জহির রায়হান: চেতনায় নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি

জহির রায়হান: চেতনায় নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি

এ দেশের চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম এক স্রষ্টা জহির রায়হান। ৩০ জানুয়ারি ছিল তাঁর ৫১তম অন্তর্ধান দিবস। তিনি ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। বাল্যকালে ডাকনাম ছিল জাফর। ‘রায়হান’ নামটি দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা মনি সিংহ— যা ছিল রাজনৈতিক নাম। জহির রায়হানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ এ লেখাটি পত্রস্থ করা হলো।

স্বাধীনতা পূর্বকালের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে অন্যতম জহির রায়হান। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই মূলধারার একেবারে বাইরে গিয়ে তাঁর পক্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হয় নি। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বুকে তিনি অক্ষয় চিহ্ন রেখে গেছেন। তিনিই এ দেশের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন। এ দেশের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’র নির্মাতাও তিনি। এমনকি রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন প্রথম চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ও তার বানানো। কম সময়ে এবং কম বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণের দৃষ্টান্তও তিনি রেখে গেছেন।

জহির রায়হান চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রথম জড়িত হন ১৯৫৭ সালে, এ জে কারদারের সহকারী হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (‘পদ্মা নদীর মাঝি’র চলচ্চিত্ররূপ) ছবিতে। এ ছাড়া এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ ছবির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের আত্মপ্রকাশ ‘কখনো আসে নি’ (১৯৬১) ছবির মাধ্যমে। এখানে নিম্নমধ্যবিত্তের দুঃখ-কষ্ট এবং সংকট তুলে ধরা হয়েছে। অর্থ যে সবকিছুর চালিকা শক্তি এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রকার। নির্মাণে পরিচ্ছন্নতা ছিল, চলচ্চিত্র ভাষা প্রয়োগের চেষ্টা ছিল।

জহির রায়হান এগারো বছরের চলচ্চিত্র জীবনে ৮টি কাহিনিচিত্র ও ২টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে কখনো আসে নি (১৯৬১), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), আনোয়ারা (১৯৬৪), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) স্টপ জেনোসোইড (১৯৭১) প্রভৃতি।

জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে দেশের আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে জীবনবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণ (‘কখনো আসে নি’ থেকে ‘কাঁচের দেয়াল’), দ্বিতীয় পর্বে চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে উর্দু ও লোক ছবি নির্মাণ (‘সঙ্গম’ থেকে ‘বেহুলা’) এবং তৃতীয় পর্বে সাহিত্যের চলচ্চিত্ররূপ এবং রাজনীতি সম্পৃক্ত ছবি নির্মাণ (‘আনোয়ারা’ থেকে ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’)।

জহির রায়হানের প্রথম পর্বের ছবিতে (কখনো আসে নি/ কাঁচের দেয়াল) নিম্নমধ্যবিত্তের সংকটকে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথম ছবিতে সংকটের পুনরাবৃত্তি এবং দ্বিতীয় ছবিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত রয়েছে। ‘কখনো আসে নি’ (১৯৬১) ও ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩)এই দুটি ছবিতেই জহির রায়হানের ব্যাষ্টিক দর্শন কাজ করেছে, বৃহত্তর সমাজের বিশ্লেষণ এখানে নেই।

দ্বিতীয় পর্বের ছবিতে যদিও জহির রায়হান বাণিজ্যিক ছবির আবহাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন, কিন্তু তারপরেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ঠিকই বজায় রেখেছেন। ‘সঙ্গম’ (উর্দু, ১৯৬৪) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রথম রঙিন ছবি এবং ‘বাহানা’ (উর্দু, ১৯৬৫) প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। ‘লোকগাথা ভিত্তিক ‘বেহুলা’ স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। জহির রায়হানের বুদ্ধিমত্তায় ‘বেহুলা’কে দর্শকরা আপনজনের মতো করে দেখতে পেরেছে। নির্মাণে যে পরিচ্ছন্নতা এবং সংগীতের যে মাধুর্য (সংগীত পরিচালনা আলতাফ মাহমুদ) ছবিতে রয়েছে তা এই ছবিকে দর্শকপ্রিয় করেছে।

তৃতীয় পর্বে সাহিত্যের চলচ্চিত্র রূপায়ণে এবং রাজনীতি সম্পৃক্ত ছবি নির্মাণে জহির রায়হান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লালন করেছেন। ‘আনোয়ারা’ জহির রায়হানের চলচ্চিত্র পর্বে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করতে পারে শুধু সাহিত্যকর্মের চিত্ররূপ হিসেবে নয়, চলচ্চিত্র ভাষার সংযত ও পরিশীলিত ব্যবহারেও। এ সময়েই দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জহির রায়হানের নির্মাণ করেছেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। এ ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম রাজনৈতিক জীবন স্থান পেল। খোলাখুলি রাজনৈতিক বক্তব্য, পূর্ব বাংলার স্বাধিকার, জনগণের সংগ্রাম অনেকটা পোস্টারের ভাষায় ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ধরা পড়ল। একটি সংসারের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতির চিত্র প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করা হলো। জহির রায়হানের যে লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রকে জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সেই লক্ষ্য অনেকটা পূরণ হয়েছে এখানে।

জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) নির্মাণ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ ছবি স্মরণীয় চলচ্চিত্রকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির একটি মহাকাব্যিক বিস্তৃতি আছে। অত্যন্ত নির্মোহভাবে বিবেচনা করেও ছবিটির যে বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাহ্য করা যায় না তা হলো এর সময় এবং স্থানকে অতিক্রম করার ক্ষমতা। ‘স্টপ জেনোসাইডে’র দৃশ্যাবলী, মানুষের নির্মম অত্যাচারের দলিল চিত্রগুলি হতে পারে যে-কোনো কালের এবং যে-কোনো দেশের। এই বৈশিষ্ট্যটি এমনিতেই একটি শিল্পকে মহত্বের মর্যাদা দেয়, ‘স্টপ জেনোসাইড’ সেই সঙ্গে এক অনন্য চলচ্চিত্র, তার ভাষায় এবং আঙ্গিকে। সাহিত্য ক্ষেত্রেও জহির রায়হানের অবদান অসামান্য। তিনিই প্রথম ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসটির নাম ‘আরেক ফাল্গুন’। এ ছাড়া কয়েকটি গল্পেও ভাষা আন্দোলন মূর্ত হয়ে উঠেছে। আদমজী পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে কীভাবে হাজার বছর ধরে এই বাংলা, বাংলাদেশের মানুষের জীবন ধারা আপন ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। জহির রায়হানের  অন্যান্য উপন্যাস হলো বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, আর কতদিন, তৃষ্ণা, কয়েকটি মৃত্যু।  এ ছাড়া তাঁর লেখা ছোটগল্পেও দেখা যায় ধর্মীয় ও সামাজিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কথাশিল্পীকে।

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যে দশজন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পার হয়ে প্রথমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন ছিলেন। পরে এদেশের বামধারার রাজনীতির সঙ্গে জহিরের গভীর যোগ ছিল।

জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুর গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। কিন্তু আজও আমাদের চেতনায়, ভাবনায় তিনি আসেন; আমাদের মগ্ন চৈতন্যে কড়া নাড়েন। আমাদের জাগ্রত করেন। তাঁর এই আসা-যাওয়া চলছেই।

Leave a Reply

Your identity will not be published.