বৈশাখের রঙ

বৈশাখের রঙ

আসছে বাংলা নববর্ষ। ১৪২৬। নতুন বছরের সূচনা থেকে দহন দিনেরও সূচনা ঘটবে। এই সময়ে বৈশাখের দহনে দগ্ধ হতে থাকি আমরা। ত্বকের সমস্যায় ভুগি, খাবার ও পোশাক নিয়ে বিব্রত হতে থাকি। মেকাপ মুছে যাওয়ার ফলে ঘেমে নেয়ে উঠি। বিশ্রী হয়ে ওঠে আমাদের অবয়ব। অবশ্য নানা সমস্যার মধ্যেও বৈশাখের একটি আলাদা রূপ আছে, রঙ আছে। আর যাপিত জীবনে কিছু বিষয় অনুসরণ করলে জীবনও হয়ে ওঠে স্বস্তির। এইসবই উঠে এসেছে এবারের প্রচ্ছদ রচনায়।

পহেলা বৈশাখ

বাংলা বর্ষের প্রথম দিন। নববর্ষ যেন শুভ হয় তাই বর্ষবরণ। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় বছরের প্রথম দিনটি। নববর্ষ উদ্যাপন মোগল সম্রাট আকবরের সময়ও হতো। এর প্রধান বিষয় ছিল হালখাতা। পুরোনো বছরের দেনা শোধ করে নতুন বছরের শুরু। বলা যায়, অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিল এটি। এখনো পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা খোলার ব্যাপারটি রয়েছে। সেদিন ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখও করান খদ্দেরকে। আগে পহেলা বৈশাখে, বাংলাদেশের নানা জেলায় বৈশাখী মেলা হতো। এইসব মেলায় কাঠের ও মাটির পুতুলসহ হস্তজাত দ্রব্যসামগ্রী, খাবার জিনিস, যাত্রা পালা গান, নাগরদোলা, বেদে-বেদেনীদের সাপখেলা দেখানোসহ নানা রকম আমোদ-প্রমোদের বিষয় ছিল। কালপ্রবাহে আজ অনেক জায়গায়ই বৈশাখী মেলা বসে না। তারপরও দেশের কিছু জায়গায় বৈশাখী মেলা বসে।  পুরোনো দিনের কিছু উৎসব অবশ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারদের পুণ্যাহ উৎসব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুরোনো বিদায় নেয় নতুনের আগমন ঘটে। এটাই জগতের নিয়ম। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলাদেশেও তেমনই নতুন অনুষ্ঠান নতুন উৎসবের সূচনা ঘটেছে। এই নগরীতে, ঢাকাতে, ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) রমনার বটমূলে ছায়ানট বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা করেছিল তৎকালীন আইয়ুব সরকারের রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদ হিসেবে। আজ ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এমনিভাবে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রাও আজ পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষ্ঠান। এমনিভাবে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পহেলা বৈশাখে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বরণ করে নেয় বাংলা নববর্ষকে।

বাংলা বর্ষপঞ্জি

১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর এটি প্রবর্তন করেন। এই নতুন বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখ-ই-এলাহী নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। নতুন এই সালটি আকবরের রাজত্বের ঊনত্রিশতম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে; কারণ এইদিন আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসন আরোহণ করেন। তারিখ-ই-এলাহী-র উদ্দেশ্য ছিল আকবরের বিজয়কে মহিমাম্বিত করে রাখা এবং একটি অধিকতর পদ্ধতিগত উপায়ে রাজস্ব আদায়ে সহায়তা করা। এর আগে মোগল সম্রাটগণ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে হিজরী বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন। আবুল ফজল ‘আকবরনামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে হিজরী বর্ষপঞ্জির ব্যবহার ছিল কৃষক শ্রেণির জন্য একটি কষ্টকর বিষয়। কারণ চন্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে এগারো-বারো দিনের ব্যবধান এবং এ কারণে ৩১ চন্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান হতো। উল্লেখ্য, আকবরের সময়ে মাসের প্রতিদিনের একটি করে স্বতন্ত্র নাম ছিল। কিন্তু এতগুলো নাম মনে রাখা ছিল কঠিন ব্যাপার। তাই সম্রাট শাহজাহান তাঁর ফসলি সনে সেগুলোকে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেন। সম্ভবত একজন পর্তুগীজ পণ্ডিতের সহায়তায় সাতদিনের সমন্বয়ে এই সপ্তাহ পদ্ধতি চালু করেন। ইউরোপে ব্যবহৃত রোমানে নামকরণের সঙ্গে সপ্তাহের দিনগুলোর মিল রয়েছে। যেমন, Sun (Sunday) রবি; Moon (monday) সোম ইত্যাদি। দিনের মতো একসময় মাসগুলোর নামও পরিবর্তিত হয়। প্রথম দিকে মাসগুলো ফারওয়ারদিন, উর্দিবাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহারিবার, মেহের, আবান, আজার, দে, বাহমান এবং ইসকান্দ নামে পরিচিত ছিল। পরে কী করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি হয় তা জানা যায় নি। তবে এটা নিশ্চিত যে নামগুলোর ভিত্তি ছিল বিভিন্ন তারকা। যে তারকামণ্ডলীর নামানুসারে বাংলা মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। সেগুলো হলো : বৈশাখা থেকে বৈশাখ; জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ; আষারা থেকে আষাঢ়; শ্রবণা থেকে শ্রাবণ; ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র; অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক; অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ; পুষ্যা থেকে পৌষ; মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।  

 

 

বৈশাখে ত্বকের যত্ন

বৈশাখের রুক্ষ আবহাওয়া ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। গরমে রোদের মাঝে ঘোরাফেরা করলে ত্বকের ভীষণ ক্ষতি হয়। কেননা সূর্যরশ্মিতে থাকে নানা রকমের আলট্রাভায়োলেট বা অতি বেগুনি রশ্মি— যা ভীষণভাবে ক্ষতিকর। ফলে ত্বক তার উজ্জ্বলতা হারায়। নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। রোদে পোড়া ছোপ, ঘামাচি, ঘাম, দুর্গন্ধ, ফাঙ্গাসের সংক্রমণসহ নানা সমস্যায় পর্যুদস্ত হই আমরা। তাই এইসময় ত্বকের বিশেষ যত্ন নিতে হবে।

খাবার খান বেছে বেছে

গরমের সময় ডায়রিয়া, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক লেগেই থাকে। এগুলোর হাত থেকে রক্ষা পেতে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটু বাড়তি সতর্কতা। এই সময়ের জন্য অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত খাবারের পরিবর্তে হালকা ও সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন। জেনে নিন এই সময়ে সুস্থ থাকতে কোন খাবার গ্রহণ করবেন আর কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন।

 

  • ঢেঁড়স, কুমড়ো, পেঁপে, লাউ প্রভৃতি সবজি এবং শাকে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। শরীরের পানির ভারসাম্য রক্ষা করতে এই ধরনের পানিসমৃদ্ধ শাকসবজি বেশি বেশি খান।
  • শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, গোলমরিচ প্রভৃতির সালাদ খান বেশি বেশি। এতে পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পেটও ঠান্ডা থাকবে।
  • ভাজা-পোড়া খাবার একেবারেই খাবেন না।
  • খুব বেশি চিনিসমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া ভালো। এসময় খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন দই, লাচ্ছি, সেমাই, ফালুদা প্রভৃতি ঠান্ডা মিষ্টান্ন।
  • শাকসবজি ভেজে রাখার পরিবর্তে চেষ্টা করবেন সেদ্ধ করে রান্না করতে।
  • বাইরের খাবার যতটা সম্ভব কম খাবেন। একান্তই বাইরে খেতে হলে শাকসবজি খান। মাছ-মাংস এড়িয়ে চলুন।

 

বদলে ফেলুন জীবনধারা

বাইরে প্রচণ্ড রোদ, একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা। তাতে কি? অফিস, বাচ্চার স্কুল, কিংবা জরুরি শপিং এরকম নানা কাজের তাগিদে আপনাকে বাইরে যেতেই হচ্ছে। এ সময়ে অতিরিক্ত গরমজনিত সমস্যাগুলো এড়াতে কিছু পরিবর্তন আনুন জীবনযাত্রায়।

  • যাদের বাইরে বেরুতেই হয়, তাঁরা চেষ্টা করুন একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে।
  • বাইরে বের হওয়ার আগেই অন্তত ৩-৪ গ্লাস পানি পানি করুন। ব্যাগে সবসময় বড় একটি পানির বোতল রাখুন। ২০-২৫ মিনিট অন্তর পানি পান করুন।
  • প্রয়োজনে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ পাউডার ড্রিংস মেশানো বড় একটি পানির বোতল সঙ্গে রাখুন।
  • দিনে অন্তত দুইবার গোসল করুন।
  • যাদেরকে রোদে কাজ করতে হয় তারা অবশ্যই সানগ্লাস এবং হ্যাট ব্যবহার করবেন। কাজের মাঝে মধ্যেই ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নিন।
  • সকাল-বিকাল হাঁটাহাঁটির সময় বারবার পানি খান। খুব বেশি ক্লান্ত শরীরে হাঁটাহাঁটি বা ওয়ার্কআউট করবেন না। চেষ্টা করবেন সকালে রোদ উঠার আগে আর বিকালে সূর্যের তাপ কমে যাওয়ার পরই এই কাজগুলো করতে।
  • খুব বেশি ঘাম হলে রুমাল বা টিসুপেপার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলুন। খেয়াল রাখবেন ঘাম যেন শরীরে না শুকায়। শরীরে শুকিয়ে সর্দি-কাশি হতে পারে।

 

 

ঢিলেঢালা পোশাক

গরমে সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার না করাই ভালো। সবচেয়ে ভালো সুতি কাপড় ব্যবহার করা। কারণ সুতি কাপড় খুব সহজেই ঘাম শুষে নেয়। ফলে শরীরের ঘামাচি বা এ জাতীয় সমস্যা কম দেখা দেয়। একই সঙ্গে অন্তর্বাসও সুতির হওয়া প্রয়োজন। এ গরমে ফিটিং পোশাকের বদলে একটু ঢিলেঢালা পোশাক পরাই ভালো। এতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। বড় বড় প্রিন্ট বা জমকালো ডিজাইনের পোশাক না পরাই ভালো। তারচেয়ে স্টাইপ, বেবি চেক বা ছোট ফ্লোরাল প্রিন্টের পোশাক দারুণ দেখাবে। আর হালকা রং বেছে নিন।

 

 

বৈশাখে মেকাপ

বৈশাখে মেকআপ  করাটাও একটা বিশেষ সমস্যা। ঘাম সব মেকআপ নষ্ট করে দিতে পারে, তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর মেকআপ যতটা কম করা যায় ততই ভালো। এ সময় ভারী মেকআপ বর্জন করুন। দিনের বেলায় কোনো ফাউন্ডেশন ব্যবহার করবেন না। তার বদলে পাউডার বা ফেস পাউডার বেছে নিন। সেইসঙ্গে ন্যাচারাল শেডের লিপস্টিক আর সামান্য কাজল। এটুকুই যথেষ্ট। এতেই আপনাকে সতেজ দেখাবে। রাতের মেকআপে সিলভার কালার লিপস্টিকের ছোঁয়া রাখুন। ভ্রুর হাড়ে সাদা হাইলাইটার ব্যবহার করুন। চোখের পাতার মাঝখানে লিপ গ্লাসের ছোঁয়াও অন্যরকম দেখাবে। আর আইশ্যাডোতে রাখুন হালকা রঙের ছোঁয়া।

বৈশাখে গয়না

এ সময়ে সোনার গয়না না পরাই ভালো। সোনার গয়না যেখানে না পরলেই নয় সেখানেই শুধু পরবেন। সবচেয়ে ভালো হয় ভারী অলঙ্কার না পরা। রুপার গহনা ব্যবহার করুন। ব্যবহার করতে পারে অক্সিডাইজও। রাতের জন্য বেছে নিন রুপা অথবা মুক্তোর গহনা। গলায় টাইট মালা বা নেকলেস ব্যবহার না করে লম্বা চেন বা পার্ল স্ট্রিং ব্যবহার করুন। আর জুতো পরার আগে পা মুছে সামান্য পাউডার লাগিয়ে নিন। আর পারলে রাতে সেরে নিন ফুট বাথ। ঠাণ্ডা পানিতে পা’টা একটু ডুবিয়ে রাখুন।

 

শেষ কথা

বৈশাখে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই হচ্ছে মূল কথা। এ ছাড়া পানিবাহিত রোগেই এ সময় মানুষ পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এ সময়ে সতর্কভাবে যাপিত জীবনের প্রহরগুলি কাটালে দেহ-মনে সুস্থ থাকা যাবে— এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

Leave a Reply

Your identity will not be published.