস্টার্ড ডাকেও না। ডাকে পাঠালে ইন্টালিজেন্স খাম খুলে চিঠি পড়বে। সব চিঠি একটা ব্যাগে ভরে তোমার সঙ্গে আনবে। প্লিজ, যত চিঠি আমি তোমাকে লিখেছি, সব আনবে। এখন কাজের কথায় আসি। প্লেখানভের স্বভাব তো জানোই, হুট করে বিরাট একটা ভাব নিয়ে কথা বলে সে নারী কমরেডদের চমকে দিতে চায়। প্লেখানভ কিছু বললে তুমিও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দেবে, দারুণ বলেছেন কমরেড প্লেখানভ, আপনি একটা পুরোনো স্ফুলিঙ্গ। আমি জানি আমি ব্রাসেলস না গেলে অনেকেই ক্ষেপে যাবে, তাতে আমি আরও খুশি। কিন্তু ওদের সব ঝাল গিয়ে পড়বে তোমার উপর। তবে আমি নিশ্চিত যে তুমিও ওদের দেখিয়ে দেবে তোমার নখে কত ধার। ঠান্ডা মাথায় শীতল কণ্ঠে ওদের পাল্টা ঝারি দেবে। প্লেখানভ তোমার কথার মাঝে কথা বলে মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করবে। ওকে শুনিয়ে দেবে, আপনি কি অনুগ্রহ করে আমার কথায় বিঘ্ন ঘটানো বন্ধ করবেন ? প্লিজ! আরেকটা কথা। রোজা লুক্সেমবার্গ যেরকম নীতিবান মহিলা, ও প্রাগ কনফারেন্সের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করবে। শুধু বলবে, আমরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ দল এবং আমরা কনফারেন্স ডাকতেই পারি। তুমি ইনেসা নামে যাবে না, তোমার নাম হবে কমরেড পেত্রভা।
লেনিন চিঠিতে যে কাজের কথা লিখেছে, সেগুলো নিয়ে ইনেসার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লেনিন সব প্রেমের চিঠি ফেরত চাওয়ায় ইনেসা আহত হলো। এটা কি লেনিন নিজেই বলেছে নাকি নাদিয়া ওকে দিয়ে বলিয়েছে ? লেনিন কি ওকে বিশ্বাস করে না ? ঠিক আছে, নিয়ে নিক লেনিন ওর সব চিঠি। চাপা অভিমানে ইনেসার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ব্রাসেলস যাওয়ার পথে লেনিনের সব চিঠি ইনেসা লেনিনের কাছে নিয়ে এল। কিন্তু লেনিন একটা চিঠিও জমিয়ে রাখল রাখল না। সব আগুনে পুড়িয়ে ফেলল।
ব্রাসেলস কনফারেন্সও সময়মত শুরু হলো। ব্রাসেলস কনফারেন্সে দশটা সমাজতান্ত্রিক গ্রুপ উপস্থিত। ট্রটস্কি, রোজা লুক্সেম্বার্গ, প্লেখানভ, অ্যাক্সেলরড, কাউতস্কির মতো সব বড় বড় নেতারাই এবার কনফারেন্সে এসেছে। লেনিন আসে নি দেখে সবাই খুব রেগে আছে। ইনেসা বলল, আমাকে বলশেভিক সেন্ট্রাল কমিটি পাঠিয়েছে। আমিই লেনিনের প্রতিনিধি।
কিন্তু ইনেসা কোনো ভোটাভুটিতে অংশ নিল না। এতে সবার রাগ আরও বাড়ল। যখন লেনিনের রিপোর্ট পড়ার সুযোগ এল, ইনেসা এত নিচু স্বরে পড়া আরম্ভ করল যে অনেকে শুনতেই পারছিল না। ইনেসা মৃদু স্বরেই বলল, লেনিন সব সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর ঐক্যের পক্ষে। লেনিন চায় এই ইউনিটি কনফারেন্স সফল হোক। কিন্তু লেনিনের চৌদ্দটা শর্ত আছে।
সবাই চৌদ্দটা শর্তের কথা শুনে অবাক হয়ে ইনেসার দিকে তাকিয়ে রইল। ইনেসা কোনো ভ্রƒক্ষেপ না করে বলল, লেনিনের একটা মূল শর্ত হলো যেসব মেনশভিক সংবাদপত্র বলশেভিক পত্রিকার সাথে প্রতিযোগিতা করছে, সেগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। আরেকটা শর্ত হলো, ডুমায় মেনশেভিক সদস্যরা বলশেভিকদের অধীনে থাকবে।
ইনেসার শর্তগুলো শুনে সবাই ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কিন্তু ইনেসা দমল না। সব শর্ত পড়া শেষ করে ইনেসা দর্শকদের দিকে তাকাল। সবাই ক্রুদ্ধ, বিস্ফোরণমুখ। ওদের চেহারার দিকে তাকিয়ে ইনেসার মনে হলো, জীবনে এতটা অপমানজনক অবস্থায় লেনিনের কারণে সে আগে কখনো পড়ে নি। প্লেখানভ চেঁচিয়ে বলল, এটা রিপোর্ট নাকি ক্রিমিনালদের কোড ?
কাউতস্কি রেগে বলল, লেনিন আমাদের গালে চড় মেরেছে। লেনিনের কথা শুনলে আমাদের ঐক্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
কেবল ট্রটস্কি চুপচাপ সব শুনল, কিছু বলল না। পরদিন কনফারেন্স সেক্রেটারি একটা ঝাপসা রিজলুশন লিখল যেন সেটা সবাই সাক্ষর করতে পারে। এতে অন্তত মনে হবে কনফারেন্স ব্যর্থ হয় নি। বাইরের জগতে মুখরক্ষা হবে। কিন্তু ইনেসা সেটাতেও সাক্ষর করল না। লেনিন ওকে কোনো ধরনের মতৈক্যে আসতে মানা করে দিয়েছে। আবার উপস্থিত সবাই বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।
লেনিন যেভাবে যা চেয়েছে, নিজে অপমানিত হয়েও ইনেসা সবকিছু ঠিক সেভাবেই করেছে। ইনেসার ওপর লেনিন দারুণ সন্তুষ্ট। কিন্তু কনফারেন্সে লেনিনের রিপোর্ট পড়ার বাজে অভিজ্ঞতায় ইনেসার মন অসাড় হয়ে গেছে। বলশেভিকদের ঘাড় তেরামোর পর অন্যদলগুলো নিজেরা আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কনফারেন্সের পর অনেকেই ভাবছে, লেনিনের বলশেভিক পার্টিকে ইউরোপের মূলধারার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। সামনেই আবার ভিয়েনা কনফারেন্স। লেনিন এখন জোরেসোরে ভিয়েনা কনফারেন্সের জন্য তৈরি হচ্ছে। কারণ ওখানেই হবে বলশেভিক পার্টির সাথে বাকিদের কামড়াকামড়ি লড়াই। এই লড়াইয়ে যোগ দিতে নাদিয়া পর্যন্ত নকল পাসপোর্ট তৈরি করেছে।
কিন্তু ব্রাসেলস কনফারেন্সের দশ দিন পরেই ইউরোপের চিত্র পাল্টে গেল। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্রাট আর্ক ডিউক ফ্রাঞ্জ ফারডিনান্ড বসনিয়া আর হারজেগিভনার রাজধানী সারায়েভো ভ্রমণে এসেছিল। বসনিয়া আর হারজেগিভনাকে ১৯০৮ সালে জোর করে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফ্রাঞ্জ ফারডিনান্ড আর তার জার্মান স্ত্রী সোফি যখন গাড়ি করে একটা হাসপাতালে যাচ্ছে, তখন ওদের গুলি করে হত্যা করল একজন দেশপ্রেমী বসনিয়ান সার্ব।
মৌচাকে এই ঢিল ছোড়াটাই বাকি ছিল। এক সপ্তাহের ভেতর অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে সার্বিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। পুরো ইউরোপ যুদ্ধের উন্মাদনায় কেঁপে উঠল।
এ অবস্থায় ভিয়েনায় সোশালিস্ট পার্টিগুলোর কনফারেন্সের প্রশ্নই ওঠে না। লেনিনের বলশেভিক দল একটা বড় ক্ষতির হাত থেকে এ যাত্রা বেঁচে গেল।
(চলবে)
Leave a Reply
Your identity will not be published.