বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা: স্বাধীনতার পাঁচ দশকের স্বপ্ন

বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা: স্বাধীনতার পাঁচ দশকের স্বপ্ন

একটি জাতির সার্বিক জীবনপ্রবণতা ও সাংস্কৃতিক গঠন বহুলাংশে নির্ভর করে তার লোকজ জীবনধারার ওপর; বিশেষ করে তার মৌলিক বা লোকজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা আবহমান লোক সভ্যতার নানান নিয়ামকের ওপর। ফোকলোর মূলত একটি জাতির শেকড় অনুসন্ধানী একটি বিদ্যাশৃঙ্খলা যা তার সাংস্কৃতিক বা জাতিগত পরিচয়কে শনাক্ত করতে পারে খুব সহজে। আদিম পরিচয়ের পাশাপাশি তার প্রবহমান জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অজস্র বিষয়কে ফোকলোর আত্মীকৃত করে থাকে।

ব্রিটেনে বা ইউরোপে যখন পপুলার এন্টিকুইটির নামে ফোকলোর চর্চা শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দী থেকে তখন মূলত তাদের জীবনঘনিষ্ঠ ঐতিহ্যগুলো এর প্রধান উপাদান হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ফিনল্যান্ডের মতো বহু দেশ তাদের জাতির গঠনের কাজে ফোকলোরকে ব্যবহার করেছে। কালেভেলার যে মহাকাব্যিক গাথাকে তারা জাতিগঠনের মূল শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিল, বলা হয় যে দেশ ফিনল্যান্ডের চেয়ে তাদের ফোকলোর পুরোনো। এভাবে আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার বেলায় এই রকম ধারণা করা যায় সহজে। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চার সঙ্গে ফোকলোর চর্চাকে অন্বিত করতে পারলে আমরা নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে পারতাম।

বাংলায় ফোকলোর চর্চা শুরু হয়েছিল মিশনারিদের হাতে; তারা মূলত এ দেশ শাসনের সুবিধার্থে দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলার লোকজীবন ও সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লোকসাহিত্য সংগ্রহ শুরু করেন। স্যার উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি গঠন করেছিলেন এবং এই উদ্যোগ ভারতবিদ্যা চর্চার প্রাথমিক সোপান হিসেবে গণ্য করা হয়। এর সঙ্গে পরবর্তীকালে গভীরভাবে যুক্ত ছিল লোকসংস্কৃতি। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীকালে বাঙালিরা ফোকলোর চর্চায় এগিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকছড়া সংগ্রহ ও প্রকাশ করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার মধ্য দিয়ে লোকসাহিত্য চর্চার গুরুত্ব বেড়ে যায় সবার মাঝে। পরবর্তীকালে দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন প্রমুখ ব্যক্তিরা এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সত্যি বলতে কী এঁরা বাংলার চিরায়ত লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডারকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন। এটাকে সংগ্রহই বলতে হবে। তবু এর গুরুত্ব অনেক। ব্রিটিশে লোকসাহিত্য বা এন্টিকুইটি সংগ্রহের পদ্ধতিগত যে উন্নতি হয়েছিল সেটা আমাদের দেশে না হলেও আমরা বেশ সফল ছিলাম বলা যায়।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ফোকলোর চর্চা শুরু হয় ষাটের দশকে বাংলা একাডেমিতে ফোকলোর বিভাগ খোলার মধ্য দিয়ে। তবে যে আগ্রহ নিয়ে তা শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ্য করি নি। কার্যত এটি ছিল নিষ্ক্রিয় একটি বিভাগ। আশির দশকের শেষের দিকে এই বিভাগটি প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে। তখনকার পরিচালক শামসুজ্জামান খানের তত্ত্বাবধানে দেশি-বিদেশি পণ্ডিতদের নিয়ে ফোকলোর কর্মশালার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। আমেরিকা, জার্মান, ফিনল্যান্ড, ভারত অন্যান্য দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের পরামর্শ, কর্মপরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ দেন। এই কর্মশালা কয়েকটি পর্বে সম্পন্ন হয়। ফোকলোরবিদেরা যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হলেও এই বিষয়ে অনেকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। বাংলাদেশ ধনী দেশ না হলেও তা ফোকলোরের উপাদানে সমৃদ্ধ সে কথা তারা উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেন ফোকলোর পড়ানো হয় না তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা বিচিত্র জনগোষ্ঠী ও বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির জন্য সিলেট ও চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফোকলোর পাঠ্য করার জোর সুপারিশ করেন। উল্লেখ্য, এই কর্মশালার আগেই আমাদের দেশে ব্যক্তিগতপর্যায়ে এই বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল। ড. আশরাফ সিদ্দিকী ও ড. মযহারুল ইসলাম আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোর বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ না থাকলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফোকলোর চর্চা হতো এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ফোকলোরের পঠন-পাঠন চলত যদিও তা ফোকলোরের আধুনিক বিদ্যায়তনিক চর্চা বলা যাবে না। অর্থাৎ ফোকলোর চর্চার পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। সত্যিকার অর্থে উচ্চ মানসম্পন্ন একাডমিক পরিসরে ফোকলোর চর্চার আকাক্সক্ষা ছিল অনেক দিনের। আমাদের সামগ্রিক লোকজ জীবন শিল্প ঐতিহ্য জীবনধারা নিয়ে পদ্ধতিগত গবেষণা ও চর্চার সুযোগ তৈরি হয় ১৯৯৮ সালে। সে বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ চালু হয়েছে।

আমরা গভীরভাবে আশা করি যে, ক্রমেই এ দেশে ফোকলোরের পঠন-পাঠনের পরিসর বিস্তৃত হবে এবং আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ফোকলোর চর্চায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসবেন।

সমাজবিদ্যা ও সংস্কৃতির মূল বিষয় হিসেবে ফোকলোর বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের মৌখিক সাহিত্যের অজস্র সম্পদ আমাদের উন্নয়ন ও জাগরণমূলক কাজে সহজে ব্যবহার করা যায়। দেশজ বা লোকজ জ্ঞান ব্যবহার করে আমাদের খাদ্য কৃষি স্বাস্থ্য পরিবেশ পর্যটন ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া যায়। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নে আমাদের দেশে লোকজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর অজস্র সুযোগ রয়েছে। খাদ্য সংরক্ষণে লোকজ জ্ঞান ব্যবহার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে। ফোকলোরের জ্ঞান বা নান্দনিক ধারণা নিয়ে আধুনিক নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে। গ্রামীণ জীবনধারাকে পর্যটনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ব্যবহারের দারুণ সুযোগ আমাদের রয়েছে। আমাদের হাজার নদ-নদী ও গাছপালা বেষ্টিত গ্রামীণ জীবন ও লোকসংস্কৃতির উপাদান (লোকগান, লোকনৃত্য, লোকনাটক, লোকক্রীড়াসহ অজস্্র পরিবেশনা) নিয়ে খুব সহজে আউটডোর জাদুঘর তৈরির সুযোগ রয়েছে, যা একইসঙ্গে আমাদের লোকজ সংস্কৃতি বিশ্বের পর্যটকদের কাছে পৌঁছাবে। অন্যদিকে এই শিল্পীরা বেঁচে থাকবেন তাদের শিল্প নিয়ে। লোকশিল্প নিয়ে আমাদের দেশে নানাভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। আমাদের বস্ত্রখাতে বা পোশাকশিল্পে লোক ঐতিহ্যের নানা মোটিফসহ এর প্রক্রিয়াজাত আদি কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। এটিকে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যায়। আমরা হারানো মসলিনের খোঁজ পেতে চলেছি। এভাবে আমাদের লুপ্তপ্রায় অন্য শিল্পবস্তু ও প্রকরণগুলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করতে পারি। মাটি-বাঁশ-বেত-কাঁসাসহ নানা প্রকার লোকজ শিল্পের প্রসার ও ব্যবহারিক-বাণিজ্যিক মূল্য খোঁজা খুব কষ্টের কাজ নয়। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আধুনিক প্রযুক্তি বিপ্লবের পাশে লোকসংস্কৃতির সমস্ত¡ উপাদান ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে যা একইসঙ্গে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যকে রক্ষা করবে এবং টেকসই-পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সার্বিক সহায়তা দেবে।

এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর চর্চা ও গবেষণা চলছে। এটিই যথেষ্ট নয়। এটি একাডেমিক চর্চা। আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা যার অধীনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘরকে একটি পূর্ণাঙ্গ ফোকলোর ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা নতুন নয়। তবে একাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে এর যে বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল সেটি সঠিকভাবে এতদিন হতে পারে নি। এখন আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে গভীরভাবে কাজ করা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছিল। একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ার জন্য আমাদের সংহত জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন। সেই কাজটি খুব সহজে করতে পারে ফোকলোর। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই এই বিষয়গুলো গভীরভাবে অনুধাবন করবেন এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসবেন।

লেখক: অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your identity will not be published.